২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তেলের মূল্য বৃদ্ধি কি অবশ্যম্ভাবী ছিল

তেলের মূল্য বৃদ্ধি কি অবশ্যম্ভাবী ছিল - ছবি : সংগৃহীত

জ্বালানির দাম দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। একবারে ৫১ শতাংশ দাম বাড়ানোর নজির আর নেই। প্রশ্ন হলো, একধাপে মধ্যরাতে এত দাম বাড়াল কেন? আমরা জানি, আইএমএফের ঋণ এক ধরনের বেল আউট সহযোগিতা। কোনো সরকার একান্ত বাধ্য হলেই এই সংস্থা থেকে ঋণ নেয়। তাদের কঠিন শর্ত মেনেই এই ঋণ নিতে হয়, যখন সরকারের হাতে কোনো বিকল্প থাকে না। এ কথা সত্যি হলে ধরে নেয়া যায়, দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এখনই রিজার্ভ বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে দেশ বিপদে পড়ে যাবে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে। যদিও আইএমএফের হিসাব মতে ৩১ বিলিয়ন ডলার। বিভিন্ন তথ্যমতে ক্যাশ ও সহজে ব্যবহারযোগ্য ডলারের পরিমাণ আরো কম। বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব, বাস্তব অবস্থা হয়তো আরো কঠিন। ফলে, সার ও জ্বালানির মতো জরুরি পণ্যের ভর্তুকি সম্পূর্ণ তুলে ফেলার মতো কঠিন পরামর্শ মানতে হচ্ছে সরকারকে।

আইএমএফের সাথে ঋণ নিয়ে আলোচনা চলছে, মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে। তারা সার ও জ্বালানিসহ বিভিন্ন আমদানি পণ্যের ভর্তুকি কমিয়ে বাজেট ঘাটতির চাপ সমন্বয় করার শর্ত দিতেই পারে। এর অর্থ এই নয় যে, জ্বালানির পুরো ভর্তুকি একবারেই তুলে নিতে হবে। আইএমএফের সাথে দর-কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাদের সব শর্ত হুবহু মানতেই হবে এমন নয় বরং দেশের পরিস্থিতি উপস্থাপন করে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা যায়। বিষয়টি এখনো পুনর্বিবেচনার সুযোগ আছে।

রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। প্রতিদিন ৫০ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি হয় রাশিয়া থেকে, যার অর্ধেকের বেশি যায় ইউরোপে। হঠাৎ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা ও সরবরাহ সমস্যার কারণে বিশ্ব বাজারে তেল-গ্যাসের দাম বেড়ে যায়। একপর্যায়ে দাম ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলারে উঠলেও স¤প্রতি কমে ৯০ ডলারের নিচে এসেছে এবং দুই-তিন মাসের মধ্যে ৮০ ডলারে নেমে আসার সম্ভাবনা আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে গেল, সে সময় দেশের জ্বালানির দাম এক লাফে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি একদিকে যেমন সরকারের অদূরদর্শিতার প্রমাণ, অন্য দিকে দেশের জনগণের জন্য একরকম অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার যেহেতু এই কয় মাস অপেক্ষা করছিল আরেকটু ধৈর্য ধরা যেত।

দাম বাড়ানোর ধরন দেখে মনে হয় না, কেবল বিশ্ববাজারের দামের সাথে সমন্বয় করে বিপিসির লোকসান কমানোর জন্যই এই দাম বাড়ানো হয়েছে। তাই যদি হতো তো করোনা অতিমারীর সময় বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন অনেক কম ছিল তখন বিপিসি প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। সে টাকা তো জনগণেরই টাকা, সুতরাং ওই ৪৩ হাজার কোটি টাকা এখন ভর্তুকির সাথে সমন্বয় করা যেত। এ ছাড়াও বৈশ্বিক দাম বাড়লে যেমন সরকার দাম বাড়ায় কিন্তু কমলে তেমন কমায় না। মনে হয় সরকার যেন জনগণের প্রতি নয়, ব্যবসায়ী বা দুর্নীতিবাজদের প্রতিই বেশি দায়বদ্ধ।

সামগ্রিক অর্থনীতি এমনিতে চাপে রয়েছে, করোনা মহামারীর পর মানুষের আর্থিক সঙ্কট গভীর হয়েছে যার প্রভাব এখনো কাটেনি। জনজীবনে মূল্যস্ফীতির বড় ধরনের চাপ সহ্য করতে হচ্ছে, এমন অবস্থায় জ্বালানির মতো সর্বসাধারণের ও সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় একটি পণ্যের দাম এক ধাপে এতটা বাড়ানো সরকারের অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকারই প্রমাণ।

এখন আমরা দেখব জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ানোর কী প্রভাব পড়তে পারে অর্থনীতিতে ও জনগণের জীবনমানে। জ্বালানি এমন একটি পণ্য যার সাথে প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন ও সেবা খাত এবং পরোক্ষভাবে সমস্ত খাতে এর প্রভাব রয়েছে। অকটেন এবং পেট্রল তেমন একটা আমদানি করতে হয় না, যদিও সরকারের উচ্চমহল থেকে বলা হয়েছে, মোটেই আমদানি করে না বরং কিছুটা রফতানি করে, সে ক্ষেত্রে কোন যুক্তিতে দাম বাড়ানো হলো তা বোধগম্য নয়। এতে মনে হয় যেন বৈশ্বিক দামের সাথে সমন্বয় নয়, বরং লাভ করাই উদ্দেশ্য; অবশ্য আমদানির পরিমাণ বেশ কম এবং এটি ধনিক শ্রেণীর প্রয়োজনে ব্যবহৃত সুতরাং তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে দেশের একটি উল্লেøখযোগ্য সংখ্যক তরুণ বাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে যাদের জীবিকার ওপর তার প্রভাব পড়বে।

ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে। সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত এই জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয়েছে ৪০ শতাংশ। লাখ লাখ কৃষক সেচের জন্য ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল। এ বছর পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একে তো সারের দাম কেজি প্রতি ছয় টাকা বেড়েছে তার ওপর সেচ খরচ ৪০ শতাংশ বেড়ে গেলে তার প্রভাব কৃষির ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত হানবে। এ ক্ষেত্রে অন্তত কৃষি খাতে সরকারকে চলমান সহায়তা বহাল রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের জন্য ডিজেল কার্ড করা যায় কি না সে বিষয় ভেবে দেখতে হবে। এই ডিজেল কার্ডের মাধ্যমে প্রত্যেক কৃষককে ডিজেলে ভর্তুকি দেয়া হবে। কৃষিই এ দেশের মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের সমৃদ্ধি ও স্বস্তির একটি স্থান, সেখানে আঘাত এলে দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে যেতে পারে।

প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল আমদানি করা বাংলাদেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ তেলনির্ভর। দেশে ব্যবহৃত তেলের ৭০ শতাংশের বেশি ডিজেল। দেশের বেশির ভাগ জনপরিবহন ডিজেলনির্ভর, সুতরাং পরিবহন ব্যয় এরই মধ্যে বেড়ে গিয়ে জনজীবনে প্রভাব ফেলছে। জনজীবনের সাথে কৃষিপণ্য পরিবহনেও প্রভাব ফেলবে যার মূল্যও ভোক্তাদের বহন করতে হবে।

জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে শিল্প খাতের পণ্য উৎপাদন ও পরিবহনে। বিশেষ করে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৩৪ টাকা বাড়ায় শিল্প খাতের কাঁচামাল আমদানি, পণ্য রফতানি ও বাজারজাতকরণে দুই দফা বাড়তি খরচ বহন করতে হবে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাব মতে, মোট ডিজেলের ৭ শতাংশ শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ৩৪ টাকা বাড়ায় জ্বালানি খরচ অন্তত ৪২ শতাংশ বাড়বে। এমনিতে বিশ্ব বাজারে আমদানি পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, তার ওপর দেশের পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাবে। ভারী শিল্প যেমন, সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, সিরামিকসের মতো শিল্পের কাঁচামাল পরিবহন খরচ বেড়ে গৃহনির্মাণ শিল্পে প্রভাব ফেলবে। এরই মধ্যে শিল্প খাত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যেমন- গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কট, ডলার সঙ্কট, আমদানির ঋণপত্র খুলতে এবং এর দায় পরিশোধে বিলম্ব ইত্যাদি। এর সাথে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি শিল্পের ওপর যেন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’।

রফতানিমুখী তৈরী পোশাক খাতের পাশাপাশি সংযোগশিল্পের প্যাকেজিং উপখাতেও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারখানায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় ডিজেলচালিত জেনারেটর চালাতে গিয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় রফতানি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, অধিকন্তু বাজার হারানোর আশঙ্কা দেখা দেবে। জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়ার কারণে ছোট ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ তাদের বাড়তি খরচ সমন্বয় করার সুযোগ কম। সর্বোপরি, বাড়তি সমস্ত খরচের চাপ ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়বে। যেভাবে দাম হঠাৎ করে এক ধাপে প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে তার চাপ অর্থনীতি কতটা নিতে পারবে সেটিই এখন চিন্তার বিষয়।

প্রশ্ন হলো, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিকল্প কী ছিল? দাম বাড়ানো যদি ঋণ পাওয়ার জন্য এইএমএফের শর্ত হয়ে থাকে এবং সরকারের যদি এইএমএফের ঋণ নিতেই হয় ও ঋণের কোনো বিকল্প উৎস না থাকে তাহলে কিছু করার সুযোগ ছিল সামান্যই। তবে সরকার দরকষাকষি করতে পারত, দেশের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে পারত, এমনকি ভর্তুকি ধীরে ধীরে তুলে নেয়ার চেষ্টা করতে পারত। দাম বাড়ানোর ব্যাপারে একটি স্বচ্ছতা থাকা দরকার, যেমন- বৈশ্বিক দাম যে হারে বাড়ে তার সাথে সমন্বয় করে বাড়ানোর পাশাপাশি দাম কমলে সেভাবে কমানোও দরকার। জ্বালানির মতো সর্বজনীন ও জরুরি প্রয়োজনীয় পণ্য থেকে লাভ করার মানসিকতা সরকারের না থাকা ভালো। জ্বালানিতে মূল্য সংযোজন করসহ প্রায় ৩০-৩২ শতাংশ কর নির্ধারিত আছে, সরকার দেশের এই কঠিন সময় এই কর কমিয়ে জ্বালানির ভর্তুকির সাথে সমন্বয় করতে পারত। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবেলার জন্য সরকারের কোনো ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

বর্তমান বাস্তবতায় সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বিশ্ব এখন টালমাটাল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনই থামার লক্ষণ নেই। বরং তাইওয়ান-চীনের যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে। সুতরাং জ্বালানির মতো জরুরি ও সবার প্রয়োজনীয় পণ্য কেবলই আমদানিনির্ভর না হয়ে দেশের ২৪টি অফশোর ব্লকে অনুসন্ধান চালাতে হবে। আমরা শুনে আসছিলাম- দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে, সেই গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে অনেক কয়লার রিজার্ভ রয়েছে, যার মান বিদেশের অনেক কয়লার চেয়ে ভালো, সেগুলো উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এর সাথে জ্বালানি তেলে সরকার ভর্তুকি দিতে না চাইলে দেশের তেলের মূল্য বৈশ্বিক বাজার মূল্যের ওপর ছেড়ে দেয়া যায়। এতে জনগণের সরকারের ওপর কোনো অভিযোগ থাকবে না এবং জনগণ বাজার ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। সর্বশেষ বিকল্প হলো, তেলের দাম পুনর্বিবেচনা ও পুনর্মূল্যায়ন করে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
ইমেইল : [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement