আইএমএফে ঋণের দরখাস্ত, উভয় সঙ্কটে সরকার!
- গোলাম মাওলা রনি
- ২৮ জুলাই ২০২২, ২০:৪৫, আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২২, ২০:৪৮
বেশি দিন আগের ঘটনা নয়- বড়জোর সপ্তাহখানেক আগেই খবরটি জাতীয় দৈনিকগুলোতে শিরোনাম হয়েছিল। খবরে বলা হয়েছিল যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের পরামর্শ মানবে না। খবরটি যেভাবে প্রকাশ পেয়েছিল ঠিক সেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কি না তা বলতে পারব না। তবে পত্রপত্রিকায় সেই শিরোনাম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। বরং অর্থমন্ত্রী বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন, আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য কোনো দরখাস্ত করা হয়নি এবং তার সেই বক্তব্যের এক সপ্তাহ পার না হতেই আমরা স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর বরাতে জানতে পারলাম যে, মোট সাড়ে ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে দরখাস্ত করা হয়েছে।
উল্লিখিত ঘটনার বরাতে আমরা আরো জানতে পারলাম যে, কেবল আইএমএফ নয়- এডিবির কাছে ১০০ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাংকের কাছে ৭০ কোটি ডলার ঋণের জন্য আবেদন জানানো হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। প্রথমটি হলো- আইএমএফের কিছু শর্ত থাকে এবং দেশের বর্তমান সঙ্কটকালে সেসব শর্ত পালন করা ছাড়া ঋণ পাওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, সরকারের চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলো খুবই ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে সেগুলোর নির্মাণকাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য বর্তমানে আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণের বিকল্প নেই।
আজকের নিবন্ধে আমরা অর্থমন্ত্রীর তাৎপর্যপূর্ণ দুটো মতামত নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের শ্রেণিচরিত্র এবং এসব সংস্থার সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টানাপড়েন সম্পর্কে কিছু কথা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া অবশ্যক। আমরা কমবেশি সবাই হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে জানি। তাকে বলা হয় পররাষ্ট্রনীতি, বিশ্বরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক ক‚টনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি। ইউরোপে রেনেসাঁর পর যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠেছে যার নিয়ামক হিসেবে যে আন্তর্জাতিকতাকে মান্য করা হয় সেই আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রবাদপুরুষ হিসেবে যদি গত শত শত বছরের মধ্যে সারা দুনিয়ার মাত্র সাতজন কীর্তিমান পুরুষকে বাছাই করা হয় তবে মিস্টার হেনরি কিসিঞ্জার তাদের মধ্যে অন্যতম হবেন।
আমরা অনেকেই অর্থাৎ আবেগপ্রবণ বাংলাদেশী লোকজনের বিরাট একটি অংশ হেনরি কিসিঞ্জারকে একজন মন্দ লোক হিসেবে জানি। কারণ তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বা তলাবিহীন ঝুড়ি বলে গালি দিয়েছিলেন। একটি দেশ ও জাতির জন্য এ ধরনের গালিগালাজ খুবই অবমাননাকর। কারণ তলাবিহীন ঝুড়িতে পৃথিবীর তাবৎ ধনসম্পদ হীরা-মণি-মুক্তা-জহরত ইত্যাদি রাখার সাথে সাথে তা ঝুড়ির তলায় যা রয়েছে সেখানে পতিত হয়। অর্থাৎ ঝুড়ির নিচে যদি দুর্নীতিবাজ লুটেরাদের পকেট অথবা লোভের লালাযুক্ত জিহ্বা থাকে তবে সব দান তাদের গহ্বরে চলে যাবে। তলাবিহীন ঝুড়ির নিচে যদি আবর্জনার ড্রেন, গভীর গিরিখাদ অথবা অব্যবস্থাপনার অন্ধকার থাকে তবে সমুদয় দান অতলান্তে হারিয়ে যাবে।
হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সেই সময়টিতে কথাটি বলেছিলেন যখন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং আফসোস করে বলেছিলেন, সারা দুনিয়া থেকে এত কষ্ট করে রিলিফ আনি আর চাটার দলেরা সব চেটে খেয়ে ফেলে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বক্তব্য হলো- সাড়ে সাত কোটি কম্বল এসেছে। আমার কম্বলটি গেল কই? বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছাড়াও আপনি যদি ১৯৭৩-৭৪-৭৫ সালের পত্রপত্রিকা যার বিরাট অংশ ছিল মুক্তিযুদ্ধপন্থী এবং আওয়ামী সমর্থক কিংবা রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, সেগুলোর প্রতিবেদন লক্ষ করেন তখন দেখবেন যে, দুর্নীতিবাজ আমলা-রাজনীতিবিদ এবং কালোবাজারিদের সিন্ডিকেটের দখলে চলে গিয়েছিল সব কিছু। লবণ চুরি, চিনি চুরি, ঢেউটিন চুরি, রেশন চুরি, ডলার চুরির মতো অসংখ্য ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রকাশ্য দিবালোকে হতো এবং বিচার চাওয়ার মতো লোক যেমন ছিল না বা বিচারপ্রার্থীকে যেমন খুঁজে পাওয়া যেত না, অনুরূপভাবে বিচার করার মতো লোকও ছিল না।
উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দান বা খয়রাতি সাহায্য হিসেবে যা এসেছিল বা আসত সেগুলোর করুণ পরিণতি দেখে দাতাদেশ বা সংস্থাগুলো রীতিমতো বিরক্ত-সংক্ষুব্ধ এবং অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। ঋণদাতারা ঋণ ফেরত পাওয়ার মতো কোনো আলামত না পাওয়ার কারণে যেমন একের পর এক কঠিন শর্ত আরোপ করেছিল তদ্রুপ বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের নানামুখী প্রচারণার কারণে বিশ্বমিডিয়া এমন সব নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করে চলছিল যা সামাল দেয়ার মতো মেধা-মননশীলতা এবং মঞ্চ তখনকার সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ছিল না। ফলে জনাব হেনরি কিসিঞ্জারের একটি গালি যেভাবে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা ফুটিয়ে তুলেছে তা থেকে আমরা এখন পর্যন্ত গালি খাওয়ার ৫০ বছর পরও বের হয়ে আসতে পারেনি।
হেনরি কিসিঞ্জার ছাড়াও আরেকটি গালি আমরা খেয়েছিলাম মুঘল জমানায়। বাদশাহ জাহাঙ্গীর আমার এই অঞ্চলটিকে বলেছিলেন ‘নেয়ামতে পরিপূর্ণ জাহান্নাম’, যা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে রীতিমতো একটি উপন্যাস রচিত হয়ে যাবে। সুতরাং ওদিকে না গিয়ে বরং আইএমএফসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থার সাথে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক টানাপড়েন নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলে তারপর আজকের শিরোনাম সম্পর্কে আলোচনা শুরু করব। বঙ্গবন্ধুর জমানায় তাজউদ্দীন আহমদ যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন তখন আইএমএফ প্রধান তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এবং গল্পটি এমন ছিল যে, তিনি আইএমএফ প্রধানকে সরাসরি সাক্ষাৎ দেননি অথবা তাকে বসার ঘরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর না পেরুতেই তিনি আইএমএফ সদর দফতরে গিয়ে কিভাবে নাজেহাল হয়েছিলেন, তা কমবেশি অনেকেরই জানা আছে।
বাংলাদেশের সফলতম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান অথবা এএমএস কিবরিয়ার ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তারা দলীয় পাণ্ডাদের প্রগাগান্ডায় অর্থনীতির সূত্র ভুলে যাননি। ফলে তাদের জমানায় আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থাগুলো নানা বাধা বিপত্তি সৃষ্টি করেছে বটে কিন্তু সময়মতো প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। কিন্তু ২০০৯ সালে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ মুহিত যখন অর্থমন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন তখন তিনি তার দু’জন সাবেক সফল সূরির পদাঙ্ক অনুসরণ না করে ‘বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াকে অতিক্রম করেছে’ ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডার কবলে পড়ে গেলেন। ফলে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি এবং আইডিবির মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে কেবল বাংলাদেশের দূরত্বই বাড়ল না বরং অনেক ক্ষেত্রে শত্রুতা শুরু হলো।
আমরা সবাই জানি, বিশ্বব্যাংক আইএমএফ মূলত মার্কিন মদদপুষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা। তারা তাদের স্বার্থ যেমন কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেয়- তদ্রুপ তাদের ঋণ ফেরত পাওয়ার শত গ্যারান্টিসহ যে প্রকল্পে তারা ঋণ প্রদান করে সেসব প্রকল্প এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যে, কেবলমাত্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ছাড়া দ্বিতীয় বা তৃতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান সেখানে কোনো নয়-ছয় করতে পারে না। এ কারণে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ সম্পর্কে শত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের শত্রুরাও বলতে পারবে না যে, কোনো দেশের মন্ত্রী-এমপি বা ক্ষমতাধর স্বৈরাচারীর দোসর এবং আত্মীয়রা বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের প্রকল্প থেকে পুকুর চুরি করতে পারে।
বাংলাদেশের যেসব মেগা প্রকল্পের অতিরিক্ত ব্যয় এবং সেসব প্রকল্পের দুনিয়া কাঁপানো দুর্নীতির কেলেঙ্কারি নিয়ে যেসব রসঘন আলোচনা বিশ্ব অর্থব্যবস্থার পরিমণ্ডলে হয় তার ফলে দেশের পুরো আর্থিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় হিসাব-নিকাশ নিয়ে যাচিত ও অযাচিত অনেক প্রশ্ন দিল্লি-বেইজিং-লন্ডন-নিউ ইয়র্ক-টোকিওতে উত্থাপিত হয়। এ দেশের বালিশ কেলেঙ্কারি, পর্দা কেলেঙ্কারি, কলাগাছ কেলেঙ্কারি নিয়ে দুর্নীতির যে মহাকাব্য রচিত হয়েছে তার ফলে ‘ন্যাশনাল ইনটিগ্রিটি’ নিয়ে আন্তর্জাতিক টেনশন এতদিন আমাদের কাবু করতে না পারলেও হাল-আমলে আমরা যে বিপত্তিতে পড়েছি সেই সুযোগ গ্রহণ করে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কী আচরণ করে তাই এখন দেখার বিষয়।
আলোচনার এই পর্যায়ে আমরা শিরোনাম প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে এবং সরকার আশা করছে, আইএমএফ তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিগগিরই একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে। সরকারের আশা যদি পূর্ণ হয় তবে আইএমএফ প্রথমেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মজুদকৃত স্বর্ণ এবং স্থানীয় টাকা ছাপানোর যে হিসাব তা দেখতে চাইবে এবং আমি নিশ্চিত যে, আইএমএফের যে মানদণ্ড বা হিসাবপদ্ধতি রয়েছে তা যদি অনুসরণ করা হয় তবে রিজার্ভের পরিমাণ এতটা কমে যাবে যা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকের লেনদেন, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরসহ অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাতের যে হিসাব গত ১২ বছর ধরে যেভাবে তৈরি করা হচ্ছে তা যদি নতুন করে আইএমএফ সূত্রে অডিট করা হয় তবে পুরো আর্থিক খাতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।
দ্বিতীয়ত, সরকার তার বার্ষিক বাজেটে সাপোর্ট এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য যদি ঋণ চায় তবে তাদের সবার আগে সরকারি ব্যয় কমাতে হবে। আমলানির্ভর আওয়ামী লীগের পক্ষে সরকারি ব্যয় কমানো এক দিকে অসম্ভব, আর অন্য দিকে আত্মহত্যার মতো ঘটনা। দ্বিতীয়ত, তারা অর্থাৎ যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অর্থ দাবি করছে সেসব প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ, ব্যয়, মেয়াদকাল এবং চলমান প্রক্রিয়া দেখলে আইএমএফ ঋণ দেয়া তো দূরের কথা বরং উল্টো তারা যে কাণ্ড ঘটাবে তা উন্নয়নের গোদে নয়া বিষফোঁড়ারূপে নতুন ব্যথা বেদনার সৃষ্টি করবে।
ধরুন, সরকার আইএমএফের সব দাবি মেনে ঋণ পেতে চাইল। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতি-অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার যেসব গুজব এখন দিনে রাতে ডালপালা বিস্তার করে চলেছে সেগুলো দলিল বা শ্বেতপত্ররূপে দেশ-বিদেশে প্রচারিত হতে থাকবে। অন্য দিকে, এত কিছুর পরও যদি আইএমএফ ঋণ না দেয় তাহলে কী হবে! আমরা কি আগের মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারব যে, দেশ এখন সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে? সুতরাং কোনো বিদেশী ঋণ দরকার নেই- বরং আমরাই এখন অন্য দেশকে ঋণ দেবো।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা