২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

তখন হবে কেবলই অরণ্যে রোদন

লেখক : সালাহউদ্দিন বাবর - ফাইল ছবি

শিল্পী, কবি, কথাশিল্পী সবার মনকে আন্দোলিত করে প্রকৃতি, পরিবেশ ও ঋতুচক্র। এ দেশের সাহিত্য-শিল্পের এক বড় অংশই এসব ঘিরে রচিত। ষড়ঋতুর দেশ হিসেবে এ দেশকে এক বিশিষ্ট স্থানে নিয়ে গেছে তা। বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। বাংলা ভাষার অপর প্রধান কবি, কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে বরণ করে নিয়ে এই জনপদ ধন্য হয়েছে। এই দুই মহান কবিসহ এ দেশের অসংখ্য কবি, গীতিকার, কথাশিল্পী ও ছড়াকার এই ভূখণ্ডের প্রকৃতি, পরিবেশ, ষড়ঋতু শুধু বরণ নয়, রীতিমতো বন্দনা করে অনবদ্য সব গান-কবিতা-ছড়া লিখে পাঠকদের হৃদয়ে সুর-ঝঙ্কার সৃষ্টি করেছেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে প্রকৃতি-পরিবেশ জলবায়ু নিয়ে এতটুকুই বোধ অনুভূতি যে, আমরা এখন খুব গরম অনুভব করছি।

হাড়কাঁপানো শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি, বৃষ্টিতে ভিজে জবুথবু হয়ে পড়েছি। অথচ কবি, শিল্পী যারা, তারা শীত, বর্ষা, বসন্তের প্রকৃতির বিচিত্র রূপ ফুল-ফল, বর্ণ-রঙে হৃদয়ের তন্ত্রীতে এক অনবদ্য, সুর-সুধা-আবেগ অনুভূতির সৃষ্টি করে যান। শীতে ঘাসের ডগায় জমে থাকা এক বিন্দু শিশির, শিল্পী-হৃদয়ের আনন্দ ভুবনে ভিন্ন শিহরণ জাগায়। বর্ষার অবিরাম বারিধারা তাদের গানে কাব্যে বাক্সময় হয়ে উঠে পেখম মেলা ময়ূরের মতো নাচন ধরায়। তাদের চিত্তে জলতরঙ্গের লহরী অনুরণিত হয়। এমন চিত্তের উল্লাস আনন্দ তারা একাই উপভোগ করেন না। তারা গীত-গান-কাব্যে-গদ্যে সেই অনুভবের প্রকাশ ঘটিয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেন। সেসব পঠিত হয়, কণ্ঠে তুলে নিয়ে অনাবিল সুখ-আনন্দে মানুষ পুলকিত, শিহরিত হয় এমন অপরূপ গীত-কাব্য-গদ্যে স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়তে জাগরণ ঘটায়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের গান, ‘আহা আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে এত পাখি গায় আহা আজি এ বসন্তে।’ বর্ষা নিয়ে বিশ্বকবির আর কবিতা, ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমনই ঘন ঘোর বরিষায়। এমন দিনে মন খোলা যায়- এমন মেঘস্বরে- বাদল-ঝরঝরে তপনহীন ঘন তমসায়।’ আমাদের জাতীয় কবি নজরুল বসন্ত নিয়ে লিখেছেন, ‘এল ঐ বনান্তের পাগল বসন্ত, বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে, চঞ্চল তরুণ দুরন্ত। বাঁশিতে বাজায় সে বিধূর গরজ-বসন্তের সুর। কবি বর্ষায় লেখেন, রিমি ঝিম রিমি ঝিম ঐ নামিল দেয়া শিহরে কদম, বিদরে কেয়া, ঝিলে শাপলা কমল, ওই মেলিল দল।

বাংলাদেশের আশির দশকের কবি মুজতাহিদ ফারুকী লেখেন, ‘সেদিন শ্রাবণ ছিল ঘোর/পৌরাণিক কোনও বিরহিণী, জানালায় রেখেছিল পিপাসিত চোখ/ যদি আসে মেঘদূত, প্রিয় দূর প্রবাসীর শুভবার্তা নিয়ে/ পুরানের সীমানা পেরিয়ে, আমরা ভিজেছি ধারা জলে/ মেতেছি কাঁদুনে মেঘে ব্যাঙের কোরাসে।’ আমাদের নব্বই দশকের কবি জাকির আবু জাফরের কবিতায় বসন্ত বর্ষা এভাবে ধরা দিয়েছে, ‘বৃষ্টি যখন বাংলাদেশের নিত্যদিনের সুর/ বৃষ্টি যখন তালপুকুরে গড়ে সমুদ্দুর;/ শহর নগর গাঁও-গেরামে বৃষ্টি ঝরা দিন/ সকাল দুপুর বৃষ্টি নূপুর রিমঝিনা ঝিন ঝিন।’ বসন্ত নিয়ে কবি জাফরের কবিতা ‘বসন্ত মেয়ের ঠোঁটে এত রঙ এত পৌর উজ্জ্বলতা/ নাগরিক জীবনেও উড়িয়েছে সৌমের সারথী/ শীতের বাজার পেরিয়ে বৃক্ষের পাতায় নিজেকে সাজিয়ে, বেশ স্মার্ট হয়েছে মেয়েটি।’

বিশিষ্ট ছড়াকার আহমদ মতিউর রহমান বর্ষা নিয়ে লিখেছেন, ‘ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে জুলাই এলো ঐ, মাগো আমার বৃষ্টি ধোয়া, আষাঢ় গেল কই? আষাঢ়-শ্রাবণ নামায় প্লাবন বৃষ্টি ভেজা গাঁও/ সেই গাঁয়ের হিজল চকে, ঠাণ্ডা পুবাল বাও।’ অথবা তার আরেক ছড়া, ‘জ্যৈষ্ঠ শেষে আমার দেশে বর্ষা যখন আসে, বিলের জলে শাপলা-রানী খিলখিলিয়ে হাসে/ ছলাৎ ছলাৎ নৌকা চলে, কলমী লতার পাশে/ ঝম ঝম ঝম হঠাৎ করে, বৃষ্টি নেমে আসে।’

ষড়ঋতুর এই দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত বসন্তের যে বৈচিত্র্য বা ছয়টি রূপে এ দেশের মাটি ও প্রকৃতি যেভাবে নিজেকে সাজিয়ে তুলতো, এখন আর কী সেটা লক্ষ করা যায়! আজ কি বর্ষা ঝমঝমিয়ে নামে, বসন্তে কী কোকিলের কুহু কুহু সুর কানে ভেসে আসে, বসন্তে ফুলে ফুলে অপরূপ শোভা মানুষের চিত্তে বর্ণছটা একে যায়? সম্ভবত না।

যাই হোক, বাংলাদেশের জলবায়ু কিভাবে কতটা বদলেছে তা নিয়ে বড় পরিসরে পযর্পবেক্ষণ গবেষণা সেভাবে নেই বটে- তবে এখন সিলেট অঞ্চলও তাপদাহে নাকাল হয়; অপর দিকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ অঞ্চলে শীতের হাওয়া বেশি। আবার অকাল বৃষ্টিতে ফসলহানি ও বাঁধ ভেঙে বন্যায় প্লাবিত করে লাখ লাখ হেক্টর এলাকা। এ দিকে ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে দেখা গেছে দেশের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন বলছে, গেল আগস্ট মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টি কমেছে ৩৬.৪ শতাংশ। এর আগে জুলাই মাসে প্রায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলেছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসেও দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের অতীতকালের জলবায়ুর যে স্বাভাবিক ছন্দ ছিল তার প্রেক্ষিতে দেশে কবি-গদ্যশিল্পী ও ছড়াকার সঙ্গীতজ্ঞদের হৃদয়-মনে যে সৃজনশীলতা ছিল, সে কারণে কালজয়ী সব সাহিত্য সঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে। বিগত সময়ের প্রকৃতিই বস্তুত সাহিত্যসেবীদের মনকে রাঙিয়েছে, চিত্তচাঞ্চল্য জাগিয়েছে, উদ্বেলিত করেছে। তাতে ফল্গুধরারার মতো সৃজিত হয়েছে অনুপম সব কাব্যগান।

আজ কি প্রকৃতির সেই ধারা বজায় আছে? না নেই, কিছু মানুষ, যারা শুধু বোঝে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ। তাদের অপকর্মের জেরে গোটা বিশ্বের পরিবেশ প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে প্রলয়, সেই প্রলয় সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখোমুখি নিয়ে এসেছে। এই ধ্বংসযজ্ঞে কতিপয় খল-নায়কের অপকর্ম এখনও থেমে নেই। এদের মনে কোনো ভয় ডর নেই। ধ্বংস অনিবার্য জেনেও তারা জীবনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ। তারা হয়তো একান্ত স্বার্থপরতার কাছের আত্মসমর্পিত, ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মের কী হবে তা ক্ষণকালের জন্যও ভাবার সময় তৈরি করে নিতে পারছে না। হায়রে মানব সভ্যতার নিয়তি। জানি না স্রষ্টা তার অপরূপ সৃষ্টি এই বিশ্বটাকে ধ্বংসের জন্য এদের কোন নরকের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করবেন! বিশ্বের শত শত কোটি মানুষ, জীববৈচিত্র্য, প্রাণিকুলের জীবন নিয়ে কী নৃশংস খেলাই না তারা খেলছে! এসব দেখে শুনে কোনো স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। মন ও দেহের বৈকল্য আসতে বাধ্য; যদি না সে অমানুষ হয়।

মানুষ আর পশুর মধ্যে অনেক পার্থক্যের মধ্যে মানুষের চেতনা, মনোজগতে একটা বিরাট অনুশীলন চলে ও বোধের ব্যাপার থাকে। অপর দিকে পশু শুধু উদরপূর্তিতে সন্তুষ্ট, কিন্তু মানবসত্তা কেবল তাতে নয়; চিত্তের তুষ্টি ও সন্তুষ্টি তার কাছে এক বড় বিষয়। আজকে মানবকুলের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে চিত্তের বিকাশে ভয়াবহ বিপত্তি এসে উপস্থিত হয়েছে। এভাবে মানুষ তো আর রোবটের মতো হয়ে যেতে পারে না। এখন মানুষের কষ্টের সাথে ফুলফলের বৃক্ষ আর গুল্মলতাও পানি সিঞ্চন না পেয়ে শুকিয়ে জ্বালানির খড় কঞ্চিতে পরিণত হতে চলেছে।

মানুষ আরো অবাক হচ্ছে, আমাদের প্রিয় জনপদ এখন জলবায়ুজনিত সমস্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এর প্রতিকার করতে কেউ এগিয়ে আসছে না, যাদের দায়িত্ব তারা যেন মগ্ন মৈনাকের মতো গভীর ঘুমে অচেতন। তাদের ঘুম কোনোভাবেই ভাঙছে না। অথচ তারা এই সমস্যা সম্পর্কে আজ বিবেচনায় না নিলেও পঞ্চাশ বছর আগে এ দেশের সংবিধান যারা রচনা করেছেন, তারা কিন্তু এ দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন এবং প্রতিবিধানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।

সংবিধান থেকে সংশ্লিষ্ট সেই ধারাটি উদ্ধৃত করলে তা স্পষ্ট হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি শীর্ষক অধ্যায়ের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভ‚মি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এমন স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকার পরও আমাদের যথাযথ কর্তৃপক্ষ কেন যে হাত গুটিয়ে রেখেছে, সেটি বোধগম্য নয়। সময় ফুরিয়ে গেলে আর আক্ষেপ করে কোনো ফায়দা হবে না, তখন সেটি হবে কেবলই অরণ্যে রোদন।
ndigantababar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement