চা-শ্রমিকদের দাসত্ব ঘোচেনি ২০০ বছরেও
- ড. মো: মিজানুর রহমান
- ২৭ আগস্ট ২০২২, ২০:১০, আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৫:৩৭
চা ব্রিটিশ বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য রফতানিপণ্য ছিল। উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ১৮৪০ সালে চা-বাগান চট্টগ্রামে শুরু হলেও বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা-চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায়। পঞ্চগড়েও রয়েছে দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল। চট্টগ্রামে চা নিলাম শুরু করে ১৯৪৯ সালে ব্রিটিশ এবং অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসায়ীরা। জেমস ফিনলে এবং ডানকান ব্রাদার্সের মতো ব্রিটিশ কোম্পানি একসময় এই শিল্পে আধিপত্য করেছে। ইস্পাহানী পরিবারও এই শিল্পের এক বিখ্যাত অংশীদার ছিল।
ব্রিটিশদের চা পানের নেশা থেকেই এই শ্রমঘন শিল্পটি গড়ে ওঠে। শোনা যায়, এই চা-শ্রমিকরা বড় লাট সাহেবদের কেবল চা বাগানের কাজই নয় বরং তাদের সব সেবাই করত। তখন থেকেই চা শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে যেন একটা দাস-মনিব সম্পর্ক। তাই তো ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় অনেক চা-শ্রমিকদের নিজ দেশে নিয়ে যায়। যার জন্যই ব্রিটেনে সিলেটি বাংলাদেশীদের আধিপত্য। বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার বা চট্টগ্রাম জেলার ১৬৭টি নিবন্ধিত চা বাগানে সোয়া লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা চা-বাগান প্রতিষ্ঠার শুরুতে স্থানীয়ভাবে শ্রমিক না পাওয়ায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করেন। এদের বেশির ভাগ এসেছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকা থেকে। এদের বিভিন্ন প্রলোভন, ভয় দেখিয়ে, অপহরণ করে, ভুল বুঝিয়ে, অনেক সময় সহিংসতার মাধ্যমে ধরে আনা হতো। চা-শ্রমিকদের ওই অভিবাসন ছিল অনেকটা দাস ব্যবসার মতো। তাদের নিজেদের লোকজনই তাদের বিক্রি করে দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা, চা বাগান মালিক এবং কর্মকর্তারা তাদের সাথে দাসের মতো আচরণ করতেন।
বাগান মালিকরা চা-শ্রমিকদের নিজেদের দাস বা সম্পত্তি বলে মনে করতেন, মালিকরাই তাদের কতটুকু স্বাধীনতা দেবেন তা নির্ধারণ করতেন। তাদের বাগানের বাইরে যেতে দেয়া হতো না। তারা এসেছিলেন উন্নত জীবনের আশায়, কিন্তু এখানে এসে সারা জীবনের জন্য বন্দী হয়ে পড়েন। তাদের হয়তো কারাগারে আটকে রাখা হয়নি, কিন্তু দাসের চেয়ে তাদের অবস্থা ভালো ছিল না।
পরবর্তীকালে এই শ্রমিকদের সন্তানরাই বংশপরম্পরায় চা বাগানের কর্মী হিসেবে কাজ করতে থাকে। এমনকি পরবর্তী দুই শতকেও সেই পরিস্থিতির বদল হয়নি। আজও বাংলাদেশের মূল সমাজের সাথে তাদের সংযোগ খুবই সামান্য। শিক্ষা আর চাকরির সুযোগের অভাবে তারা চা বাগানের পরিবেশেই আটকে রয়েছে। চা-বাগানের বাইরে অচেনা একটি দেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয় তাদের অদৃশ্য একটি শিকলে চা বাগানের মধ্যে আটকে রেখেছে।
ঘরবাড়ি ছেড়ে আসা এই শ্রমিকরা নতুন পরিবেশে নতুন লড়াইয়ের মুখোমুখি হন। নতুন ধরনের আবহাওয়া, বন্যপ্রাণী, রোগব্যাধির মুখোমুখি হতে হয় তাদের। বনজঙ্গল কেটে চা বাগান তৈরি করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক বুনো প্রাণীর হামলায় বা রোগে মারা যায়। ব্রিটিশ সরকার আইন করে যেকোনো শ্রমিক বাগান থেকে পালিয়ে গেলে তাকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই বন্দী করে রাখতে পারবে বাগান মালিকরা। মারধর করা, আটকে রাখা বা অপহরণ করারও এক প্রকার আইনি বৈধতা দেয়া হয়।
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যখন ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তখন ১২ হাজার চা-শ্রমিক জন্মভূমিতে ফেরত যাওয়ার প্রচেষ্টায় চাঁদপুর স্টিমার ঘাটে গেলে তখনকার ইউরোপিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন ও স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বাধা দেয়। পালানোর জন্য তাড়াহুড়া করে স্টিমারে ওঠার সময় পদদলিত হয়ে এবং পরবর্তীতে কলেরায় শতে শতে শ্রমিক মারা যায়। এর মাধ্যমে চা-বাগান মালিকরা শ্রমিকদের এই বার্তা দেন যে, তারাই তাদের মালিক, খাদ্য এবং আশ্রয় দিয়েছেন ফলে তাদের অবাধ্য হওয়া চলবে না। যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে, তাদের পরিণতি মৃত্যু।
পরবর্তীতে আর কখনো জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেনি চা-শ্রমিকরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে যুদ্ধের সময় এসব বাগানে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং এই শ্রমিকরা তাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে সহায়তা করেছেন। স্বাধীনতার পর তারা এই দেশের নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হন।
চা-শ্রমিকদের বর্তমান জীবনমান
স্বাধীনতার পর পুরুষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল এক টাকা দুই আনা এবং নারী শ্রমিকের এক টাকা এক আনা। এরপর বিভিন্ন সময়ে বেড়ে ২০১৭ সালে হয় ১০২ টাকা এবং সবশেষ ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় ১২০ টাকা। বর্তমানে তারা দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে দৈনিক ৩০০ টাকায় কোনো ধরনের শ্রমিক পাওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি বাসার কাজের বুয়ার বেতনও থাকা-খাওয়া, কাপড়, চিকিৎসা এবং বোনাস ছাড়াই ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। এর পরেও দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির দাবি না মেনে মালিকরা বলছেন, তারা নাকি চা-শ্রমিকদের ৪০২ টাকার সমান মজুরি ও ভাতাদি দেন, যা স্পষ্টতই অসত্য এবং মানুষকে বিভ্রান্তিকর।
দৈনিক মজুরির অতিরিক্ত যে সুবিধাগুলো চা-শ্রমিকরা পেয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম হলো বাসস্থান, আলো, পানি, চিকিৎসাসুবিধা, অবসরভাতা বা ভবিষ্য তহবিল। উল্লেখ্য, শ্রম আইন অনুযায়ী, এসব সুবিধার কোনোটিতেই মালিকের দেয়া টাকা মজুরির অন্তর্ভুক্ত হবে না, কারণ গৃহায়নের সুবিধা নিশ্চিত করতে মালিকরা বাধ্য। বরং চা-শিল্পের বিশেষ ধরনের কারণেই শ্রমিকদের বাগানে রাখতে হয়। আর এই বাগানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চাষ করছেন চা-শ্রমিকরা।
এ ছাড়া, শ্রমিকদের অতিরিক্ত কাজের জন্য পারিশ্রমিক, উৎসব বোনাস, কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা ইত্যাদিও কোনো অবস্থায়ই দৈনিক মজুরি হিসেবে বিবেচিত হবে না। তবে, বাগান মালিকরা প্রতি পুরুষ শ্রমিককে তার পোষ্য নারী শ্রমিক এবং সন্তানসহ সপ্তাহে সব মিলে হয় ৬ দশমিক ৯৩ কেজি চাল বা আটা দিয়ে থাকেন। নারী শ্রমিকরা আবার পোষ্যের জন্য রেশন পান না; বৈষম্যের শিকার হন। কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে রেশন কাটা হয়। এই রেশনকে দৈনিক মজুরির অতিরিক্ত ভাতা বলা যায়, যদিও অন্য পেশায় রেশনকে মজুরি হিসেবে দেখানো হয় না; যেমন পুলিশ, বিজেপি, আর্মি ইত্যাদি সেক্টর।
এই টাকায় শ্রমিকরা না নিজে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচতে পারছেন, না তাদের সন্তানরা ভালোভাবে বেড়ে উঠছে। আর পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে চা-শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও অপুষ্টিতে ভুগছেন। বাগানগুলোতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। আধুনিক চিকিৎসার পরিবর্তে এখনো তারা অতিপ্রাকৃত শক্তির ওপর নির্ভর চিকিৎসাপদ্ধতি ব্যবহার করে। বর্তমানে চা-বাগানগুলোতে হাসপাতাল থাকলেও সেখানে শুধু নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ দেয়া হয়। অন্য দিকে নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটিও ঠিকভাবে পায় না। জানা গেছে, কর্মস্থলেই অনেক বাচ্চার জন্ম হয়ে যায়। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, সব চা-বাগানে স্কুল প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে। তবে তা বাস্তবে নেই।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার (আইএলও) বিধান অনুযায়ী চা-শ্রমিকদের যেন কোনো শ্রমঘণ্টা নেই। আর বিনোদনের তো প্রশ্নই আসে না। টানা আট ঘণ্টার প্রচণ্ড পরিশ্রম শেষে প্রতিদিন একজন শ্রমিক ২৩ কেজি চা-পাতা সংগ্রহের পরেও মজুরি হিসেবে পাচ্ছেন মাত্র ১২০ টাকা। উল্লেখ্য, ২৩ কেজি চা-পাতা তুলতে না পারলে প্রতি কেজির জন্য ১৪ টাকা কম দেয় অথচ বেশি তুললে প্রতি কেজির জন্য মাত্র দুই টাকা অতিরিক্ত দেয়। এত স্বল্পমজুরিতে মানবেতর জীবনযাপন করছে শ্রমিকরা
চা-শ্রমিকদের আইনগত প্রাপ্য সুবিধাদি
আগেই বলেছি চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা নির্ধারণ করা হয় ২০২০ সালে দুই বছরের জন্য। সেই মেয়াদ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মজুরি বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণে রাজি হয়েছে চা-বাগান মালিকরা; যদিও চা-শ্রমিকদের একাংশ এ মজুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। চা-শিল্পের মালিক পক্ষের দাবি, দৈনিক মজুরি কম হলেও চা-বাগানের শ্রমিকরা অন্য অনেক সুবিধা পান, যা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই বিভিন্ন সুবিধার একটি কাল্পনিক হিসাব করেও মালিকরা দেখিয়েছেন যে তাদের দৈনিক মজুরি ও অন্যান্য সুবিধাসহ ৪০৩ টাকার সমান; যে হিসাব ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর। এ কথা সত্যি যে, চা-বাগানের জন্য লিজ নেয়া সরকারি জমিতে আবাসনের নামে মাথাগোঁজার ঠাঁই শ্রমিকদের দিয়ে থাকে। এ ছাড়াও আরো কিছু সুবিধা মালিকপক্ষ দিয়ে থাকে যার গুণগত মান সম্পর্কে উদ্বেগ রয়েছে। তদুপরি ওইসব সুবিধার অর্থমূল্য দৈনিক মজুরির সাথে বিবেচনায় আনার আইনত সুযোগ রয়েছে কি না সে বিষয়গুলো আমরা এখানে আলোচনা করব।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ২০১৮ সালের চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১০৮ টাকা ভিত্তি ধরে অন্যান্য সুবিধার অর্থমূল্য যোগ করে মোট মাসিক সার্বিক মজুরি পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৩১ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট অন্য সব খাতের তৎকালীন শ্রমিক মজুরির ভেতর নিম্নতম।
সব সেক্টরে শ্রমিকের মজুরির বার্ষিক বৃদ্ধির একটি প্রচলন রয়েছে অথচ চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে মজুরি দুই বছর পরপর পরিবর্তন হওয়ার কথা রয়েছে; তাও হয় না। সর্বশেষ ২০২০ সালে চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি যেমন বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে ঠিক তবে তখন অন্যসব খাতেই সর্বনিম্ন মজুরিও বেড়েছে। চা-শ্রমিকের সার্বিক অধিকার এবং তাদের প্রাপ্তির চিত্র আরো হতাশাব্যঞ্জক। চা-শ্রমিকদের আইনত ন্যায্য অধিকার সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে এবং নির্মমভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। যেমন শ্রম আইনে প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকাবর্ষে পূর্ণ বেতনে ১০ দিনের যে নৈমিত্তিক ছুটি পেয়ে থাকেন, চা-শ্রমিকের ক্ষেত্রে তা কার্যকরী হয় না। প্রতি ১৮ কর্মদিবস অন্তে ১ দিন অর্জিত ছুটি পাওয়ার কথা অথচ চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ২২ দিনে এক দিন। দুই বছর চাকরি পূর্ণ হলে ভবিষ্য তহবিলে মালিকপক্ষের প্রদেয় অংশ সম্পূর্ণ পাওয়ার কথা অথচ চা-শ্রমিকরা পাচ্ছেন ১০ বছর পূর্ণ হলে। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকদের পাবার কথা। মুনাফার ওই ৫ শতাংশের ৮০ ভাগ শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিলে ও বাকি ২০ ভাগ শ্রমিককল্যাণ তহবিলে জমা হবার কথা। অথচ কোনো চা-বাগানে এই নিয়ম মানা তো দূরের কথা, এমন কোনো তথ্যও নেই তাদের কাছে। গ্রুপ বীমার কোনো বালাই নেই চা-শিল্পে। তিন মাস সন্তোষজনক শিক্ষানবিসকাল অতিক্রম সাপেক্ষে চাকরি স্থায়ী হওয়ার সাধারণ নিয়ম চা-বাগানেই নেই। ফলে, চা-মালিকরা দীর্ঘদিন অস্থায়ী রেখে নির্ধারিত মজুরিসহ অন্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদের শ্রমিকদের। স্থায়ী শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ও আইডি কার্ড দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই কোনো বাগানে।
সংশ্লিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী আবাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, রেশন, খাবার পানি, স্যানিটেশন, দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ, অসুস্থতাজনিত ও মাতৃত্বকালীন ছুটি, উৎসবভাতাসহ চা-শ্রমিকের অন্যান্য ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গুণগত মান বিবেচনায় বিরাজ করছে হতাশাজনক চিত্র। রয়েছে প্রতারণামূলকভাবে পাতার ওজন কম দেখানোসহ বিভিন্ন অজুহাতে কম মজুরি প্রদানের অভিযোগ।
শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি বাগানে খাওয়ার পানির সুব্যবস্থা থাকার কথা, কিন্তু কোনো বাগানেই এজন্য প্রয়োজনীয় নলকূপ বা কুয়ার ব্যবস্থা নেই; অনেক ক্ষেত্রেই বাগানে প্রবহমান ছড়া, ঝরনা, খাল ইত্যাদি থেকে শ্রমিকদের পানি পান করতে হয়। বাগানের প্রতি সেকশনে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকার নিয়ম রয়েছে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। অনেক শ্রমিক গর্ভধারণে মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না। আর যারা পান, তাদের একাংশ ছুটির সময় নিয়ম অনুযায়ী প্রাপ্য মজুরি পান না।
শ্রমবিধিমালা অনুযায়ী মালিকপক্ষ প্রত্যেক শ্রমিক ও তার পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বাসস্থান নিশ্চিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশ টি বোর্ডের তৎকালীন হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৩৩ হাজার স্থায়ী শ্রমিকের জন্য আবাসন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। যারা বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের একটিমাত্র ঘরে কোনো বিভাজকের ব্যবস্থা না থাকায় মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ছেলের স্ত্রী এবং গরু-ছাগল নিয়ে পুরো পরিবারকে একসঙ্গে বসবাস করতে হয়।
বিধিমালা অনুযায়ী বাগান মালিকের নিজ উদ্যোগে বাগানপ্রতি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ বাগান মালিক তা করেন না। প্রতিটি বাগানে হাসপাতাল বা চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার নিয়ম থাকলেও অনেক বাগানেই তা করা হয়নি। বেশির ভাগ চা-বাগানের চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রসবকালীন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নেই। নিয়ম অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত হতাহতের ক্ষেত্রে মালিকপক্ষ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকার কথা থাকলেও, বেশির ভাগ বাগান মালিক তা মানেন না।
উল্লেখ্য, চা-শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার হরণ ও চলমান বৈষম্যকে যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, তা এক দিকে মালিকপক্ষের প্রভাবশালী অংশের সংবেদনশীলতার ঘাটতি ও দীর্ঘকাল লালিত ঔপনিবেশিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এক কথায় চা-শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের কুঁড়েঘরে বন্দী চা-বাগানের ওই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটি যেন শ্রমিকদের কাছে গোটা পৃথিবী। আর ওই পৃথিবীতেই তারা দাস হিসেবে শৃঙ্খলিত। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক জমানায়, যখন সারা পৃথিবী থেকে দাসত্ব উৎখাত হয়েছে তখনো বাংলাদেশের চা-শ্রমিকরা দাসত্বের বন্ধনমুক্ত নন। শৃঙ্খলে থেকেই তারা দিনে আট ঘণ্টা টানা কাজ করেও সকালে চা-পাতা ভাজা, দুপুরে শুকনা রুটি এবং রাতে মরিচ দিয়ে ভাত খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন।
পরিশেষে বলতে হয়, বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই মজুরিতে চা-শ্রমিকদের অনাহারে-অর্ধাহারেই দিন কাটবে। শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের কারণে চা রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। অনেক আন্দোলনের পর দৈনিক মজুরি মাত্র ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা দিতে রাজি হয়েছেন তাদের মনিবরা। তবে এ মজুরিতে সন্তুষ্ট নয় চা-শ্রমিকরা। কিন্তু চা-শ্রমিকদের পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি এবং চা-শিল্পের মনিবদের সুচতুর বিভাজনকৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের দর-কষাকষির দক্ষতার অভাবে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দাসত্বমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা পদদলিত। চা-শ্রমিকদের এই দুরবস্থার অবসান না হলে একদিন চা-শিল্প সঙ্কটাপন্ন হতে পারে, সুতরাং এখনই সতর্ক হতে হবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ই-মেল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা