সরকারের চোখ কি জনগণমুখী
- ড. মাহবুব হাসান
- ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:০৩
শিরোনাম দেখে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এর পর দেখুন সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের উদ্যোগ আয়োজন। তা না হলে ঠিকভাবে সরকারের মনন মনীষা ও লক্ষ্য উপলব্ধি করা যাবে না। অনুসন্ধানে বাপেক্স পেয়েছে এক হাজার কোটি, আমদানিতে ৮৫ হাজার কোটি টাকা- এই শিরোনাম পড়ে কী মনে হয় প্রিয় পাঠক? মনে কি হয় যে, রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানী কোম্পানি বাপেক্সকে চার বছরে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা, আর শুধু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে সরকার ব্যয় করেছে ৮৫ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকারও বেশি! এক হাজার কোটি টাকার চেয়ে কি পরিমাণে বেশি ৮৫ হাজার কোটি টাকা? আমি ও আমরা অঙ্কে কাঁচা, তাই বুঝতে পারি না, কোনটা বড় অঙ্ক।
এবার একজন প্রজ্ঞাজনের কথা তুলে আনি। তিনি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান। তিনি বলেছেন, ‘জাতীয় গ্রিডে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্ববাজারের উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এর বিপরীতে দেশীয় উৎপাদন বাড়িয়ে কিভাবে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি করা যায়, তার চেষ্টা চলছে।’
নাজমুল আহসানের বক্তব্য খুবই স্পষ্ট ও সহজ। তিনি বা তারা (সরকার) এলএনজি আমদানিতে খুবই উৎসাহী। ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ না বাধলে আমাদের গ্যাস ও তেল আমদানিতে কোনোরকম বাধা আসত না বা প্রশ্নও উঠত না। সেটি দাম বাড়লেও হতো না, কমলে তো বাধার কথা উহ্যই থাকত। এই যে আমদানি ধারাবাহিকতার সিদ্ধান্ত, এটি আমাদের দেশের জন্য খুবই খারাপ একটি সিদ্ধান্ত বা দৃষ্টান্ত।
কারণ, আমাদের তেল ও গ্যাসের মজুদ আছে। তা খুঁজে বের করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিও আছে, তার নাম বাংলাদেশ তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি-বাপেক্স। এই রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের কোম্পানিটিকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশী কোম্পানিকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে অনেক বেশি টাকায়। বাপেক্স কূপ খনন করে সফল। একটি কূপ খনন করতে বাপেক্সের ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭৮ কোটি টাকা। ঠিক এই রকম অন্য একটি জায়গায় কূপ খনন করেছে বিদেশী কোম্পানি। সেই অনুসন্ধানে জন্য ব্যয় করা হয়েছে ৪৪৫ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য সূত্রে পাওয়া তথ্য বলছে, গত চার অর্থবছর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস-এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যদিও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৭৫ শতাংশ আসছে দেশীয় উৎস থেকে। এ সময়ে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বিনিয়োগের পরিমাণ যৎসামান্য। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে একই সময়ে কূপখনন ও জরিপে দেয়া অর্থের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার বেশি নয়। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থবির রেখে এলএনজি আমদানি বাবদ বিপুল অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে অর্থসঙ্কটে পড়েছে পেট্রোবাংলা। অন্য দিকে, অনুসন্ধান ও উত্তোলনে মনোযোগী না হওয়ায় স্থানীয় গ্যাসের মজুদ প্রায় শেষের পথে।
পেট্রোবাংলার আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানি বাবদ ব্যয় হয় ১১ হাজার ৮১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে মোট ৬৬টি কার্গো আমদানি করে পেট্রোবাংলা। এসব এলএনজিবাহী কার্গো আমদানি করতে সংস্থাটিকে গুনতে হয় ১৭ হাজার ৫০২ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে দীর্ঘমেয়াদি ৭২টি কার্গো আমদানির বিপরীতে পেট্রোবাংলার খরচ হয় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
আর ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যটি আমদানিতে পেট্রোবাংলার প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। (বণিক বার্তা, ২৯ আগস্ট, ২০২২)
এই তথ্য যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সরকার ও পেট্রোবাংলা প্রমাণ করেছে, তারা দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিশ্বাসী নয়। তারা আমদানিতে আরাম পায়, আনন্দ পায়। সেটি প্রমাণ করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জসহ পেট্রোবাংলা ব্যয় করেছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। আর সংস্থাটি এলএনজি আমদানির জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে কার্গো ভ্যাসেল কিনতে ব্যয় করেছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটিরও বেশি টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১৭ হাজার কোটি, ২০২১-২২ অর্থ বছরে পেট্রোবাংলার প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
এই চার-পাঁচ বছরে আমদানিতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় ও বরাদ্দ করা হয়েছে, তার চার ভাগেরও কম অর্থ বাপেক্সকে অনুসন্ধানের জন্য বরাদ্দ ও ব্যয় করতে দেয়া হয়নি। অর্থাৎ সরকারি নীতি হচ্ছে আমদানিনির্ভরতা, আর দেশের সম্পদ অনুসন্ধানের উৎসাহহীনতাই তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক রোগ। এই রোগ-বালাই হয় তাদেরই যাদের মধ্যে ন্যূনতম দেশপ্রেমের বালাই নেই। আমদানিতে কমিশন বা অন্য কৌশলে আর্থিক ফায়দা লোটার সুযোগ থাকে। যেমন থাকে গ্যাস কূপ খননে বিদেশী সংস্থাকে কাজ দিলে। একটি কূপ যেখানে ৭৮ কোটি টাকা ব্যয় করে সফল হয়েছে বাপেক্স, সেখানে বিদেশী কোম্পানিকে দেয়া হচ্ছে তার চার-পাঁচগুণ বেশি অর্থ। এর মাজেজা কী? তারা সাদা চামড়ার লোক, তারা ধনী দেশের মানুষ, তাই? তারা টেকনিক্যাল জ্ঞানে আমাদের মানুষদের চেয়ে অধিক দক্ষ এই বিবেচনায়? তাদের দক্ষতা বাংলাদেশীদের চেয়ে বেশি, এই যুক্তিহীন বিশ্বাসে? নাকি এর পেছনে রয়েছে ঘুষের উৎস। তারা তো ধোয়া তুলসী পাতা, তাদের গায়ে কোনো রকম দুর্গন্ধ নেই।
এই বৈষম্য ও আমাদের তেল-গ্যাস ক্ষেত্রগুলো পশ্চিমা লুটেরাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার কারণ কী? গত ১৩ বছরে বিদেশী অনুসন্ধানী দলগুলো কয়টি কূপ খনন করেছে, কয়টিতে সফল হয়েছে এবং তার জন্য কত টাকা ব্যয় হয়েছে- এই তথ্য দিতে হবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে।
প্রধানমন্ত্রী এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, কী করে তার অধীনস্থ মন্ত্রণালয় এমন বৈষম্যমূলক কাজ করছে? তাকে কি এসবের খবর আড়াল করা হয়? তেমনটি হলে তার এই দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া উচিত। কারণ তিনি অকারণে দুর্নামের ভাগীদার হচ্ছেন। আর তিনি যদি মনে করেন যে, তিনি হাঁসের মতো, জল থেকে উঠে গা ঝাড়া দেবেন, সব পিছলে মাটিতে পড়ে মিশে যাবে, তা হলে ভিন্ন কথা।
যে নীতির কথা বলতে চাইছি, সেটি অপরিণামদর্শী আমদানি নীতি। আমাদের খনিজসম্পদ তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান না করে ওমান এবং কুয়েত থেকে এলএনজি আমদানি করার মানে কী? পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেছেন, জাতীয় গ্রিডে তারা ৭৫ শতাংশ এলএনজি সরবরাহ করছেন। দেশীয় উৎস থেকে যদি এরকম সরবরাহ দেয়া সম্ভব, তাহলে বাকি ২৫ শতাংশ আমদানি করলেই তো সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতেই সরকার ওপেন মার্কেট থেকে যাতে এলএনজি কিনতে পারে তারও সুব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা এলএনজিবাহী ট্যাংকার কেনার পেছনে ব্যয় করা হয়েছে, এই উদ্যোগই প্রমাণ করে- সরকার আমদানিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এখন আবার রাশিয়ার তেল কেনার কথা উঠেছে। সঙ্কট মোকাবেলায় রাশিয়ার তেল কেনার উদ্যোগ সমর্থনযোগ্য হতো যদি আমাদের রিফাইনারি রাশিয়ান ক্রুড অয়েল শোধনের উপযোগী হতো। আমাদের একটি মাত্র রিফাইনারি তেল শোধনের জন্য, এটি দিয়ে রুশ অয়েল শোধিত করা যাবে না। ব্রুনেই দারুস সালাম বাংলাদেশের কাছে তেল বিক্রির কথা জানিয়েছে। বাড়ির কাছে আরশি নগর ব্রুনেই, সেখান থেকে কমদামে তেল কেনা যেতে পারে, যা সাশ্রয়ী হতে পারে। রাশিয়ার তেল কিনতে স্যাংকশনের ভয় আছে। এটি মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকা ও ইউরোপ বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রধান ক্রেতা ও পৃষ্ঠপোষক। তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগীও। ওই পোশাক মার্কেট হারালে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার আয় তলানিতে নেমে আসবে।
সেই তুলনায় দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না কেন? তার জবাব সরকারকে দিতে হবে। দেশকে আমদানিনির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক শক্তিকে তলানিতে নিয়ে যাওয়ার পেছনেই বা কী আদর্শ কাজ করছে, তারও জবাব জনগণকে দিতে হবে। সরকার দাবি করে, তারা জনগণের সরকার, গণতান্ত্রিক সরকার। সেই দাবি প্রমাণ ও পোক্ত করতে হলে অবশ্যই এসব প্রশ্নের জবাব সংসদের মাধ্যমে জনগণকে জানাতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা