২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

জনজীবনে অক্টোপাসের থাবা

লেখক : সৈয়দ আবদাল আহমদ - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষ এখন ভয়াবহভাবে বিপদের সম্মুখীন। প্রতিদিন তাদের সামনে হাজির হচ্ছে নিত্যনতুন সঙ্কট। এমনিতে দ্রব্যমূল্য, গ্যাস-বিদ্যুৎ, পরিবহন, লোডশেডিং সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে জ্বালানি তেলের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি। এর প্রভাব পড়েছে সর্বক্ষেত্রে। ফলে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষেরা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।

গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে সরকার জ্বালানি তেলের দাম একলাফে বাড়িয়ে দেয় ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ। যেখানে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ছিল লিটার প্রতি ৮০ টাকা, সেখানে করা হয়েছে ১১৪ টাকা। অন্য দিকে ৮৬ টাকার পেট্রল ১৩০ টাকা এবং ৮৯ টাকার অকটেন করা হয়েছে ১৩৫ টাকা। এ মূল্যবৃদ্ধি নজিরবিহীন। বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধি এর আগে হয়নি। এ মূল্যবৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েছে শিল্পপণ্য, কৃষিপণ্য, গণপরিবহনের ভাড়াসহ জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রের ব্যয়ে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রথম ধাক্কা লেগেছে পরিবহন খাতে। সাধারণ মানুষের যাতায়াতের প্রধান বাহন বাসের ভাড়া বেড়েছে সর্বোচ্চ ২২ শতাংশ। অর্থাৎ ৫০০ টাকার ভাড়া এখন বেড়ে হয়েছে ৬১০ টাকা। বাস মালিকরা পণ্যবাহী যানের ভাড়াও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাড়া বৃদ্ধির ধাক্কা ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের বাজারে আরো চাপ সৃষ্টি করবে। এর মধ্যে নৌপথের ভাড়া বাড়ানোরও তৎপরতা চলছে। লঞ্চের মালিকরা দু-এক দিনের মধ্যে ভাড়া বাড়াবেন বলে জানিয়েছেন। ট্রেনের ভাড়াও বৃদ্ধির চিন্তা করছে রেল কর্তৃপক্ষ।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশের জ্বালানির ৬৫ শতাংশ ভোক্তা পরিবহন খাত। গণপরিবহন ও পণ্যবাহী যানের প্রায় পুরোটাই ডিজেলনির্ভর। এর মধ্যে বাস, লঞ্চ, ট্রেন, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযান উল্লেখযোগ্য। গণপরিবহনের মূল ব্যবহারকারী নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। ফলে নতুন এ মূল্যবৃদ্ধি তাদের বেশি বেকায়দায় ফেলবে। ইতোমধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।

পেট্রলপাম্প, বাস টার্মিনাল ও রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সাধারণ মানুষ ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানিয়েছে। সর্বত্র এখন এ মূল্যবৃদ্ধি আলোচনার বিষয়। সবার জিজ্ঞাসা জীবনযাত্রার ব্যয় আর কত বাড়বে? গত নভেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। তখন বাসের ভাড়া গড়ে ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। মাত্র ৯ মাসের মাথায় আবারো দূলপাল্লার পথে বাসভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২২ শতাংশ এবং নগরে সাড়ে ১৬ শতাংশ। নতুন বাসভাড়া রোববার থেকে কার্যকর বলা হলেও বাস মালিকরা এর আগে বেশি ভাড়া নিতে থাকে। এ নিয়ে বাসযাত্রীদের সাথে নানা জায়গায় কথাকাটাকাটি মারামারিও হয় পরিবহন শ্রমিকদের।

জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ কেন এত বাড়ানো হলো? সরকার বলছে বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য, বিপিসির লোকসান কমানো এবং তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার আইএমএফ থেকে সাড়ে চারশ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে। আইএমএফ ছাড়াও আরো কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হচ্ছে সরকার। ঋণদাতা গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈঠকের আগে সংস্কারের সদিচ্ছা প্রকাশের অংশ হিসেবে দাম বাড়ানোর এ পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়ার প্রধান শর্ত জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। তাই আইএমএফের সাথে বৈঠকের আগে সরকার দেখাতে চায় শর্ত পূরণ করে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকার ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর বড় অংশ জ্বালানি তেল গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য। গত মাসের ঢাকায় সফর করে যাওয়া আইএমএফ-প্রতিনিধিদল এ ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিল।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। বছর শেষে এটি আরো কমার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন সময় বাংলাদেশে সরকার কেন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করেছে? বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক চাপে পড়ে এ খাতে আর ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রির ফলে যে ঘাটতি, তার পুরোটা সমন্বয় করার জন্য এ নজিরবিহীন মূল্যবৃদ্ধি। আর এ ঘাটতির পুরো দায় পড়েছে ভোক্তা সাধারণের ওপর। বিপিসি জানিয়েছে, টানা ছয় মাস ধরে সংস্থাটি নিজস্ব তহবিল থেকে লোকসান দিচ্ছে।

তেল আমদানির জন্য বিপিসি বাড়তি খরচ করেছে ১২ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বিপিসির ঠিক হয়নি। এর আগে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে টানা সাত বছর বিপিসি মুনাফা বা লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। সেই লাভের টাকা থেকে লোকসানের ঘাটতি মেটানো উচিত ছিল বিপিসির। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় লোকসান শুরু হয় বিপিসির। তবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। অপরিশোধিত তেলের দাম ১৩০ ডলারের ওপরে উঠেছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। এখন সেটা ৯৫ ডলারে এসেছে এবং এ দামটা দু-তিন মাসের মধ্যে ৮০ ডলারের কাছাকাছি চলে আসবে। করোনা মহামারীর সময় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেক কম ছিল। তখন বিপিসি অনেক লাভ করেছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম গণমাধ্যমকে বলেন, অকটেন আমাদের দেশে উৎপাদিত হয়। পেট্রলও আমরা দেশে পাই। কিছুটা আমদানি করতে হয়। তাই অকটেন এবং পেট্রলের দাম না বাড়ালে পারত সরকার। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে মূল সমস্যা তৈরি হয়েছে। লাখ লাখ কৃষক সেচের জন্য ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল। সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি ও কৃষি পর্যায়ে বড় আঘাত এসে পড়বে। আবার পরিবহন এবং শিল্প উৎপাদন সর্বক্ষেত্রে ডিজেলের দাম প্রভাব তৈরি করবে। এতে করে জনজীবনে ব্যয় এক লাফে অনেক বেড়ে যাবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধি সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেন, হুট করে এত বেশি মূল্যবৃদ্ধির চাপ অর্থনীতি নিতে পারবে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির বিপক্ষে তিনি। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, কেরোসিনের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। আর ডিজেলের দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি দেয়া উচিত ছিল। ডিজেল দিয়ে বাস-ট্রাক চলে, বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। আবারো কৃষি ও অন্যান্য পণ্য পরিবহনের মতো খাতেও ব্যবহার করা হয়। কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ায় জনগণের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সরকার ঢোল পিটিয়ে বলছে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সক্ষমতা বিপুল বাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাজধানীতে দিনে কয়েকদফা বিদ্যুতের লোডশেডিং করতে হয়। গ্রামগঞ্জে লোডশেডিংয়ের অবস্থা ভয়াবহ। ২০১৪ সালে সমুদ্র বিরোধ মীমাংসার পর প্রতিবেশী মিয়ানমার নিজস্ব জলসীমায় গ্যাস উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে পারেনি। গত ২২ বছরে বাংলাদেশ গ্যাস অনুসন্ধান করেছে মাত্র ২৫টি। গ্যাসের নিজস্ব উৎসের খোঁজ পেতে আর তেমন কিছু করা হয়নি।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎসঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে দেশের শিল্পকারখানায় উৎপাদন কমে গেছে। বৈশ্বিক জ্বালানি সঙ্কটের কারণে ইতোমধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা সরব হয়েছেন। তারা বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট দীর্ঘমেয়াদি হলে, এভাবে লোডশেডিং চলতে থাকলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে। সিরামিক শিল্পে সার্বক্ষণিক গ্যাস প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র ১২ ঘণ্টা গ্যাস পাওয়া যায়। এভাবে চললে এ শিল্প রুগ্ন হয়ে পড়বে। বিদ্যুতের লোডশেডিং ও গ্যাস সঙ্কটে শিল্প খাতে স্থানাভেদে উৎপাদন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। ডলারের অস্থিরতায় ঋণপত্র খোলা অনিশ্চয়তায় কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেন যে, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দেশের অর্থনীতি বর্তমানে চাপের মুখে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, আমদানি বেশি হওয়া, রফতানি কমে যাওয়া, মূল্যস্ফীতির উচ্চ প্রবণতার কারণে অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। জুলাই মাসে প্রবাসীদের আয় ও রফতানি আয় ভালো হওয়ায় কিছুটা আশার আলো আছে। তবে ব্যাংক খাতে গভীরতা কম থাকায় তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়।

জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির ফলে মানুষের যখন দিশেহারা অবস্থা, ঠিক একই সময় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ইঙ্গিত দিয়েছেন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আবার বাড়ানো হচ্ছে। মাসখানেক আগে গ্যাসের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর নতুন প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ১২ বছরে দফায় দফায় দাম বাড়ানোর কারণে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ৯০ শতাংশ বেড়েছে।

এসব যন্ত্রণার সাথে সমাজের অবক্ষয়ও মানুষকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল, গণপরিবহনে ডাকাতি এবং গণধর্ষণের বিভীষিকা। সবমিলে জনজীবন যেন অক্টোপাসের থাবায় পড়েছে!

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
ই-মেইল : abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল