২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রানীর জন্য মন খারাপ

লেখক : গোলাম মাওলা রনি - ফাইল ছবি

তার সাথে আমার সাকুল্যে দেখা হয়েছিল দু’বার। প্রথম যে দফায় দেখেছিলাম তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আর দ্বিতীয় দফার সাক্ষাতের সময়কাল মনে করতে পারছি না। প্রথম সাক্ষাতে আমি তাকে বাকিংহাম প্রাসাদে কী অবস্থায় দেখেছিলাম এবং সে রাতের নৈশভোজে তিনি যে রাজকীয় আতিথেয়তা দেখিয়েছিলেন তা আমি কোনোকালে ভুলতে পারব না। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের গল্প আরব্য রজনীর কাহিনীকেও হার মানায় এবং সেই সাক্ষাৎকারের কারণ, প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি যদি আপনি পর্যালোচনা করেন তবে ১৭ দশকের আবহমান বাংলার মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোর-কিশোরীদের মনস্তাত্তি¡ক বিকাশ সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে যাবেন এবং বর্তমানের ভঙ্গুর ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজের গন্তব্য সম্পর্কেও আন্দাজ করতে পারবেন।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা থানার একটি অজপাড়াগাঁ উলানিয়াতে থাকতাম। আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। টেলিভিশন ছিল না এবং কোনো সংবাদপত্রও যেত না। গ্রাম থেকে থানা সদর অথবা সেখান থেকে জেলা সদরে যাওয়ার রাস্তাগুলো পাকা ছিল না। মাটির রাস্তায় হেঁটে পথ পাড়ি দেয়ার দুটো দৃশ্য অর্থাৎ বর্ষাকালে এবং বসন্তকালে অথবা শীতকালে যে পরিবেশ পরিস্থিতি সৃষ্টি করত তা আমার মানসপটে এমনভাবে গেঁথে রয়েছে সেগুলো লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা, দ্য লাস্ট সাপারের চেয়েও জীবন্ত।

আমাদের বাড়ি স্কুলের একদম কাছে হওয়ায় আমরা পথচলার কষ্ট তেমন অনুভব করিনি। কিন্তু আমাদের অনেক সহপাঠী প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার পথ বৃষ্টি বাদলের মধ্যে কিভাবে পাড়ি দিয়ে হররোজ স্কুলে আসত ও যেত তা আমি আপনাদের বলে বুঝাতে পারব না। অনেকের পরনের লুঙ্গি-জামা ছেঁড়া থাকত। বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীর ছাতা ছিল না। অনেকে প্রবল দারিদ্র্যের কারণে না খেয়ে স্কুলে আসত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যার্জন শেষে আবার হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যেত। আমরা যারা সচ্ছল ছিলাম তারা দরিদ্র সহপাঠীদের কষ্ট বুঝতাম- কিন্তু তারা কোনো দিন নিজেদের দুঃখ কষ্ট বেদনার জন্য হাপিত্যেশ করত না। বরং তাদের অনাবিল আনন্দ, প্রাণশক্তি ও গড় মেধা-মননশীলতা বেশি ছিল। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তারা দৌড়, মোরগ যুদ্ধ, বর্ষা নিক্ষেপ ইত্যাদিতে আমাদের প্রথম ধাক্কায় নকআউট করে দিত এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরীক্ষার ফলাফলে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় স্থান অধিকার করে আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিত।

আমাদের কিশোর বেলায় ময়-মুরুব্বিরা সবাই ভদ্রলোক ছিলেন। তাদের অপার স্নেহ-শাসন এবং দায়দায়িত্ব সব শিশু-কিশোরের জন্য প্রায় সমান ছিল। মা-চাচী-দাদীদের স্বভাব ছিল এমন যেন তারা দুনিয়ার সব বালক-বালিকার মা-চাচী বা দাদী। আমাদের গ্রামের কেউ প্যান্ট শার্ট পরত না। সবাই লুঙ্গি-শার্ট অথবা লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরত। কোনো উৎসব হলে ধনী ভদ্রলোকদের কেউ কেউ পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন এবং এ ধরনের ভদ্রলোকের দিকে লোকজন এমনভাবে তাকাতেন যে পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধানকারী বেশ বিব্রতবোধ করতেন। খাবার-দাবারে মাছ তরিতরকারি বেশি থাকত। বিয়েশাদি হলে খাসি জবাই হতো এবং বাড়িতে মেহমান এলেই মুরগি-মোরগ জবাই হতো। ধনীরাও সহজে কিংবা সচরাচর গোশত খেতেন না। কারণ গবাদি পশু-পাখিকে সবাই সন্তানসম ভালো বাসতেন। কাজেই বিনা প্রয়োজনে কেবলমাত্র রসনাতৃপ্তির জন্য পশু-পাখি হত্যা করা হতো না। এমনকি হাঁস-মুরগির ডিমও খুব প্রয়োজন না হলে খাওয়া হতো না। কারণ বেশির ভাগ গৃহিণী ডিম খাওয়ার পরিবর্তে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ মনে করতেন।

আমি আমার শৈশবে এবং কৈশোরে কেবল কোরবানি ছাড়া গরু জবাই করতে দেখিনি। অন্য দিকে মহিষ জবাই ছিল অকল্পনীয় বিষয়। কারণ কৃষির জন্য গরু-মহিষের যে গুরুত্ব ছিল এবং দুধ ও বাচ্চা উৎপাদনে গাভীর গুরুত্বের কারণে পশুগুলো প্রতিটি পরিবারে অত্যন্ত যত্নের সাথে লালিত পালিত হতো। ফলে বড় কোনো উৎসবেও গরু জবাই হতো না।

আমাদের শৈশবে বিদ্যার্থীদের জ্ঞানপিপাসা ছিল সীমাহীন। এলাকায় কোনো পাঠাগার ছিল না। বিদ্যালয়ও ছিল না। ময়মরুব্বিদের কাছে গল্প শোনা এবং পাঠ্যপুস্তকের বাইরে জ্ঞানার্জনের অধিক্ষেত্র ছিল খুবই সীমিত। পুরো গ্রামে অল্প কয়েকটি রেডিও ছিল এবং রেডিওর মালিকরা পল্লীগীতিই বেশি শুনতেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে উৎসুক লোকজন রেডিওর খবর শোনার জন্য ভিড় করতেন। রেডিওতে মাঝে মধ্যে নাটক হতো এবং তা শোনার জন্য মানুষ মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকত। কৃষিকাজ, মাছ ধরা এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ও কেনাকাটার ব্যস্ততাই ছিল মানুষের জন্য বিনোদনের অধিক্ষেত্র। বাড়িতে গরু-ছাগল বাচ্চা প্রসব করেছে। ঘরে নতুন ধান উঠেছে- অর্থকরী ফসল বিক্রি করে কিছু টাকা এসেছে- এসবই ছিল মানুষের আদি ও অকৃত্রিম আনন্দের উৎস।

উল্লিখিত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা একজন কিশোর সেই অজপাড়াগাঁ থেকে কিভাবে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবনে গেল এবং তার সাথে রাজকীয় পরিবেশে রাতের খাবার খেল তা যদি আপনাকে বলতে বলা হয় তবে নিশ্চয়ই অতি আশ্চর্য হয়ে বলবেন এটা অসম্ভব এবং অকল্পনীয়। আপনার সাথে আমি দ্বিমত করব না। কারণ সেই রাতের স্মৃতি যেমন আমাকে আবেগতাড়িত করে তেমনি সেই স্মৃতি ধারণ করে আমি গত প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে মহামান্য রানীকে হৃদয়ের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা ও আবেগের সর্বোচ্চ স্থানে লালন করে আসছি এবং তার আকস্মিক মৃত্যুতে বেদনা অনুভব করছি।

আলোচনার এই পর্যায়ে আপনারা নিশ্চয়ই গোলকধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন এই ভেবে যে, সপ্তম শ্রেণীর গেঁয়ো বাঙালি কিশোর কিভাবে স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ বাকিংহামে প্রবেশ করল এবং কোন যোগ্যতায় রানীর সাথে এক টেবিলে বসে খানা খেল। আপনাদের কৌত‚হল নিবৃত্তের জন্য বলছি যে, আমি সেখানে গিয়েছিলাম স্বপ্নে এবং রাজা-রানী-রাজপ্রাসাদ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে সেই কিশোর বয়সে সামান্য পড়াশোনার কারণে রানীর প্রতি এমন একটা আকর্ষণ পয়দা হয়েছিল যা আমাকে স্বপ্নযোগে রানীর ডাইনিং টেবিলে পৌঁছে দিতে পেরেছিল।

পরিণত বয়সে আমি যখন কিশোর বেলার সেই স্বপ্নটির কথা কল্পনা করি তখন প্রথম চিন্তা আসে- আমি অতিশয় দুর্গম ও পাশ্চাৎপদ একটি গ্রামের বাসিন্দা হয়ে এত অল্প বয়সে কী করে রানীর নাম, তার রাজত্ব এবং রাজপ্রাসাদের নামটি জানতে পেরেছিলাম। দ্বিতীয় রানীর রাজকীয় খাবার ডাইনিং টেবিল এবং রাজকীয় রীতিনীতি সম্পর্কে আমার তো কোনো পূর্ব ধারণা ছিল না। কোনো বইপুস্তক বা চলচ্চিত্র অথবা টেলিভিশনেও ওসব দেখার সুযোগ ছিল না। আমি কেবল একটি পুরনো সাপ্তাহিক পত্রিকাতে রানীর ছবি, প্রাসাদ ও তার কর্মময় জীবন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম এবং অর্জিত সেই জ্ঞান অনুযায়ী বেশ কয়েক দিন রানীর রাজকীয় জীবন নিয়ে কল্পনা করতে করতে বিস্ময়করভাবে এক রাতে আমার জীবনের সেই স্মরণীয় স্বপ্নটি দেখেছিলাম।

পরবর্তী জীবনে লন্ডন ভ্রমণ, রাজপ্রাসাদ দর্শন, মিডিয়া ও প্রামাণ্যচিত্রে ব্রিটিশ রাজকীয় জীবনযাপনের রঙিন দৃশ্য দেখার পর আমি নিজেই আশ্চর্য হয়েছি। কারণ আমার শৈশবের সেই রঙিন স্বপ্ন যখন পত্রিকার পাতায় রঙিন ছবি ছাপা হতো না এবং বাংলাদেশের টেলিভিশন ও সিনেমার পর্দায় রঙিন দৃশ্য দেখানো হতো না তখন কিভাবে আমি সেসব দৃশ্যের রঙিন রূপ দেখেছিলাম যা পরবর্তী জীবনে বাস্তবরূপে দেখা দৃশ্যের সাথে হুবহু মিল ছিল। অতীতের সেই দৃশ্য নিয়ে যখন ভাবতে বসি তখন মনে হয়, ’৭০-এর দশকের সব শিশু-কিশোরের চোখের সামনে মস্তবড় একটা আকাশ ছিল। সবাই প্রচণ্ড মুগ্ধতা নিয়ে প্রতিদিন বহুবার অবাক বিস্ময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত। তারা মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে ঢিল ছুড়ে আকাশ ফুটো করে দিতে চাইত। কখনো বা ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে আকাশ স্পর্শ করতে চাইত। গোধূলিলগ্নের এবং সুবেহ সাদিকের পর আকাশে যে রঙিন সূর্যের দেখা মেলে সে কারণে আকাশ সম্পর্কে প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি হতো।

আমাদের কিশোরবেলার দিনের আকাশ রাতের আকাশ পূর্ণিমার আকাশ অমাবস্যার আকাশ অথবা ছয়টি ঋতুর বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বহুরূপী আকাশের সৌন্দর্য আমাদের মনকে আকাশের মতো বিশাল বানিয়ে ফেলত। আমাদের প্রায় সবাই স্বপ্নের আকাশকে ধরার জন্য ছোটবেলায় মাইলের পর মাইল দৌড়াত। তারা মনে করত ওইখানে বোধহয় আকাশ নেমে পড়েছে। তারপর সেই নেমে পড়া আকাশের নাগাল পাওয়ার জন্য দুরন্ত বেগে ছুটতে থাকত এবং প্রচণ্ড ক্লান্তি ভর না করা পর্যন্ত তাদের সেই ক্রমাগত ছুটে চলা থামত না।

আকাশ ছাড়া আমার জীবনে বাতাস ছিল। কখনো মৃদুমন্দ বসন্তের বাতাস। চৈত্র মাসের গরম বাতাস, মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো বাতাস অথবা বর্ষার বৃষ্টির ঝাপটাসমেত বাতাস যা মনকে দোলা দিত- মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করত এবং চোখের পাতায় বহু স্বপ্নের বীজ রোপণ করে দিত। বাতাসের পর নদ-নদী বর্ষার বান বন্যা আর দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ ও ঘন বনজঙ্গল আমাদের মনে কবিত্ব এনে দিত- অভিযাত্রী বানিয়ে ফেলত এবং নিজেদের সীমিত গণ্ডি পাড়ি দেয়ার হিম্মত জোগাত। ফলে আমরা স্বপ্ন দেখতে পারতাম, ভালোবাসতে পারতাম। শ্রদ্ধা দেখিয়ে কৃতজ্ঞ থাকতে পারতাম। উপরোক্ত বহুবিধ কারণে এবং ফ্রয়েডের স্বপ্নতত্ত্বের জটিল রসায়নে আমি আমার কিশোরবেলায় মহামান্য রানীকে স্বপ্ন দেখার পর থেকে তার প্রতি একধরনের মরমি শ্রদ্ধাবোধ কাজ করত। এ দেশে ব্রিটিশদের শোষণ কিংবা রাজপরিবারের হাজারো স্ক্যান্ডাল সত্ত্বেও স্বপ্নযোগে রানীর অভ্যর্থনা এবং নৈশভোজে আপ্যায়নজনিত কৃতজ্ঞতার কারণে তার মৃত্যু আমাকে নিদারুণভাবে ব্যথিত করেছে। তার অসংখ্য ভিডিও ফ্লিপ, হিউমার, সংযত জীবনযাপন, রাজনৈতিক-পারিবারিক লড়াই সংগ্রাম ইত্যাদির বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংবলিত ভিডিও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে বারবার চোখের সামনে চলে আসছে। আমি তার কর্মকাণ্ড যত দেখি ততই তার অভাব যেমন অনুভব করি তেমনি অনিবার্য মৃত্যু এবং আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার কাছে পৃথিবীর সব ক্ষমতা যে কতটা অসহায় তা ভাবতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement