২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জ্ঞান ও আপন বোঝাপড়া

-

জ্ঞান ও বিশ্বাস
বিশ্বাস ছাড়া জ্ঞান হয় না। লিখেছিলাম ডায়েরিতে। আমার মধ্যে তর্কবাজ কেউ বসবাস করে। সে প্রশ্ন করল, তবে কি অবিশ্বাসী জ্ঞানী পৃথিবীতে নেই? বললাম, নেই।

জ্ঞানীর অবিশ্বাসী হওয়া আর পাথর থেকে সোনার বাটি তৈরি এক কথা। কারণ জ্ঞান বিশ্বাসের ফসল।
কিভাবে জ্ঞান অর্জিত হয়? মনের ধারণার সাথে বাইরের বস্তুর মিল আর মিলের ওপর মানুষের বিশ্বাস মনে জ্ঞানের উদ্ভব ঘটায়।

জ্ঞান অর্জিত হবার যে ধারা, এর শুরুতে মনের মধ্যে এক বা একের অধিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়ে ধারণার জায়গা তৈরি হয়। এরপর ধারণার বিষয়টির সাদৃশ্যমূলক অবস্থান দেখতে হয় বাইরের জগতে। এর পরের ধাপে যখন উভয়ের সাদৃশ্যের বা বৈসাদৃশ্যের বিশ্বাস মনে জন্ম নেয়, সেটা রূপান্তরিত হয় জ্ঞানে। যতক্ষণ ধারণা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের ফসলরূপী বিশ্বাসে স্থিত না হলো, সে জ্ঞান হতে পারল না!

বিশ্বাস যখন নেই, জ্ঞানের সঞ্চয় অসম্ভব।

মনে করুন, সাপ দংশন করে, এমন একটা ধারণা প্রথমে মনে জায়গা পেল। ধারণার সাথে বাইরের জগতে সাপ, দংশন ও দংশিতের মধ্যে সম্পর্ক যথার্থ প্রমাণিত হলে ধারণার বিষয় ও বাইরের বাস্তবতা সম্পর্কে মনে বিশ্বাস জন্মাবে। এ বিশ্বাস ধারণাকে জ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে গেল।

ধারণা, যা আপনাকে বিচলিত, বিভ্রান্ত ও বিহ্বল করত, বিশ্বাসের হাত ধরে সে জ্ঞানের আলোতে পরিণত হলো। আপনাকে নিশ্চিত বাস্তবতায় প্রশান্ত করল। বিশ্বাস দিলো জ্ঞানের পরিণতি। প্রতিটি জ্ঞানে এবং সিদ্ধান্তে মূল নায়কের কাজ করে বিশ্বাস!

কিন্তু বিশ্বাস মাত্রই জ্ঞানের জননী নয়। পরীক্ষা ও যাচাইবিহীন যে বিশ্বাস, সত্য ও তথ্যের যথার্থতা বর্জিত যে বিশ্বাস, সে জ্ঞানের সহযাত্রী নয়। যেমন, কেউ বিশ্বাস করে চাঁদে বুড়ি আছে। সে চাঁদের দেশে গাছতলায় বসে তাঁত বোনে। মনে লালন করা এমন বিশ্বাস যখন বাইরের জগতের বাস্তবতার সাথে মিলযুক্ত নয়, এ বিশ্বাস মনের অন্ধত্বমাত্র।

একে কি বিশ্বাস বলা যায়? প্রকৃত প্রস্তাবে সে এক ধারণামাত্র। কোনো যথার্থতা তার পক্ষে কথা বলছে না। অতএব এটি কুসংস্কার। কুসংস্কারে সমাজ থই থই করলেও এ সমাজে জ্ঞান আছে, বলা যাবে না। ধারণাকে বিশ্বাসের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যথার্থতার যে সাক্ষ্য, তা শোনেনি বা শুনতে চায়নি এ সমাজ। যথার্থতার সাক্ষ্য শুনলে সে বিশ্বাসের নিশ্চয়তায় স্থিরতা পেতে হতো এবং কুসংস্কারের জায়গা থেকে জ্ঞানের জায়গায় সমাসীন হতো। বহু ভ্রান্ত ধারণা, যা বিশ্বাসের মতো করে তার মনে আসন পেতে আছে, তা উধাও হয়ে যেত ক্রমে ক্রমে। বিশ্বাসের আলোকময় এক দরোজা আরেক উদ্ভাসিত দরোজার দিকে তাকে নিয়ে যেত। সে অনবরত জ্ঞানের নতুন নতুন রশ্মিপাতে উজ্জ্বল হতে থাকত।

নিরন্তর সে বর্জন করতে থাকত যা জ্ঞান নয়, তাকে। অর্জন করতে থাকত নব নব জ্ঞানের এলাকা। সত্যিকার বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী তাই বিশ্বাসের অবধারিত যে ফসল ঘরে তোলে, সে হচ্ছে নিত্যনতুন জ্ঞান।

বিশ্বাস, তাকে বুঝে নেয়া দরকার। সে কে? এক কথায় তার পরিচয় দেয়া কঠিন। সে এক অনন্য চেতনাধারা, চেতনাদেহ, চেতনাপর্যায়। সে ধারণা অতিক্রমী বাস্তবতা কিংবা বাস্তবতার জীবন্ত ধারণা। প্রকৃত অর্থে বিশ্বাস হচ্ছে, কোনো কিছুর যথার্থ ধারণা। কোনো সত্তার, ঘটনার, বস্তুর বা বাস্তবতার নিশ্চয়তার অনুভূতি। বিশ্বাস মানে সুনিশ্চয় উপলব্ধি বা অভিজ্ঞান।

বিশ্বাসকে নানা অবয়বে দেখা যায়। কখনো সে জ্ঞানমূলক, কখনো অনুভূতিমূলক, কখনো কর্মপ্রবৃত্তিমূলক।
বহু দার্শনিক বিশ্বাসের জ্ঞানমূলক অবয়বকেই প্রকৃত বিশ্বাস বলে রায় দিয়েছেন। যে বাস্তব উপলব্ধি জ্ঞানমূলক, তা তাদের কাছে বিশ্বাস। ডেভিড হিউম, জেমসসহ অনেকেই বিশ্বাসকে অনুভূতির পরিবারের সদস্য মনে করেন। দার্শনিক বেইন কিন্তু বিশ্বাসকে কর্মমূলক বলেই অনড়।

কিন্তু বিশ্বাস কি জ্ঞানবহির্ভূত? বিশ্বাসে কি অনুভূতির যোগ নেই? বিশ্বাসে কি কর্মের অংশীত্ব নেই? কোনোটাই বিশ্বাসের বাড়ির বাইরের নয়। সে আসলে সব উপাদানকে আত্মীকৃত করে। সব মিলিয়েই তার আত্মগঠন।

বিশ্বাসকে খুঁটিয়ে দেখুন। তার শরীরে ধারণার বীজ, জ্ঞানের বীর্য থাকবেই। এক সময় সে ছিল জাগ্রত এক ধারণামাত্র। ধারণা থেকেই সে ধাপে ধাপে লাভ করেছে উত্তরণ। ছায়াপথের ধারণা যদি না থাকত, ছায়াপথে বিশ্বাস অর্জন হতো কীভাবে? একক স্রষ্টার ধারণা যদি মানুষ না পেত, কিভাবে উপনীত হতো বিশ্বাসের বিভূতিতে? কিন্তু ধারণা বা ভাবধারাই বিশ্বাসের একমাত্র হাতিয়ার নয়। তার আরো বহু উপাদান রয়েছে। চিন্তা ও ভাবধারার চেয়ে অনেক বড় বিশ্বাসের পরিসর। সেখানে অনুভূতির ভূমিকাও অনেক প্রশস্ত।

জ্ঞানের ডালপালা
পিপাসায় পানি পান করছিলাম। এক গ্লাস, শেষ হয়ে গেল দ্রুত। পিপাসা রয়ে গেছে। তখনই মনে পড়ল চেতনকে। সে বলেছিল, রহস্যকে পান করো। রহস্য একগ্লাস পানি নয় যে, পান করবে আর ফুরিয়ে যাবে।

চেতন আসলে বাইরের কেউ নয়। আমি নিজেকে বিশ্লেষণ করছিলাম। দু’টি অবয়বে নিজেকে পেয়েছিলাম। একটিতে ছিল রূপ, একটিতে সত্য। আমার মধ্যে যে সত্তা ও সত্য, সে ছিল আত্মা ও চেতনায়। আমার মধ্যে যে রূপ, সে ছিল দেহে, যাপনে, উচ্চারণে। উভয়েই মূলত আমি। প্রথম আমার নাম ছিল চেতন, দ্বিতীয়ের নাম ছিল উচ্চারণ।

চেতন ও উচ্চারণ পরস্পরে তৈরি করেছে ব্যতিক্রমী পাঠশালা। তাদের মধ্যে চলে নানা কথা। বিচিত্র প্রসঙ্গের আলাপ।

সেই ভোরের কথাই ধরা যাক, যখন উচ্চারণ হাঁক মেরে চেতনকে কিছু বলেছিল, চেতনও দিয়েছিল জবাব। তাদের আলাপটা ছিল এমনই :
উচ্চারণ : তুমি আসলে কে?
চেতন : আমি সেই প্রাণ, জ্ঞান ও অনুভূতি, যে তোমাকে কথা বলাচ্ছে
: কিন্তু তুমি কোথায়?
: আমার কারণে দুনিয়া দু’ভাগ হয়ে গেছে। পৃথিবী বিভক্ত হয়ে গেছে বস্তুবিশ্ব আর ভাববিশ্বে। আমি ভাববিশ্বে আছি, তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না! চিনতে পারছ না!!
: তোমাকে দেখছি না যখন, চিনব কেন? মানব কেন? তুমি আসলে মিথ্যা, হেঁয়ালি, কল্পনা।
: তোমার চোখের সীমাবদ্ধতাকে বোঝো, সে বহু জায়গায় অন্ধ। বস্তুজগতের কিছু সে দেখে, কিছু ভুল দেখে। সে ভাবজগতের কিছুই দেখে না। সে দেখে ঘরবাড়ি, মানুষ, পশু-পাখি, নদী-সমুদ্র, আকাশ। কিন্তু সে দেখে না নিজের ভেতরে বিদ্যমান বোধ, অনুভূতি। দেখে না বেদনা, ক্রোধ, দয়া ও করুণাকে। যে প্রেম তার মূলধন, তাকেও সে দেখে না!
: কিন্তু যা দেখি না, তার অস্তিত্ব মানতে হবে কেন?
: জ্ঞানের অস্তিত্ব মানতে হবে বলে।
: জ্ঞান সবসময় বিমূর্ত নয় ...
: কিন্তু তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। যদিও সে আছে চার দিকে ছড়িয়ে। আছে সে দৃশ্যমান সব জীবেই। পশুতে, পাখিতেও আছে জ্ঞান। পৃথিবীতে ৯৯.৯৯ ভাগ মানুষের জ্ঞান হচ্ছে পশুপাখির জ্ঞানের চেয়ে কম। যার অস্তিত্ব এত ব্যাপক, তাকে দেখেছ?
: দেখিনি। কিন্তু তাকে অনুভব করি, তার বিকাশকে উপলব্ধি করি।
: দেখোনি, কিন্তু অনুভব করো। অতএব মানছ, সে আছে। আমাকেও তাহলে অনুভব করতে পারো। আমি আত্মা, আমি মন, আমি জ্ঞান!
: তুমি জ্ঞান কিভাবে?
: জ্ঞানের অনেক ভাব আছে। আছে বহু অংশ। অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, অতিসাধারণ জ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান, বুদ্ধি, অলৌকিক জ্ঞান এবং দর্শন বা দার্শনিক জ্ঞান। এ ছয় অংশকে সহজেই তিনটি ভাগ করা যায়। একটি সহজাত জ্ঞান, একটি অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, একটি আধ্যাত্মিক জ্ঞান। এই সব জ্ঞানে আমরা সকলেই থাকি। আমি তো জ্ঞানে থাকি এবং তুমিও জ্ঞানে আছ। সব জ্ঞানে হয়তো সবাই নেই। কিন্তু যে জ্ঞানে তুমি আছো, সেখানেও আমি আছি।
: কী অর্থ জ্ঞানের এই সব শাখা-প্রশাখার? জ্ঞানের শাখায় শাখায় আমাদের থাকার?
: অর্থ পরিষ্কার। একটি জ্ঞান প্রাণীর জন্মানোর পরে আপনাআপনিই এসে যায়। এর প্রস্ফুটন ঘটে মানব মনে।

জীবনের একান্ত দরকারি কিছু বিষয়- যার জ্ঞান কোথাও, কারো কাছে অর্জন করতে হয় না। এগুলো অভ্যন্তরীণ জ্ঞান, অতিসাধারণ জ্ঞান। এগুলোকেই বলে সহজাত জ্ঞান। এতে তুমি আছো, আমি আছি।

প্রথম ক্ষুধা অনুভব করেছিলাম আমি। ক্ষুধা পেলে খাদ্য লাগে, সেই জ্ঞানে আমি ছিলাম। ক্ষুধা থেকে খাদ্যগ্রহণের সঙ্কেত আমি তোমাকে শুনিয়েছিলাম। তুমি কান্নার আওয়াজে আমার সঙ্কেতকে প্রচার করেছিলে। তুমিও তখন জ্ঞানের মধ্যে ছিলে। ক্ষুধা কিংবা ভয়ের সঙ্কেত পেলেই তুমি কাঁদতে। তুমি শুরু থেকেই জ্ঞানের মধ্যে ছিলে বলেই কাঁদতে, যে জ্ঞানে ছিলাম আমিও। সেটা ছিল সহজাত জ্ঞান।

এই জ্ঞানে মানুষের সাথে আছে প্রাণীরা, পাখিরা, মাছেরাও! মোরগের দু’দিনের বাচ্চাটি কী সহজেই দানা খোঁটে, কী দক্ষতায়! যেন বহু দিন সে কোথাও থেকে তা শিখে এসেছে। এ জ্ঞান নিয়েই সে জন্মায়, একান্ত জৈবিক ও প্রাকৃতিক এই বিজ্ঞতা।

আরেকটি জ্ঞান অভিজ্ঞতালব্ধ। সেটা পরিশ্রম ও প্রয়াসে অর্জন করতে হয়। হয়তো বইপত্র থেকে পড়ে-শুনে তা অর্জিত হয়, নতুবা অর্জন হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। অক্ষরজ্ঞান মানুষ গ্রহণ করে বইয়ের সাহায্যেই। তারপর ক্রমে ক্রমে সে এগিয়ে যায় জানার গভীর জগতে। সে অনেক কিছু শেখে বই পড়ে এবং বাস্তব প্রশিক্ষণ নিয়ে।

সে ইঞ্জিনিয়ার হয়, ডাক্তার হয়, নাবিক হয়, বৈমানিক হয়। অভিজ্ঞতা ও পুঁথিগত বিদ্যার সমন্বয়ে সে দক্ষ হয়। তাকে আমরা দেখি, দক্ষতার প্রয়োগ ঘটাতে। কিন্তু যে দক্ষতা ও জ্ঞান তার শক্তি, সে তো তোমার চোখের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। তুমি সেই জ্ঞানে থাকো না, কিন্তু আমি থাকি।

এর উপরে আরেকটি জ্ঞান আছে- দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক। সেখানে আমার থাকাটাও অবধারিত নয়। কারণ সে জ্ঞান শুধু পাঠ ও প্রশিক্ষণে হয়ে ওঠে না। সে জন্য লাগে বিপুল সাধনা। এ জ্ঞান রহস্যের জগতের, দৃশ্যের ভেতরের দৃশ্যের, কারণের ভেতরের কারণের।

আমরা যেখানে সীমিত, এ জ্ঞান অবারিত; আমরা যেখানে থেমে যাই, এ জ্ঞান উড়তে থাকে; আমরা যেখানে অন্ধকার দেখি, এ জ্ঞান সেখানে স্বতন্ত্র আলোতে পরিণত হয়। বাইরের চেয়ে ভেতরের অন্তর্তলে বিদ্যমান সত্যকে উন্মোচন করতে চায় এ জ্ঞান। সেখানে দেখা বিষয় আর না দেখা বিষয়ের পার্থক্য অনেক কম। আমরা যত কিছু দেখি, সেখানে দেখার বিষয় আরো বেশি, আরো বিপুল। আমরা অনেক কিছু দেখি না, কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চোখ সেসব দেখে। দার্শনিক দৃষ্টি তাকে উন্মোচন করে।

সেখানে আজকের দৃশ্যের মতো আগামীকালও অনেক সময় হয় দৃশ্যমান। যাকে তুমি ভাবছ, অদেখা, সে হয়তো তোমার জ্ঞানের প্রথম বা দ্বিতীয় স্তরের সিদ্ধান্ত হতে পারে। হয়তো তৃতীয় স্তরে তুমি তাকে দেখতে পেতে একেবারে জীবন্ত বাস্তবতায়!

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement