শিক্ষক নির্যাতন
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ২৪ জুলাই ২০২২, ২০:৩৯, আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২২, ২০:৪১
সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সৃষ্টি এবং শিক্ষা দুটোকেই একীভূত করা হয়েছে। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে যত নবী রাসূল এসেছেন সবাই শিক্ষকের ভ‚মিকা পালন করেছেন। সক্রেটিস বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান বিতরণের যে সূচনা করেছিলেন তা আজ প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নিয়েছে। এককালের ঐচ্ছিক শিক্ষার প্রধান, দীক্ষা আজ শিক্ষার পেশায় উন্নীত হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষকতা। তারা সমাজ ও জাতিকে এক দিকে আলোর পথে ডেকেছেন। অপর দিকে অন্ধকারের বুক চিরে সভ্যতাকে আলোর দিশা দিয়েছেন। কুসংস্কার ও ক‚পমণ্ডূকতার ঘেরা টোপ থেকে মানবসমাজের উত্তরণ ঘটিয়েছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করেছেন। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। বিকশিত করেছেন সমাজ ও সভ্যতাকে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষকেরা নিঃস্বার্থভাবে এটা করে এসেছেন।
সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যারাই জাতি গড়ার কারিগর ছিলেন সবাই ছিলেন শিক্ষক। শিক্ষক নেতা নন। কিন্তু তারা নেতা তৈরি করেন। তৈরি করেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার প্রয়োজনীয় জনশক্তি। দেশ ও সমাজকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করার অন্যতম প্রধান কারিগর শিক্ষকসমাজ। আমরা যদি ইসলামের প্রথম প্রত্যাদেশের দিকে তাকাই সেখানেও দেখা যায় জ্ঞানার্জনের কথাই বিবৃত। ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন এক মাংসপিণ্ড থেকে।’ এভাবে ইসলাম ধর্মে প্রথম বাণীতেই সৃষ্টির সূচনা ও জ্ঞানকে একীভূত করা হয়েছে। উচ্চকিত করা হয়েছে জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তাকে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান অর্জনের তাগিদ স্বয়ং মহানবী সা: দিয়েছেন। শিক্ষক জ্ঞানের ধারক ও প্রচারক। শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনের তাগিদ প্রতিটি ধর্মবিশ্বাসে রয়েছে। ‘যে শিক্ষককে (জ্ঞানী) সম্মান করল সে আমাকেই সম্মান করল। যে আমাকে সম্মান করল সে আল্লাহকে সম্মান করল।’ মহানবী সা:-এর এই ঘোষণা শিক্ষক সমাজকে শ্রদ্ধাবোধের চরম শিখরে তুলে দিয়েছে। হিন্দুশাস্ত্রে গুরু পরম শ্রদ্ধেয়। বৌদ্ধধর্মে, মহামতি বৌদ্ধ নিজেই শিক্ষক ছিলেন।
যারা সভ্যতার শুরু থেকে মানবজাতিকে দিশা দিয়েছেন, দেখিয়েছেন সত্য ও সুন্দরের পথ, সভ্যতার ক্রমপরিক্রমায় ভ‚মিকা রেখেছেন এবং রাখছেন তারা পরম শ্রদ্ধেয়, তারাই শিক্ষক। মানবসভ্যতা তাদের কাছে ঋণী। তাদের মর্যাদা তুলনাহীন। সম্রাট আলমগীর শিক্ষকের মর্যাদার এক অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক এবং কবি আল্লামা ইকবাল ‘স্যার’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তার শিক্ষক মৌলভী মীর হাসান আলীকে ‘শামসুল উলামা’ উপাধি দেয়ার আগ পর্যন্ত। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. আবদুস সালাম তার শিক্ষক মি. গাঙ্গুলীকে খুঁজে বের করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন। এ কারণে তিনি তার নোবেলপ্রাপ্তির কথাটা নিজেই তার শিক্ষককে জানাতে চেয়েছিলেন। এটা আসলে শিক্ষকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ। ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে মেধাবীরা শিক্ষকের পেশায় নিয়োজিত। আমাদের দেশে এর উল্টো। ফলে শিক্ষকদের সবসময় নতজানু হয়ে থাকতে হয় তাদেরই সৃষ্ট সিইও, আমলা, ব্যবসায়ী, মন্ত্রী, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে। অথচ এই শিক্ষকেরাই আমাদের চিন্তার বিকাশ, মানবিক গুণাবলির উন্মেষ, দেশপ্রেম শিক্ষা দিয়ে জীবনের সাথে পরিচিত করেন। অর্থ বা ক্ষমতার দিক থেকে তারা বড় নন। কিন্তু মহত্ত¡ ও মর্যাদায় তারা সবার উঁচুতে। ম্যানকে হিউম্যান বানানোর কারিগর তারাই। এর বিপরীতে যখন দেখা যায় শিক্ষক লাঞ্ছনা, শিক্ষকের অপমান, শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা এবং মহিলা শিক্ষিকাকে কটূক্তি ও অপমান নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন দুঃখে বেদনায় হৃদয় নীল হয়ে যায়। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কিছু দিন আগেও তো শিক্ষকরা ছিলেন সমাজের শ্রদ্ধার পাত্র। অথচ আজ তাদের হাতে তৈরি ছাত্ররাই ‘ফ্রাংকেন স্টাইন’ হয়ে তাদের লজ্জা ও অপমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে সুশীল বোদ্ধারা নিন্দা করেছেন, প্রতিকার চেয়েছেন, রাস্তায় নেমেছেন, সভা সমাবেশ করেছেন। কিন্তু দৃশ্যত কোনো প্রতিকার দেখা যায়নি। মৌলিক গলদটা হচ্ছে, নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা। যে শিক্ষা মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায় না, শিশুকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখায় না, ন্যায় অন্যায়বোধের উন্মেষ ঘটায় না, বয়োজ্যেষ্ঠদের শ্রদ্ধা করতে শেখায় না, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও পৃথিবীর বৃহত্তর পরিসরের সাথে পরিচয় ও খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা সৃষ্টি করে না, ব্যক্তিত্ব তৈরিতে সাহায্য করে না, তার অনুসরণে বিষময় ফল আমরা দেখছি। শুধু শিক্ষক নির্যাতন নয়, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, ছিনতাই অহরহই ঘটছে এ কারণে। সমাজের প্রভাবশালীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় এবং আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও অনেকটাই দায়ী। এ ক্ষেত্রে শুধু প্রতিবাদ করে, নিন্দা জানিয়ে, রাস্তায় নেমে, সভা-সমাবেশ করে সাময়িকভাবে এটা প্রশমিত হতে পারে, কিন্তু সময় সুযোগ বুঝে ক্যান্সার রোগের মতো আবার মাথাচাড়া দেবে ঠিকই। এ ক্ষেত্রে পরিত্রাণ পেতে হলে শিক্ষকদের সোচ্চার হতে হবে, সুশীলসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে চিন্তাবিদদের ও সমাজপতিদের নীতিনৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধ সম্বলিত শিক্ষার প্রচলনের দাবিতে। এটা না হলে শিক্ষক নির্যাতন দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা