২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

স্ট্রিট ফুড এবং নাগরিক স্বাস্থ্য

লেখক : অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম - ফাইল ছবি

নাগরিক জীবনে ভিন্নতার শেষ নেই, শেষ নেই বৈচিত্র্যের। একসময়ের মায়ের হাতের মাছের ঝোল, পিঠেপুলির জায়গা নিয়েছে স্ট্রিট ফুড। যেভাবে স্ট্রিট ফুডের কদর বাড়ছে অদূর ভবিষ্যতে মনে হয়, রান্নাঘর হারিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা রেস্টুরেন্টের খাবার অথবা স্ট্রিট ফুড। যারা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত তারাও প্রায়ই বৈচিত্র্যের খোঁজে স্ট্রিট ফুডের দোকানে হানা দেন, কখনো সপরিবারে, কখনো বন্ধুদের নিয়ে। ঢাকা শহরের মূল সড়কগুলোর দু’পাশে বিকেল হলে বিচিত্র ধরনের খাবারের দোকানের পসরা দেখা যায়।

রমজান মাসে এসবের বাহারি মেলা যেন পূর্ণতা লাভ করে। গাড়ি ঘোড়ার ধুলো, খাবারের উপর মাছির ভনভন মহড়া, সব মিলিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিচিত্র সব খাবারের দোকান। ফুটপাথের ওপর, ড্রেনের ঢাকনার ওপর দোকান সাজিয়ে চলে বেচাকেনা। ব্যানার, ফেস্টুন টাঙিয়ে বিচিত্র সব খাবারের দোকান ধুলোবালু মেশানো, ভ্রূকুটিহীন বিক্রেতার কাছ থেকে ততোধিক নির্বিকারভাবে ক্রেতারা খাবার কিনছেন, খাচ্ছেন ও গল্প করছেন। আবার প্যাকেট করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। বাঙালিরা ভোজনরসিক। বাঙালির এই চাওয়াকে প্রাধান্য দিতেই রাজধানী ঢাকা শহরসহ সব শহরের আনাচে-কানাচে খাবারের বিচিত্র দোকানের পসরা দেখা যায়।

অনেক জায়গায় দেখা যায়, ডাস্টবিনের পাশেই দোকান। সারি সারি খাবার রাখা। ড্রেনের উপর ডাস্টবিনের পাশে ধুলাবালুর আস্তরণে ঢাকা, খাবারের ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ে এ ব্যাপারে নির্বিকার। নিঃসঙ্কোচে বিক্রেতা বিক্রি করছেন। ক্রেতা কিনছেন ও পরমানন্দে খাচ্ছেন। ফুটপাথের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার ডেকে আনছে বিপদ। ডায়রিয়া, বদহজম, লিভারের অসুখ, কিডনির অসুস্থতাসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়াচ্ছে এসব দোকানের খাবারে। ঢাকা শহরে প্রায় ৬০ লাখ থেকে ৭০ লাখ লোক প্রতিদিন স্ট্রিট ফুডে অভ্যস্ত। মুখরোচক ও স্বল্পমূল্যের কারণে এসব খাবার ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। পৃথিবীব্যাপী পর্যটকদের কাছে পছন্দনীয় খাবার স্ট্রিট ফুড। সাশ্রয়ী হওয়ায় এসব রকমারি খাবারের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে। পর্যটকদের কথা বাদ দিলাম। আমাদের দেশের গৃহবধূদের কাছে এটার জনপ্রিয়তা অতুলনীয়, অপরিসীম। কিন্তু এটার স্বাস্থ্যগত দিকটা কেউ ভাবছেন না, ভাবছেন না এর ক্ষতিকর পরিণতি।

গরমের সময় প্রচণ্ড দাবদাহে রাস্তার পাশে দেখা যায়, আখের রসের শরবতের বৈচিত্র্যময় সরবরাহ। লক্ষণীয়, যিনি বিক্রি করেন, যে পাত্রে শরবত বানান, যে পাত্রে খরিদ্দারকে সরবরাহ করেন কোনোটাই স্বাস্থ্যকর নয়। ফুচকা ও চটপটি যারা বিক্রি করেন, তাদের চেহারাটার দিকে তাকালেও তো খাবারের ব্যাপারে রুচিবোধে লাগার কথা। কিন্তু কেন জানি না, আমরা এই রুচিবোধটাও হারিয়ে ফেলেছি। এর পরিণতি হলো, মহাখালীর কলেরা হাসপাতাল আর শিশু হাসপাতালের বিছানায় গড়াগড়ি। মাঝখান থেকে একটি ‘ভালো পরিমাণে’ অর্থ পকেট থেকে উধাও। এসব ব্যাপার খেয়াল করা দরকার। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই স্ট্রিট ফুড রয়েছে। কিন্তু এটির নিয়ন্ত্রণেরও একটি ব্যবস্থা রয়েছে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে স্বাস্থ্য বিভাগ এটা নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য বিভাগ এটিকে দেখেন যেন এটি স্বাস্থ্যকরভাবে তৈরি ও সরবরাহ করা হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো কিছুর বালাই আমরা দেখি না। আছে বলেও মনে হয় না। নইলে প্রায় প্রতিটি স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে এ ধরনের খোলা খাবার স্কুলের শিশুদের জন্য নির্বিচারে বিক্রি হচ্ছে; সবাই দেখছে। কিন্তু কেউ এ ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না।

এটি বিপজ্জনক। আর একটি বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে এসব খাবারের কারণে কিডনি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে লিভারের রোগীর সংখ্যা এবং একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা। এটি উদ্বেগজনক। এসব রোগী যখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়, তখন বোঝা যায় এর ক্ষতির দিকটি। এক দিকে স্বাস্থ্যহানি, অপর দিকে সীমাহীন চিকিৎসা খরচ এসব রোগীর জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। একজন কিডনি রোগীর বা একজন লিভারের রোগীর অথবা ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে পরিবারগুলো ফতুর হয়ে যায়, পথে বসে। এখানে জীবন হার মানে। সুতরাং সুস্থ নিরাপদ ও দীর্ঘায়ুর লক্ষ্যে জীবনকে জীবন হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনে, স্ট্রিট ফুডের উপরে তদারকির ব্যবস্থা করা দরকার। প্রয়োজন শহরের নির্দিষ্ট স্থানে এসবের ব্যবস্থা করা, যেন এর সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান করা যায়।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement