০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

দুষ্টচক্রের কব্জায় বিমানের ওমরাহর টিকিট

দুষ্টচক্রের কব্জায় বিমানের ওমরাহর টিকিট - ছবি : সংগৃহীত

করোনা-পরবর্তী সৌদি আরবগামী বিমানের সব টিকিটের মূল্য গগনচুম্বী। একটি শক্তিশালী দুষ্টচক্র একশ্রেণীর দুর্নীতিপরায়ণ বিমান কর্মকর্তার যোগসাজশে সব টিকিট হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে ওমরাহযাত্রীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশে ডিম, তেল, ওষুধ থেকে শুরু করে সব বিষয় ও সামগ্রীতে সিন্ডিকেটের কালো হাত সক্রিয়। ইবাদতও তাদের কব্জা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সেপ্টেম্বর থেকে সৌদি আরবের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হয়েছে। বিপুলসংখ্যক প্রবাসী ঈদের ছুটি কাটিয়ে ফিরছেন সৌদি কর্মস্থলে। ফলে টিকিটের চাহিদা বেড়েছে কয়েক গুণ। হজ কোটা অর্ধেক করার কারণে ওমরাহযাত্রীর সংখ্যাও বিপুল হারে বেড়েছে। টিকিট ওপেন রেখে আগস্টের ছুটি কাটিয়ে যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে ফিরতে চাচ্ছেন; তারা এখন টিকিট কনফার্ম করতে পারছেন না। স্মর্তব্য যে, পাঁচটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় দুষ্টচক্র ওমরাহ টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিমানের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে জেদ্দা ও মদিনা রুটের সেপ্টেম্বর মাসের ইকোনমি ক্লাসের কোনো টিকিট নেই।

সক্রিয় সিন্ডিকেট টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সৌদি আরবের জেদ্দা ও মদিনা রুটের ৭৫ হাজার টাকার টিকিট বর্তমানে বিক্রি করছে এক লাখ ৩৬ হাজার থেকে এক লাখ ৮০ হাজার টাকায়। ওমরাহ যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় নিয়মনীতি ভঙ্গ করে অগ্রিম বুকিং দেখিয়ে এ দুই রুটের সেপ্টেম্বর মাসের সব টিকিট ব্লক করেছে পাঁচ-ছয়টি ট্র্যাভেল এজেন্সি। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটে জড়িত আছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ সিন্ডিকেটে টিকিট দুর্নীতিতে দুই বছর আগে বরখাস্ত একজন কর্মকর্তা অন্যতম ভূমিকা রাখছেন বলে দাবি করেছে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের-আটাব নেতারা। আটাব মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ বলেন, দেড় মাস আগে বিমানের সৌদি আরবগামী সেপ্টেম্বরের সব টিকিট বিক্রি হওয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। বিমানের সৌদিগামী ফ্লাইটের নামহীন সব অবৈধ টিকিট বাতিল করতে হবে। সরাসরি এজেন্সির কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা নিতে হবে। ওমরাহযাত্রীদের চাপ কমানোর জন্য ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু করতে হবে (ইত্তেফাক, ২৭ আগস্ট, ২০২২)।

বর্তমানে বিমানের টিকিট কাটতে নির্দিষ্ট যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট নম্বর প্রয়োজন হলেও বিমান কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পাঁচটি ট্র্যাভেল এজেন্সি কোনো যাত্রীর নাম, পাসপোর্ট নম্বর বা অন্য কোনো কাগজপত্র জমা না দিয়ে জেদ্দা ও মদিনা রুটের গ্রুপ টিকিট কেটে নিয়েছে। জেদ্দা ও মদিনা রুটের টিকিট ব্লকে পাঁচটি এজেন্সির সন্ধান পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হলো-কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড (নয়াপল্টন), রয়েল এয়ার সার্ভিস সিস্টেম (নয়াপল্টন), ইন্যামন অ্যাভিয়েশন লিমিটেড (মতিঝিল), স্টার হলিডেজ (পুরানা পল্টন), দোলা ফকির এয়ার সার্ভিস (তোপখানা রোড)। এ দুই রুটের ইকোনমি ক্লাসের প্রায় দুই হাজার ২০০ টিকিট ‘গ্রুপ বুকিং’ করার সুযোগ দিয়েছে। ফলে সেপ্টেম্বরে টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়েছে (ঢাকা পোস্ট, ২৫ আগস্ট,২০২২)। সহস্রাধিক টিকিট বুকিং দিয়ে অগ্রিম খরিদ করার বিষয়ে কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক কাজী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, এটা পুরনো সিস্টেম, নতুন কিছু নয়। আমরা নিয়ম মেনে বিমান থেকে গ্রুপ বুকিং করেছি। বিমানের অনেক ফ্লাইটে যাত্রী হয় না। ফলে বিমান আমাদের একসঙ্গে গ্রুপ টিকিট দিয়ে থাকে। আমরা সম্পূর্ণ নগদ টাকা দিয়ে টিকিট খরিদ করি।

তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, নাম ও তথ্য ছাড়া কোনো টিকিট দেয়া হয়নি এবং নিয়মানুযায়ী বিমানের সেলস সেন্টার থেকে টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি অনুমোদিত ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমেও টিকিট বিক্রি অব্যাহত আছে। ওমরাহ যাত্রীদের জন্য বিমানের ভাড়া স্তরভেদে ৭৫০ ডলার থেকে ৯০০ ডলার।

এ ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় বিমানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্যিক) মোহাম্মদ মেহেদী হাসানকে তৎক্ষণিক সেই বিভাগ থেকে বদলি করা হয়েছে। টিকিট নিয়ে দুর্নীতির কারণে বিমানের ডিস্ট্রিক্ট সেলস অফিসের মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আলমকে ইতঃপূর্বে বিমান থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তার নামে মামলাও রুজু করা হয়। ২০১৯ সালের তদন্তে বিমানের তৎকালীন মার্কেটিং ও সেলস বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আশরাফুল আলমকে টিকিট নিয়ে দুর্নীতির প্রধান দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, আশরাফুল আলম অনলাইনে টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেন। অতঃপর কিছু ট্র্যাভেল এজেন্টের সাথে যোগসাজশে সিন্ডিকেট করে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বিমানের টিকিট ব্লক করে কালোবাজারে বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পকেটস্থ করেন। এর ফলে বিমানের বহু আসন ফাঁকা অবস্থাতে উড়াল দিত, কিন্তু যাত্রীরা টিকিট পেতেন না। টিকিট বিক্রির অনিয়মের কারণে মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল বিমান (ইত্তেফাক, ২৭ আগস্ট, ২০২২)।

বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বিশিষ্ট এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স হিসেবে জনগণ ও ট্র্যাভেল এজেন্সির সাথে বিমানের যে আচরণ করা উচিত ছিল, তারা তা করছে না। তাদের টিকিটিং প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ করতে হবে। বিমানে টিকিটিংয়ের নিয়মের ব্যতিক্রম কেন হচ্ছে আমরা তা বুঝতে পারছি না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে যাত্রীরা অন্য এয়ারলাইন্সের দিকে ঝুঁকে পড়বে (ঢাকা পোস্ট, ২৫ আগস্ট, ২০২২)।

বাংলাদেশ বিমান সিন্ডিকেটমুক্ত হয়ে যাত্রীদের টিকিটের বাড়তি চাহিদার জোগান যদি দিতে পারত, তাহলে নিয়মিত লোকসানে নুইয়ে পড়া শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই সংস্থাটির কিছুটা হলেও কোমর সোজা করতে পারত। বিমানের আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসে সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা, দাম্মাম ও মদিনার চারটি স্টেশন থেকে। ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বিমানের মোট ৯টি ফ্লাইটে জীবাণুনাশক না ছিটানোয় সৌদি আরবের ডিরেক্টর অব হেলথ কন্ট্রোল এবং জেনারেল অথরিটি অব সিভিল এভিয়েশন বিমানকে জরিমানা করে। ফ্লাইটপ্রতি ৫০ হাজার রিয়াল হিসেবে মোট জরিমানার পরিমাণ বাংলাদেশী মুদ্রায় এক কোটি এক লাখ ৯৩ হাজার টাকা। মিসর থেকে দুটি বোয়িং উড়োজাহাজ ভাড়ায় এনে সাত বছরে এক হাজার ১৬১ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বিমান। অনিয়ম-দুর্নীতি, অদূরদর্শিতা ও জরিমানা লোকসানের প্রধান ক্ষেত্র বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ৫০ বছর পূর্তির লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে বিমান প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, কারো কারণে বিমানের সেবার মান ক্ষতিগ্রস্ত হলে, যাত্রীদের ভোগান্তি সৃষ্টি করা হলে, বিমানের যাত্রার সময় বিলম্বিত করা হলে, যে কারণে, যার কারণে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হবে, তাদের ছাড় দেয়া হবে না। বিমানের ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা করলে কঠোর পরিণতি ভোগ করতে হতে হবে (দেশরূপান্তর ডটকম)। মন্ত্রীর এসব মন্তব্য সিন্ডিকেট সদস্যরা গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের অপকর্ম বাধাহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

মাথা ভারী প্রশাসন, পাইলট অসন্তোষ, কারিগরি ত্রুটি, মাঝ আকাশ থেকে বিমান ফিরে আসার সিন্ড্রম তো আছেই। বেতন জটিলতা নিয়ে পাইলট অসন্তোষে ২০২১ সালে ১০ কোটি টাকারো বেশি রাজস্ব আয় বঞ্চিত হয়েছে বিমান। পাইলট অসন্তোষের খবরে শঙ্কিত অনেক যাত্রী ভ্রমণ বাতিল করায় এ ক্ষতির কারণ। ঢাকা-কানাডা রুটেও বিমানযাত্রী না পাওয়ায় প্রতিটি ফ্লাইটে কোটি টাকারও বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে বিমানকে। বিমানের ২৯৮ আসনের অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনার ফ্লাইটটি (বোয়িং-৭৮৭-৯০০) টরন্টো হতে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ফ্লাইটে যাত্রী ছিল মাত্র ৭৭ জন। যদি একটি ফ্লাইটে আড়াইশর বেশি যাত্রী পাওয়া না যায় তাহলে প্রতি ফ্লাইটে লোকসান অবধারিত। কারণ প্রতি ঘণ্টায় উড্ডয়ন খরচ হচ্ছে সাড়ে ১৩ হাজার ইউএস ডলার (নয়া দিগন্ত, ৫ আগস্ট, ২২)। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঋণের কিস্তি, উড়োজাহাজ ভাড়ার কিস্তি আর রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা খরচ রয়েছে বিমানের। দিন দিন দেনা বেড়ে চলেছে।

বিমানের দেড় মাসের ফ্লাইটগুলো যথাযথভাবে যাচাই করা হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। সিন্ডিকেট মুক্ত করা হোক বিমানের টিকিট এবং কেলেঙ্কারির হোতাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক; এটাই বিদেশগামী যাত্রীদের দাবি। ওমরাহযাত্রীদের টিকিটসঙ্কট দ্রুত নিরসনে সৌদি আরবের রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু এবং ওমরাহ এজেন্সিগুলোর কাছে সরাসরি টিকিট বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement