২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সময়-অসময়

কারাগার : টর্চার সেল না কি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান?

কারাগার : টর্চার সেল না কি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান? - ছবি : সংগৃহীত

জীবনে বহুবার বিভিন্ন সময়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে আমি কারাবন্দী ছিলাম। ছাত্র অবস্থায়ই কারাবরণের অভিজ্ঞতা। তা ছাড়াও অভিজ্ঞতা রয়েছে বিভিন্ন কারাগারে কারাবাস, তন্মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পুরাতন ও নতুন জেলখানা, ঢাকা সেন্ট্রাল জেল, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল জেল, কাশিমপুর কারাগার (গাজীপুর) উল্লেখযোগ্য। সে অভিজ্ঞতা থেকেই জেলের অভ্যন্তরে কারাবন্দীদের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরাই এ আর্টিকেলের মুখ্য বিষয়। তবে কেন এই কারাগার সিস্টেম তা এবং পর্যায়ক্রমে এর ক্রমবিকাশের ইতিহাসের ওপরও আলোকপাত করা বাঞ্ছনীয়। কারাগার সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা ও বাস্তবতা কতটুকু সমান্তরাল সেটাও পর্যালোচনার বিষয়।

অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার একটি প্রাচীনতম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হচ্ছে কারাগার। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবন চর্চা থেকে সামাজিক অনুশাসনের জন্ম নেয়। এসব নিয়ম-নীতি ভঙ্গের ফলস্বরূপ রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। অতীতে সেই শাস্তির প্রকৃতি ছিল বর্বর, নৃশংস ও অমানবিক। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে শাস্তিপ্রদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন করার দাবি দীর্ঘদিনের। আদি মানবগোষ্ঠীর সমাজপতিদের প্রদত্ত বিধান মোতাবেক পাথর নিক্ষেপে লোমহর্ষক মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে ফরাসি সম্রাটের গিলোটিন, নাৎসীদের গ্যাস চেম্বার, সামন্তবাদী বাদশাহী আমলের ভূগর্ভস্থ অন্ধকার প্রকোষ্ঠ বা নিঃসঙ্গ দ্বীপান্তর, বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করে হত্যা, নিজ হাতে বিষপানে হত্যা- এসব নিষ্ঠুর শাস্তি প্রদান প্রক্রিয়া চলে এসেছে বহুকাল ধরে যার সর্বশেষ রূপ হচ্ছে বিপথে পরিচালিত মানব সন্তানদের চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখার সুসংহত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যার নাম কারাগার।

কারাগার বলতে বন্দীদের আটক বা আবদ্ধ রাখার জন্য সাধারণ বা বিশেষ সরকারি নির্দেশের অধীনে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে ব্যবহৃত কোনো জেলখানা বা স্থানকে এবং ওই স্থানসংলগ্ন সব জমি, দালান ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামোকে বুঝায়।

ভারতীয় উপমহাদেশে কারাগার সৃষ্টির ইতিহাস
ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলের প্রাথমিক অবস্থায় তদানীন্তন পাক-ভারত উপমহাদেশে আধুনিক কারাগার প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। এর আগে আরবদের সিন্ধু বিজয় হতে ইংরেজদের ভারত আধিপত্য বিস্তার পর্যন্ত মুঘল, সুলতানী কিংবা নবাবী আমলে অপরাধীকে সীমাবদ্ধ পরিসরে আটক রেখে শাস্তি প্রদানের সুপ্রতিষ্ঠিত কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ইংরেজরা তাদের সাম্রাজ্য রক্ষা, বিদ্রোহ দমন ও হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে প্রশাসনকে তাদের মতো করে সুসংহত ও সুদৃঢ় করার মানসে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় কারাগার নির্মাণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারাগারগুলো হলো-
১। প্রেসিডেন্সি কেন্দ্রীয় কারাগার
২। মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
৩। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার
৪। আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
৫। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
কারাগারের শ্রেণী বিভাগ : ১৮৯৪ সালের জেলকোড এর ৬০(ক) ধারায় কারাগারকে নিন্মোক্ত কতগুলো শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে-
১। কেন্দ্রীয় কারাগার
২। জেলা কারাগার
৩। সাব-সিডিয়ারি কারাগার
৪। বিশেষ শ্রেণীর কয়েদিদের আটকার্থে বিশেষ কারাগার
কেন্দ্রীয় কারাগার : কেন্দ্রীয় কারাগার বলতে বুঝায় বিচারাধীন কারাবন্দী, প্রশাসনের আদেশে আটককৃত ব্যক্তি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মৃত্যুদণ্ডসহ নির্ধারিত সময়কাল পর্যন্ত কারাবদ্ধ থাকার দণ্ডপ্রাপ্ত, দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের কারাগার। কেন্দ্রীয় কারাগারকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক কারাগারও বলা হয়।
জেলা কারাগার : জেলা কারাগার বলতে পাঁচ বছর পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দী এবং সকল শ্রেণীর বিচারাধীন বন্দীদের আটক রাখার জন্য ব্যবহৃত কারাগারকে বুঝায়, যা জেলার সদর দফতরে অবস্থিত।
কারাবন্দীদের শ্রেণী বিভাগ : কারাবিধি অনুযায়ী কারাগারে আটক বন্দীদের ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়।
১। সিভিল বন্দী
২। বিচারাধীন বন্দী
৩। মহিলা বন্দী
৪। অনূর্ধ্ব ২১ বছর বয়স পর্যন্ত পুরুষ বন্দী
৫। বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হয়নি এমন পুরুষ বন্দী
৬। অন্যান্য বন্দী
বিচারাধীন বন্দীদের অপর নাম হচ্ছে হাজতি। সেই সব ব্যক্তিকে হাজতি বলতে বুঝায় যারা কোনো উপযুক্ত আদালত বা ফৌজদারি বিচারকার্য পরিচালনাকারী কোনো কর্তৃপক্ষের গ্রেফতারি পরোয়ানা বা নির্দেশের অধীনে আইন অনুযায়ী হাজতে প্রেরিত হয়েছে, কিন্তু এদের বিচারকার্য এখনো শেষ হয়নি বরং প্রক্রিয়াধীন। বিচারের স্বার্থে এসব লোককে আটক রাখা হয়। বিচার চলাকালীন জামিনে বা আদালতের নির্দেশে খালাস পেলে জেল কর্তৃপক্ষ তাদের মুক্ত করে দেবে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তারা ওই সাজার মেয়াদ ভোগ করবে, তবে এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৫(২) অনুচ্ছেদ মোতাবেক তাদের জেলখানায় আটক থাকাকালের সময় বাদ দেয়া হবে।

দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের কয়েদি বলা হয়। কয়েদি বলতে কোনো ফৌজদারি মামলার বন্দীকে বুঝায় যাকে কোনো আদালতের নির্দেশে সাজা ভোগের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদালতের আদেশে উল্লিখিত সময়ের জন্যই শুধু তাকে কারাগারে আটক রাখা যাবে। তার সাজা বাড়ানোর এখতিয়ার কারা কর্তৃপক্ষের নেই। তবে কারা কর্তৃপক্ষের সুপারিশে অনধিক ৩/৪ অংশ সাজা মওকুফ করা যেতে পারে।

কারা বিভাগের সংস্কার : ১৮৩৬ সালে সর্বপ্রথম কারা সংস্কার কমিটি গঠিত হয় এবং ১৮৫৫ সালে কারা মহাপরিদর্শকের পদ সৃষ্টি করা হয়, পরে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিপ্লবের পর ১৮৬৪ সালে কারাগারের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কমিটি গঠিত হয়। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্দেশে মোট তিনটি কারা তদন্ত টিম গঠন করা হয়। এসব তদন্ত টিমের অনুমোদনক্রমে ১৮৯৪ সালে প্রিজন্স অ্যাক্ট অনুমোদিত হয়।

১৮৬৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভারত উপ-মহাদেশে কর্তৃপক্ষের সার্কুলার ও আদেশ দ্বারা কারাগার পরিচালিত হতো। ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস্ অব বেঙ্গল Dr. F. J. Mouat ১৮৬৪ সালে কারাগার সংক্রান্ত নির্দেশনাবলীকে কোডিফাইড করেন। অতঃপর প্রিজন অ্যাক্ট ১৮৯৪, প্রিজন অ্যাক্ট ১৯২০ এবং আইডেনটিফিকেশন অব প্রিজনার্স অ্যাক্ট ১৯২০ আইন দ্বারা কারাগারগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। সময়ে সময়ে উক্ত আইনগুলো মোডিফিকেশন হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৯১ সালে তৎকালীন ভারত সরকার স্যার আলেকজান্ডার ডি ক্যারিডিও এর নেতৃত্বে একটি কারা সংস্কার কমিশন গঠন করেন যা ভারতীয় কারা সংস্কার কমিশন নামে পরিচিত। বর্তমান জেলকোড উক্ত কারা সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়েই গঠিত হয়েছে। পরে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারত স্বাধীন হলে ও দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আমলে তৎকালীন পাকিস্তানি গভর্নর ১৯৫৬ সালে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার এস রহমতুল্লার নেতৃত্বে একটি কারা সংস্কার কমিটি গঠন করেন।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, সাবেক প্রধান বিচারপতি মরহুম এফ কে এম এ মুনিম-এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১৯৭৮ সালে ১৮০টি সুপারিশমালা সরকারের নিকট পেশ করেন। তন্মধ্যে ১১৮টি সুপারিশ আমলে নেয়া হয়েছে এবং ৬২টি গ্রহণ করা হয়নি। ওই কমিটির সুপারিশক্রমে জেল কোডকে আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে ওই কমিটির ১৬টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং কারাবিধির ৩৫২টি ধারা আলোচিত হয়েছে।
২০০২ সালে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে আহŸায়ক করে সাত সদস্যের কারা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। উক্ত কমিটি ৩৯টি সুপারিশ করেছে।

কারাবন্দী ও মানবাধিকার
কারাবন্দীরা আমাদের সমাজেরই মানুষ। কৃত অপরাধের শাস্তিভোগ অথবা বিচারাধীন ব্যক্তির বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্যই তাদের কারাগারে আটক রাখা হয়। শুধু আদালত প্রদত্ত দণ্ডাদেশ বা অন্য কোনো আদেশ ছাড়া একজন কারাবন্দী সবার মতোই অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার ভোগের অধিকারী। সাজা ভোগের কারণে কারাবন্দীদের অবাধ চলাফেরা এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাপর অধিকার প্রদান করা হয় না, কারণ তা না হলে সাজা প্রদানের উদ্দেশ্যই অর্থহীন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া, অন্য অধিকারগুলো যতদূর সম্ভব নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারাবন্দীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যেসব যুক্তি প্রদর্শন করা হয়, তা হলো-
১. মানবাধিকার হস্তান্তরযোগ্য নয়। সব মানুষের জন্য এগুলো বিনা ব্যতিক্রমে প্রযোজ্য।
২. কারাবন্দীদের মানবাধিকার এজন্য সংরক্ষণ করতে হবে যাতে করে মানবাধিকারের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়।
৩. জন্মগতভাবে কেউই অপরাধী নয়। অপরাধ প্রায়ই সমাজব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিফলন। কারাবন্দীদের মানবাধিকার প্রত্যর্পণের মাধ্যমে সমাজ তার ব্যর্থতা সংশোধন করে এবং তাদের সুষ্ঠু সামাজিকীকরণ নিশ্চিত করে।
৪. কারাগারে প্রবেশের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়। মানুষের জন্য স্বাধীনতাহীনতাই বড় শাস্তি, এর সাথে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দ্বারা অধিকতর শাস্তি প্রদানের যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।

৫. একটি সমাজ কতটা সভ্য তা নির্ণয়ের একটি মাপকাঠি হচ্ছে, সেই সমাজ তার অপরাধীদের সাথে কিরূপ আচরণ করে তা পরীক্ষা করা। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে একজন ব্যক্তি যেমন অপরাধ করেছে, সমাজ ওই অপরাধীর অধিকার লঙ্ঘন করে আরেকটি অপরাধ করতে পারে না (উপরোক্ত তথ্য ‘অপরাধ বিজ্ঞান পরিচিতি’ থেকে সংগৃহীত)। প্রতিটি কারাগারের প্রধান গেটে লেখা থাকে যে, ‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। কারাবাসী কতটুকু নিরাপদে আছে এবং তাদের কতটুকুইবা আলোর পথ দেখানো হয়, তা কারাগারে কয়েদি বা হাজতি হিসাবে কারাবাসের অভিজ্ঞতা না থাকলে বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করা যায় না। সরকার বা আমলাদের মুখের বাণী বা কারা কর্তৃপক্ষের প্রতি আদালতের নির্দেশাবলি প্রভৃতির সাথে বাস্তবতার তারতম্য আকাশ পাতাল।

বাস্তবে কারাগার হলো, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আলাদা একটি রাষ্ট্র। কারাগার নামক রাষ্ট্রের রাজা জেলার, জেল সুপার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও তাদের কর্মচারীরা। অধিকন্তু দীর্ঘ সময়ে কারাগারে থাকা সাজাপ্রাপ্ত একটি শ্রেণী থেকে ‘মেট’ নামক একটি অনুগত বাহিনী সৃষ্টি করা হয়, যাদের দায়িত্ব মূলত রক্তচক্ষু দেখিয়ে নবাগত কারাবন্দীদের জেল কর্তৃপক্ষের অনুগত রাখা। বাস্তবতার কারণে কারাগারকে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বললেও ভুল হবে না। কারা উপ-মহাপরিদর্শক পার্থ বাবুর বিরুদ্ধে দুদক আনীত অভিযোগ পর্যালোচনা করলেই এর বাস্তবতা ফুটে উঠবে।

জেলখানার প্রধান ব্যবসা হলো সিট বিক্রির ব্যবসা। সুবিধাজনকভাবে রাত যাপনের জন্য সিট বিক্রির প্রবণতা শুরু হয়। সিট বিক্রি হয় ন্যূনতম এক হাজার টাকা, কারা মেডিকেলে থাকতে হলে প্রতি মাসে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা, ২ মিনিট মোবাইলে কথা বলার জন্য ৫০ টাকা কারা কর্তৃপক্ষকে কারাবন্দীদের দিতে হয়, এক ঘণ্টা কথা বললে দিতে হয় এক হাজার ১০০ টাকা। যাদের টাকা আছে, কারাগারে প্রত্যেক বন্দীর একটি পিসি অ্যাকাউন্ট খোলে, যা চবৎংড়হধষ ঈধংয এর সংক্ষিপ্তায়ন। উক্ত অ্যাকাউন্টে বন্দীর স্বজনরা টাকা জমা দিলে ওই টাকা থেকে বন্দীদের চাহিদা মোতাবেক নগদ মূল্যে উন্নতমানের খাদ্য দেয়া হয় এবং সেখানেও একটি ব্যবসা হয়ে থাকে। যেমন- গরুর গোশতের তরকারি এক হাজার ৩০০ টাকা দরে, রান্না করা একটি ডিম ৬০ টাকা দরে বিক্রি হয়। মাছ প্রতি টু পিস ১০০ টাকা অর্থাৎ বাইরের থেকে দ্বিগুণ বা তিন গুণ দামে মাছ/গোশতের তরকারি বন্দীদের নিকট কারা কর্তৃপক্ষ বিক্রি করে। জেলখানার খাদ্য অনেক নিম্নমানের বিধায় যাদের টাকা আছে তারাই দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে খাদ্য কিনে খাচ্ছে। অথচ যাদের টাকা নেই অসহায়ের মতো তাদের চেয়ে চেয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি নাগরিক আইনের চোখে সমান এবং আইনের প্রটেকশন পাওয়ার অধিকারী। অথচ কারাগারে বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে যাদের টাকা আছে; যাদের নেই তারা ভোগে একটি মানসিক যন্ত্রণায়। বিষয়টি স্বাধীনতার চেতনা ও সংবিধানপরিপন্থী। কারাগারে ডাণ্ডাবেড়ি, হ্যান্ডকাফ, বন্দী এদিক সেদিক করলেই পেটানো, নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এ ক্ষেত্রেও একটি ব্যবসা বিরাজমান। কারাগারে বসেও নেশাজাতীয় দ্রব্যাদি পাওয়ার সংবাদও দেশবাসী জানে যে কারণে জেলারসহ কারারক্ষী জেল খেটেছে।

‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’ এ শিরোনামটির বাস্তবায়ন হোক, এটাই এখন সময়ের দাবি। বিশ্বে উন্নতমানের কারাগারগুলোতে বন্দীদের বিশেষ সুযোগ সুবিধাসহ কাউন্সেলিং ও মোটিভেশনের মাধ্যমে মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলা হয়। চিকিৎসাব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখেছি যে, কারা ডাক্তার নিয়মিত বসে না। যেদিন ডাক্তার আসে সেদিন বন্দীদের লাইন করে বসানো হয় এবং সব বন্দীর জন্যই ‘প্যারাসিটামল’ দুই বেলা। মানুষের জীবন ও সময় অত্যন্ত মূল্যবান। আধুনিক ব্যবস্থাপনায় কারাগার হওয়া উচিত একটি সংশোধনী প্রতিষ্ঠান হিসাবে। কারাগারের থাকা সময়টিতে যদি বন্দীকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষার সুব্যবস্থা করা হয় তবে শুধু বন্দী নয়, তার পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে।

একজন মানুষের খাদ্যের চাহিদার পাশাপাশি বিনোদনের চাহিদা থাকে এবং স্বচ্ছ বিনোদনে বন্দীর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। কারাগারগুলোয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্নত মানের ব্যায়ামাগার ও পাঠাগার কারাগারে স্থাপন করা দরকার। স্বজনরা বন্দীদের সাথে দেখা করতে গেলে সেখানেও একটি ব্যবসা রয়েছে। অফিস কলে বন্দীর স্বজনদের ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। এমনিভাবে বন্দীরা কারাগারে একটি মানসিক টর্চার সেলে দিন নিপাত করছে। এ অবস্থার পরিবর্তন এখন সময় ও মানবতার দাবি।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement