মুঠোফোন ছিনতাই ও জাপার বিরোধ
- ড. মাহবুব হাসান
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:৩১
জাতীয় পার্টির প্রধান ও জাতীয় সংসদে জাপার উপপ্রধান নেতার মুঠোফোন (সেল্যুলার ফোন) ছিনতাই হয় গত ৩১ আগস্ট হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালের সামনে থেকে। তীব্র যানজটের কারণে গাড়ি আটকে থাকায় জানালা খুলে রেখে অপেক্ষায় ছিলেন জি এম কাদের কখন এই অসহনীয় যানজটের অবসান ঘটে। এমন সময়ই ছিনতাইকারী জি এম কাদেরের হাতে থাকা সেল্যুলার ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। তাকে অনেকে ধাওয়া করলে ছিনতাইকারী একটি ফোন ফেলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জানা যায়, ছিনতাইকারীর ফেলে দেয়া ফোনটি জিএম কাদেরের নয়। অর্থাৎ ছিনতাইকারীর উদ্দেশ্য যে অন্য কিছু সেটি বোঝা যায় জি এম কাদেরের ফোন নয়, ফেলে গেছে অন্য একটি ফোন। তার প্রয়োজন জি এম কাদেরের ফোন।
ছিনতাই নাটকের প্রথম রহস্য এখানে। আর দ্বিতীয় রহস্য লুকিয়ে আছে পুলিশের ব্যর্থতার মধ্যে। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও জি এম কাদেরের সেল্যুলার ফোন উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। সেটি উদ্ধার করতে পুলিশের এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে। তাদের এই ব্যর্থতার পেছনেও আছে রহস্য ও পুলিশ যে কর্মদক্ষ নয়, তাদের যে আরো ট্রেনিং প্রয়োজন জনগণকে সেবা দেয়ার জন্য, তাদের ল্যাকিংসের বহু খাত যেমন আছে, তেমনি অমানবিক/অস্বাভাবিক আচরণের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পথ ধরেই তারা নিজেদের বাহিনীকে দুর্নামের ভাগীদার করছে, সেটি বুঝতে কষ্ট হয় না। যদিও সেল্যুলার ফোন উদ্ধারে তাদের কৃতিত্বও আছে।
গত বছর ২৫ মে রাজধানীর বিজয় সরণিতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের মুঠোফোন ছিনতাই হয়। ছিনতাইয়ের সময় পরিকল্পনামন্ত্রীর গাড়ির জানালা খোলা ছিল। ঘটনার দেড় মাস পর একটি ছিনতাইকারী চক্রের কাছ থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। এই রিপোর্টের প্রথম অংশটি ভালো, কিন্তু দ্বিতীয় অংশের কোনো নমুনা নেই। একটি ছিনতাইকারী চক্রের কাছ থেকে দেড় মাস পর পরিকল্পনামন্ত্রীর ফোন উদ্ধার করলেও পুলিশ সেই চক্রের সদস্যদের আটক করেনি বা করে থাকলেও তাদের নিয়ে কোনো তথ্য নেই। আমরা জানতে পারছি না, ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা কেন পুলিশের হাতে আটক থাকছে না। কীভাবে ও কোন কৌশলে ওই ছিনতাইকারীরা আটকাবস্থা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ও যায়। আমরা প্রায় প্রতিদিনই দেখতে ও জানতে পারছি- পুলিশ, র্যাব বিভিন্ন অপরাধের আসামিদের আটক করছে। এই ভালো সংবাদের পেছনে লুকিয়ে থাকে আরো কিছু প্রশ্ন। তা হলো, ওই যুবকরা কেন এরকম একটি অপরাধে নিজেদের জড়াচ্ছে। পুলিশ-র্যাব তাদের আটক করছে, কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যে এমন ভয় জাগছে না কেন যে, ওই রকম অপরাধের জন্য সামাজিকভাবে তারা চিহ্নিত ও অপরাধী মানুষ হবে এবং ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
এই প্রশ্নটি কেবল তাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। এই প্রশ্নটি সমাজের সেসব দুর্নীতিপরায়ণ মানুষদের জন্যও তীব্রভাবে খাটে, যারা লাখ লাখ টাকা থেকে শুরু করে শত শত কোটি টাকা বা লাখো-কোটি টাকা লুটে নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। পি কে হালদার তাদের একজন এখন আলোচিত অপরাধী। বিদেশী পুলিশের হাতে আটক ও দেশে তার বিচার চলছে। দেশেও বিচার শুরু হয়েছে। যারা রাষ্ট্র ও পুলিশের হাতে ধরা খায়নি তারাও যে মানসিকভাবে ওই সব লুটেরা চোরদেরই অংশ বা ওই ছিনতাইকারীদেরই নেতা, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? সমাজ নিয়ে যারা ভাবেন, যারা গবেষণা করেন, এ রকম অপরাধীদের মনস্তত্ত¡ নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন, করা উচিত সরকারের তাগিদে। সরকারের উচিত এর সব অপরাধের কার্যকারণ খুঁজে দেখা। জনগণের সম্পদ লুটে নেয়ার পেছনে রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা আসলে কি?
২. দেখুন, জি এম কাদেরের সেল্যুলার ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনার সাথে আমার আলোচনা কোথায় এসে বাঁক নিয়েছে। আসলে সমাজ-সংসার-রাজনীতি-শাসন পদ্ধতি, প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন সবই একই কাঠামোর সাথে ওৎপ্রোত। তাই কান টানলে মাথা আসে বলে যে সামাজিক বাক্যটি প্রচলিত, তা কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে সচল ও সক্রিয়। রাজনীতির প্রবহমান ধারা থেকেই আমরা রাজনীতির চোরাস্রোতের (আন্ডারকারেন্ট) সন্ধান পাই বা পাচ্ছি। জাতীয় পার্টির প্রধান ও পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং অভিভাবকের মধ্যে একটি বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের প্রধান রওশন এরশাদ এমপি অতিসম্প্রতি দলের জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেছেন। তিনি আহ্বায়ক ও ছয় জন কো-আহ্বায়কের নাম জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন সংবাদপত্রগুলোতে। রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ওই প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। যে ছয়জনের নাম দেয়া হয়েছে সহ-আহ্বায়ক হিসেবে, তারা সবাই অস্বীকার করেছেন বিষয়টি। বলেছেন, তারা কিছুই জানেন না। তাদের কিছু জানানো বা আলোচনাও করা হয়নি।
আমাদের রাজনীতিতে স্বীকার করার সাহস সাধারণত দেখা যায় না। কারণ ওই সব লুকোছাপার পেছনে আছে ষড়যন্ত্র। রওশন এরশাদ এখনো সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। তিনি বহু দিন সংসদে আসতে ও তার দায়িত্বও পালন করতে পারছেন না। সেটি না পারলেও তিনি দলের জাতীয় সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন নিজেই প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হয়ে।
কীভাবে সেটি হলো? বোঝা যায় ইনঅ্যাক্টিভ একজন অভিভাবকের এভাবে তৎপর হয়ে উঠার পেছনে আছে অন্য কোনো রাজনৈতিক খেলা। আমরা দেখতে পাচ্ছি- জ্বালানি, খাদ্যপণ্য নিয়ে জাতীয় পার্টি তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য জ্বালাময়ী বক্তৃতায় না জানালেও, তারা যে ক্ষুব্ধ দেশের জনগণের জন্য তা তারা জানাচ্ছে সরকারকে। দেশব্যাপী তাদের নেতাকর্মীদের মধ্যে তুমুল আলোচনা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে, তার লাগাম টেনে ধরতে না পারার জন্য, সেটিই সমস্বরে জানাচ্ছে জনগণকে এবং তারা অনেকটাই সরকারবিরোধী যৌক্তিক কথা বলছে। তারা দেশের আপামর জনগণের কথা বললেও বিশেষভাবে দুর্দশাগ্রস্ত মেহনতি মানুষের দুঃখের কথা বলছে। অর্থনৈতিক ধসের কিনারে এসে পড়েছে সরকারের অতি আত্মকেন্দ্রিক প্রচারণা ও বানোয়াট, ফাপানো বর্ণনায়। রিজার্ভ দিন দিনই কমে আসছে। কিন্তু তা স্বীকার করছে না সরকার। সরকারের ব্যর্থতার নানা চিত্র তুলে ধরে জাতীয় পার্টি যেন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে রাজনীতিতে। তারা আর সরকারের লেজুড়ে খেলতে রাজি নয়। আগামী বছর জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দলও গুছিয়ে তুলছেন জি এম কাদের। বিভিন্ন রিপোর্ট পড়ে মনে হচ্ছে, তারা স্বতন্ত্র সক্রিয় ও তৃতীয় বড় দল হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাইছে। তাদের দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংগঠন তো আছেই, তাকে সক্রিয় করে তোলাই হচ্ছে রাজনৈতিক কীর্তি। জি এম কাদের সেই পথেই হাঁটছেন। জাতীয় পার্টিও সরকারের সমালোচনা ও ব্যর্থতার চিত্র বিএনপির মতো তীব্র ভাষায় না করলেও, তারা যে রাজনৈতিক শক্তি সেটি বুঝিয়ে দেয়ায়, সরকারের টনক নড়েছে। চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদকে তাই ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের আয়োজনের এই উদ্যোগ। গোলাম মসীহ যে এই খেলার নাটের গুরু, সেটি না বললেও চলে। তিনি কেবল হুকুমের দাস বা হুকুম তামিল করার লোক। রাজনৈতিক সচিবের কাজই এটি। এটি খুব ভালো জানেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন। আরো জানতেন বিএনপির হারিস চৌধুরী। কিন্তু রওশন এরশাদ কি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্যক জানেন, যখন তিনি বিদেশে হাসপাতালের বিছানায়?
এখানেই রাজনীতির একপালা গান রয়েছে। আর সেই গানের পেছনে আছে জি এম কাদেরের সংসদীয় দলের প্রধান হওয়ার সিদ্ধান্ত। দলের নীতিনির্ধারণী পরিষদ প্রেসিডিয়ামে ও সংসদীয় দলের সব সদস্য সর্বসম্মতিক্রমে জি এম কাদেরকে তাদের সংসদনেতা হিসেবে মনোনীত করেছেন। জি এম কাদের যেহেতু দলের প্রধান, একটি অলঙ্কার হিসেবে এরশাদের স্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদকে সংসদীয় দলের প্রধান করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তো ভোকাল নন। তিনি অনেকটাই সরকারের লেজে লেজে খেলেছেন। এ কারণে দলটি তার রাজনৈতিক ইমেজ সৃষ্টি করতে পারছিল না। একটি রাজনৈতিক দলের মৌলিক ইমেজ আমাদের দেশে নিজের রাজনৈতিক আদর্শের আলোকে অ্যাক্ট করানো। কিন্তু এ কাজে, সংসদে রওশন কোনো ভ‚মিকাই নেননি বা নিতে চাননি। তিনি সরকারের গুণ গাইতেই পছন্দ করতেন। এতে করে সরকার মনে করত রওশন তাদেরই কৃতকর্মের সহায়তাকারী মাত্র।
রাজনৈতিক বলটি এখান থেকেই ক্যাচ করেছে কোনো ইনভিজিবল খেলোয়াড়। কে তিনি? এই খেলার সাথেই কী জড়িত জি এম কাদেরের সেল্যুলার ফোন ছিনতাইয়ের বিষয়টি? কারা জানতে চায় জি এম কাদেরের টেলিফোনিক তথ্য-উপাত্ত? সরকার চাইলে অপারেটরদের নিয়োগ করলেই তা পারে? যদি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি চায়? তিনি ক্ষমতার সাথে জড়িত কিংবা ডিটাচড। সে কারণে একটি বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানের সেল্যুলার ফোন ছিনতাই করে নিয়ে সেটি রেখে ভিন্ন একটি ফোন ছুড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে ছিনতাইকারী? বোঝা যাচ্ছে, রাজনীতিতে ক্রিমিনালজির অনুপ্রবেশ ঘটছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা