২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পরিবেশের সুরক্ষা : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

লেখক : তৈমূর আলম খন্দকার - ফাইল ছবি

বিজ্ঞান যতই এগিয়ে যাচ্ছে, পরিবেশ ততই দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে, পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে। বন্যা, মহামারী, অতিমারী, দাবানল, দুর্ঘটনা, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অবনতি প্রভৃতি প্রকট থেকে প্রকটতর আকার ধারণ করছে। মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস করেছে, আর সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে মানবসমাজ এখন জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য হাহাকার করছে। পরিবেশের সুরক্ষার্থে বাংলাদেশে নিম্নোবর্ণিত আইন রয়েছে-
১. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫
২. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭
৩. পরিবেশ আদালত আইন-২০১০
৪. পরিবেশ আদালত আইন-২০০০
৫. ইট প্রস্তুত ও ভাটা (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩
৬. ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৮৯
৭. শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬
৮. ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫
৯. খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০
১০. জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০

ওই আইনগুলো প্রতিনিয়ত ভঙ্গ হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের উভয় ডিভিশন যথা- আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট, উভয় উচ্চ আদালত পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশনার পর নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এগুলোর আশানুরূপ কোনো কার্যকারিতা বা সফলতা নেই। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পাদিত চুক্তি, কনভেনশন, আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন, আদালতের সিদ্ধান্ত, জেনারেল প্রিন্সিপল অব ল’ ইত্যাদি আইনজ্ঞদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনটি ধাপে পৃথিবীতে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন চলে আসছে। প্রথম ধাপ শুরু হয় ১৯০০ সালে ধর্মীয় অনুভূতিকে সামনে রেখে যা ১৯৭২ সাল পর্যন্ত চলে। ইতোমধ্যে দু’টি আন্তর্জাতিক মামলার গুরুত্বপূর্ণ রায়ে পরিবেশ রক্ষার স্বপক্ষে রায় দিয়ে আন্দোলনকে Justified করেছে। মামলা দু’টি হলো- ১. Trail Smelter Case between United States V Canada তারিখ-১১ মার্চ ১৯৪১, ২. Lac Lanoux Arbitration between France and Spain তারিখ- ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭।

পরিবেশ আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চলে। ওই সময়ের মধ্যে নিম্নেবর্ণিত কার্যক্রমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক দলিল সৃজন হয়।
ক. জাতিসঙ্ঘ আয়োজিত ১৯৭২ সালের পরিবেশ রক্ষা আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
খ. The Stockholm Declaration on Human Environment’ 1972 (পরিবেশ সংক্রান্ত ২৬টি নীতিমালা গৃহীত হয়)।
গ. পরিবেশ রক্ষার জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি শুরু করে।
ঘ. 1982-1987 The World commission on Environment & Development কার্যক্রম শুরু করে Brutdland commission নামে পরিচিত।

১৯৯২ সাল থেকে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের তৃতীয় ধাপ শুরু হয়।
ক. আর্থ সামিট শিরোনামে ১৯৯২ সালে পরিবেশ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রপ্রধানদের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
খ. Rio Declaration on Envionment and Development’ 1992 সম্মেলনে পরিবেশ রক্ষায় ২৭টি নীতিমালা গৃহীত হয়।
গ. The United Nations Framework convention on climate change’ 1992.
ঘ. The convention on Biodeversity 1992.
ঙ. The United Nations Millenniom Summit 2000.
চ. The World summit on sustainable Development’ 2002.
ছ. The United Nations conference on sustainable Development’ 2012.

আন্তর্জাতিক একটি সমীক্ষার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে, বায়ুদূষণ শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বায়ুদূষণ পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত রয়েছে- শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষের বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধীরে ধীরে অকেজো করে দেয়। ঢাকাকে দূষিত করার আরো একটি বিশেষ ক্ষেত্র হয়েছে শব্দদূষণ। এ শব্দদূষণের কারণে শ্রবণ প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দিন দিন জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শব্দদূষণ প্রতিরোধ করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রায়ই মিটিং করে, কিন্তু ফলপ্রসূ কোনো রেজাল্ট পাওয়া যাবে না। হইড্রোলিক হর্ন প্রতিটি বাসে রয়েছে, কিন্তু এ মর্মে বিআরটিএ দর্শকের ভ‚মিকা ছাড়া কিছুই করে না। জিজ্ঞাসা করলে বলে, তাদের জনবলের অভাব রয়েছে।

ইট পোড়ানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-১৯৮৯ সুযুগোপযোগী করার জন্য ১৯৯২, ২০০১ সালে সংশোধন করা হয়। রাজধানীর আশপাশে ইটাভাটা বন্ধ করার জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সরকার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। গাড়ির কালো ধোঁয়া বন্ধ রাখার জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও কালো ধোঁয়া বন্ধ হচ্ছে না। রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। পরিবেশ আন্দোলনকারী আইনজীবীরা এ মর্মে মামলা করে উচ্চ আদালতের আদেশ পাওয়ার পরও প্রতিকার হচ্ছে না। আদালতের রায়গুলো কাজীর গরু কেতাবে থাকলেও গোয়ালে নেই, অর্থাৎ পরিবেশদূষণ বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও কার্যক্রম নেই বললেই চলে।

প্রকৃতির ওপর আঘাত হানলে প্রকৃতি প্রতিশোধ গ্রহণ করে বিধায় আজ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতৃত্বের কানে এখন পানি ঢুকেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন মোতাবেক- ‘পরিবেশ’ অর্থ- পানি, বায়ু, মাটি, ভৌত সম্পদ ও এদের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্কসহ এদের সাথে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের বিদ্যমান পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ‘পরিবেশদূষণ’ অর্থ- পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বা ক্ষতির সহায়ক হতে পারে এমন কোনো কঠিন, তরল বা বায়বীয় পদার্থ এবং তাপ, শব্দ ও বিকিরণও অন্তর্ভুক্ত হবে এবং ‘পরিবেশ সংরক্ষণ’ অর্থ- পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের গুণগত ও পরিমাণগত মানোন্নয়ন এবং গুণগত ও পরিমাণগত মানের অবনতি রোধ।

বাংলাদেশে মহাপরিচালকের নিয়ন্ত্রণে একটি পরিবেশ অধিদফতর রয়েছে। ওই আইনে পরিবেশ রক্ষায় যেকোনো কার্যক্রম বা পরিবেশ লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা (মামলা করাসহ) নেয়ার জন্য মহাপরিচালককে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ মহাপরিচালক, মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতর, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই তিন ফসলি নিচু জমি, খাল-বিল, নদী-নালা ভ‚মিদস্যুরা আবাসন প্রকল্পের নামে ভরাট করে ফেলছে। উচ্চ আদালত এ মর্মে নিষেধাজ্ঞা দিলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বাস্তবসম্পন্ন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, বিষয়টি এমন যে ‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’। পরিবেশ কার্যক্রমের সাথে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের স্বার্থ জড়িত। পরিবেশ দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সবারই সচেতন হওয়া এখনই সময়।

কোনোভাবেই সরকার ভ‚মিদস্যু অর্থাৎ বিভিন্ন বড় বড় আবাসন প্রকল্প গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বাস্তব দৃষ্টিতে দেখলে মনে হয়, ভ‚মিদস্যুরা নিজেরাই যেন একটি আলাদা সরকার। সরকার, আইন-আদালত সবই যেন তাদের পকেটস্থ। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের এহেন পরিণতি জনমানুষের প্রত্যাশার ওপর কুঠারাঘাত।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের কৃতিত্ব জীবদ্দশায় পাননি যে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার করে যাব : আসিফ নজরুল সীমান্তে বিজিবিকে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালনের আহ্বান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার শেখ হাসিনার অনেক গুমের সহযোগী ভারত : রিজভী জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ মাদরাসা শিক্ষার্থী আরাফাতের ইন্তেকাল ডাবরের পরিবেশনায় বঙ্গ নিয়ে এলো গেম শো ফ্যামিলি ফিউড দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদিস আল্লামা কমরউদ্দিনের ইন্তেকাল নতুন মামলায় সালমান-ইনু-আনিসুলসহ গ্রেফতার ৮ নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়েছে ২ পারের রোহিঙ্গাদের জাবালিয়ায় ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তাকে গুলি হামাসের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন

সকল