২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগল না

-

একটি দেশের জনসংখ্যা সম্পদ না বোঝা, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের তর্ক বহুদূর গড়িয়েছে। ম্যালথাস অবশ্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে বিপদই দেখতে পেয়েছেন। এ বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানীদের অনেক ভিন্নমত রয়েছে। এই বিতর্কে জড়ানোর আগে আমরা দেখি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড, যাকে বাংলায় জনবৈজ্ঞানিক মুনাফাও বলা যায়, সেটি আসলে কী।

সাধারণ কথায় বলা যায়, যখন কোনো দেশের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী একটি কর্মক্ষম বয়সের মাঝে অবস্থান করে তাকে এই অভিধা দেয়া হয়। জাতিসঙ্ঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কোনো দেশের কর্মক্ষমতাহীন মানুষের চেয়ে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি থাকে এবং সেটি যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তখনই তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। এখানে কর্মক্ষম মানুষের নির্ধারক হচ্ছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪, আর কর্মক্ষমতাহীন মানুষ বলতে বোঝায় ১৪-এর নিচের এবং ৬৫-এর বেশি বয়সের মানুষকে।

অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত একটি দেশ; তবে আসলেই তা কি না সেটিই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছর। একদিকে জনসংখ্যার আধিক্য ঠেকাতে পরিকল্পিত পরিবারের আহ্বান, অন্যদিকে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গর্ভকালীন মায়ের মৃত্যুহার হ্রাস ইত্যাদি কারণেই ঘটে থাকে এই সুবিধা প্রাপ্তি এবং এই কর্মযজ্ঞ একদিনের নয়। আর এটিই হচ্ছে ম্যাজিকেল স্ট্যান্ড যেখানে এক নম্বর সমস্যা হয়ে যায় এক নম্বর সুবিধা। এক সময়ের জনাধিক্য অন্য সময় জনমুনাফা। প্রকৃতির কী খেলা। আসলেই কী এটি প্রকৃতির খেলা নাকি একটি দেশের পরিকল্পিত কাঠামোর অংশ; সে বিতর্কে না হয় নাই বা গেলাম। এটি পাঠকরাই ঠিক বুঝে নিক।

তবে এটি বলা যায়, যেহেতু এদেশের বেশির ভাগ মানুষ (৬৮ শতাংশ) এখন কর্মক্ষম বয়সের সীমায় তাই বাংলাদেশ এই প্রাকৃতিক সুবিধার আওতায় আছে। বলা হয় এই সুবিধা কোনো একটি দেশে কেবল একবারই আসে এবং এর স্থায়িত্ব ধরে নেয়া হয় ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো, এরপর কী হবে; হিসাবটা খুব সহজ। এই ৩০-৩৫ বছর পর কর্মক্ষম ওই মানুষগুলোর প্রায় সবাই বৃদ্ধ হয়ে কর্মক্ষমতাহীন হয়ে যাবে। সুতরাং কর্মশক্তিহীন হওয়ার আগে এই মানুষগুলোর কর্মের সুবিধাগুলো নিতে প্রস্তুত হতে হবে।

প্রশ্ন হলো, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড স্বয়ংক্রিয় কি না। না, স্বয়ংক্রিয় নয় বরং সঠিক নীতি পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো- কিছু দেশ কিভাবে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সর্বাধিক সুবিধা লাভ করে এবং কেন অন্যরা পারে না? এর জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন আছে কি না? আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এর জন্য আবার তেমন পরিকল্পনার কী দরকার? বাস্তবে পরিকল্পনা দরকার আছে, কারণ চীনের মতো দেশ এখন তারুণ্য সঙ্কটে ভুগছে। তাদের কর্মক্ষমহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে অনেক এবং এটিই এখন তাদের জন্য বিরাট সমস্যা ও জাতীয় ভোগান্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শুধু চীন নয়, জাপান, পশ্চিমা অনেক দেশ, বিশেষ করে ইউরোপজুড়ে এখন কর্মক্ষম মানুষের বড্ড অভাব। পাশাপাশি বৃদ্ধ মানুষের পেছনে রাষ্ট্রকে বিনিয়োগ করতে হয় অনেক। তাদের চিকিৎসা ও ভরণপোষণই হয়ে যায় প্রধান খরচের জায়গা, যেখান থেকে রিটার্ন আসে না। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬ শতাংশ যাদের অর্ধেক ছিল নারী; যারা ঘরে বসে থাকত। অর্থাৎ ২০-২২ শতাংশ মানুষ টেনে নিয়ে চলেছিল বেশির ভাগ জনগোষ্ঠীকে। আর কর্মক্ষমতাহীনের সংখ্যা ছিল ৬৪ শতাংশ। এখনও আমাদের দেশে কর্মক্ষমতাহীন নারীর সংখ্যা অনেক কম। নারীরাও এখন আয়-রোজগার করছে, সংসার চালাচ্ছে। জাতীয় আয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে অনেকগুণ। এমনকি বিদেশে শ্রমবাজার গড়ে উঠেছে বিশাল।

জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে একটি সহজ সম্পর্ক বিশ্বের ১২৪টি দেশের ১৯৫০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এই বিষয়ের তথ্য দিয়ে স্ক্যাটার-প্লট করে গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক থেকে পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশের সাথে তুলনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের তুলনায় মালয়েশিয়া অনেক বেশি সুবিধা ভোগ করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো- দেশটি এখনো জনসংখ্যাগত লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে পারেনি এবং সময়ের সাথে সাথে সুযোগ সীমা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ করে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায়, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য তাদের বয়সের কাঠামোর পরিবর্তনগুলো সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল। এর অন্যতম কারণ, তারা যুব উন্নয়নে বিনিয়োগ, পরিবার পরিকল্পনায় প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ, অবকাঠামোতে বিনিয়োগ, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিশেষ করে নারীশিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন ঠিকমত করতে পেরেছিল। এ ছাড়াও, শ্রম-নিবিড় ও দক্ষতা-নিবিড় কাজ, সঞ্চয়, বাণিজ্য এবং বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ততার ওপর জোর দিতে পেরেছিল।

পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ মানবসম্পদ উন্নয়নে, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, তাদের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সময় উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বেশির ভাগ নাগরিক কাজ করে। পাবলিক শিক্ষাব্যয় ও মাথাপিছু জিডিপির পৃথিবীর ৪০টি দেশের তুলনা করে দেখা যাচ্ছে- মাথাপিছু লগ জিডিপির স্তরের লাইন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলো থেকে আলাদা করে। এই ৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সকারী দেশ। কারণ জিডিপির শতাংশ (প্রায় ২ শতাংশ) হিসাবে শিক্ষার ওপর জনসাধারণের ব্যয় সমস্ত উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের তুলনায় অনেক কম ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের বেশির ভাগ দেশের চেয়েও কম আয়ের দেশ।

অধিকন্তু, বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। দেশে শত শত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে যার মুখ্য উদ্দেশ্য যেন ব্যবসায়িক, শিক্ষা নয়। লেখাপড়ার মান খুবই নিম্ন। এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারীরা তেমন কোথাও কর্মের ব্যবস্থা করতে পারে না। ফলে, অনেক অগ্রহণযোগ্য কাজ করে যা দেশ ও সমাজের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এমনকি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মানও আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন রাজনৈতিক মঞ্চ। পড়ালেখা নেই বললেই চলে, ফলে মানহীন এ সনদধারী শিক্ষিতরা কর্মের ব্যবস্থা করতে না পেরে চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, মারামারি, খুনখারাবি করে বেড়ায়। এরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না, ফলে এরা পরিবার ও সমাজের জন্য একটি বোঝা।

জিডিপিতে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের মাত্র ১.২ শতাংশ অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। মজার বিষয় হলো- স্বাস্থ্যব্যয় ও মাথাপিছু জিডিপি এর মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক মূলত শিক্ষাব্যয় এবং মাথাপিছু জিডিপি এর চেয়ে শক্তিশালী বলে মনে হয়।

অভিজ্ঞতা বলে যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শিক্ষাব্যয়ের চেয়ে স্বাস্থ্যব্যয় তুলনামূলক আরো দ্রুত ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার মান এতই খারাপ হয়েছে যে, ছোটখাটো চিকিৎসার জন্যও বিদেশ যেতে হয়। সামর্থ্যহীনরা বিনা চিকিৎসা অথবা মানহীন চিকিৎসা এমনকি ভুল চিকিৎসা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে। অব্যবস্থা, দুর্নীতি দেশের চিকিৎসাব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। ফলে অসুস্থ ও ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী এই মানুষগুলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা ভোগ করতে পারছে না।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের জন্য দু’টি সমালোচনা রয়েছে। প্রথমত, জিডিপির শতাংশ হিসাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের জন্য বর্তমান বরাদ্দ তাদের বর্তমান নগণ্য মাত্রা, চীন ও মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে, প্রায় দ্বিগুণ করা দরকার। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয়ের দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিছু দেশ আছে (নিম্ন-মধ্যম আয় এবং উচ্চ-মধ্যম আয় উভয় বিভাগেই) যারা বাংলাদেশের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের অনুরূপ অনুপাতের সাথেও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি জিডিপি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

আগেই বলেছি, জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সফল সুবিধাভোগকারী হলো পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। ওই দেশগুলো অন্যান্য দেশের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির সহযোগিতা নিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগিয়ে উপকৃত হয়েছিল। এশিয়ান টাইগাররা যে উপযুক্ত সামাজিক ও অর্থনৈতিক নীতির কারণে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের সুবিধা নিতে সক্ষম হয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ততা, নমনীয় শ্রমবাজার এবং শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যসহ মানব পুঁজিতে যথেষ্ট ও অব্যাহত বিনিয়োগ। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ১৯৬৫ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের কারণেই পেয়েছিল।

বাংলাদেশে, ২০০০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, মোট শ্রমজীবী জনসংখ্যা এবং মোট শ্রমশক্তি বার্ষিক প্রায় দুই মিলিয়ন করে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও, মোট কর্মসংস্থান বার্ষিক মাত্র ১.৫ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে তুলনামূলকভাবে সীমিতসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার কারণে বেশির ভাগ বৃদ্ধি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। বাংলাদেশের কর্মসংস্থান কাঠামো, নিম্ন-উৎপাদনশীলতা, কম মজুরি ও অনানুষ্ঠানিক খাত (মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশ শোষণ করে) এর প্রাধান্য থাকায় দারিদ্র্য হ্রাসে খুব বেশি অবদান রাখতে পারছে না।

অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো, বাংলাদেশের বেকারত্বের হার অনেক বেশি (১৭-৩৪ শতাংশ), যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের চাকরির ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো অনিশ্চিত। অর্থনীতি যদি তার কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতা বাড়াতে না পারে, তাহলে বেকার ও নিম্ন-কর্মসংস্থানের সংখ্যা শিগগিরই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।

দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলে, সাধারণভাবে, দ্রুত বর্ধনশীল এশীয় দেশগুলোর জন্য পুঁজির সমৃদ্ধি ও উৎপাদন দক্ষতার উন্নতি ছিল দু’টি প্রধান উৎস। ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়া পুঁজির সমৃদ্ধির ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে। বাংলাদেশে শ্রমিকপিছু মূলধন এই দেশগুলোর মতো এতটা সমৃদ্ধ হয়নি। এ ছাড়াও, বাংলাদেশী শ্রমিকদের নিম্ন দক্ষতার স্তর ও সংশ্লিষ্ট নিম্ন শ্রম উৎপাদনশীলতা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভালো চলছে কিন্তু বর্তমানে প্রায় ১০ মিলিয়ন লোক কর্মহীন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।

পোশাক শিল্পের বাইরেও বাংলাদেশকে আরো দ্রুত শিল্পায়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং কর্মীদের আরো সামাজিক সুরক্ষাসহ প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিতে স্থানান্তর করতে হবে। গার্মেন্ট শিল্পের কিছু উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ন্যূনতম মজুরি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা ও উন্নত নিরাপত্তাবিধি প্রয়োগ করা ইত্যাদি।

যদিও সূত্র মতে দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে, বিদেশী কাজের প্রতি টান বাংলাদেশে রয়ে গেছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত রেমিট্যান্স ২০১৫ সালে ১৫ বিলিয়ন ডলার যা মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ, যা ২০০০ সালে দুই বিলিয়ন ডলারের চেয়েও কম ছিল। বর্তমানে রেমিট্যান্স অর্থনীতির একটি প্রধান চালক হয়ে উঠেছে। দেশের প্রায় অর্ধ মিলিয়ন মানুষ প্রতি বছর বিদেশে চাকরি খুঁজে পায়। কিন্তু বিদেশে কাজের অর্থনৈতিক প্রভাব সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে না। নিয়োগ ফি, মধ্যস্থতাকারীদের কমিশন বাণিজ্য, অভিবাসনের উচ্চ খরচ ও বিদেশ যাওয়ার খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বিদেশে যাওয়ার সুযোগ কমে যাচ্ছে। বিদেশী নিয়োগ প্রক্রিয়ার অব্যাহত সরকারি তদারকি প্রয়োজন।

জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ সাধারণত ৩০ থেকে ৩৫ বছর ধরে চলতে থাকে। লভ্যাংশ সাধারণত একটি দেশের জন্য একবার আসে। তবে, যদি জন্মহার আগের মতোই কমতে থাকে, তাহলে শ্রম সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে লভ্যাংশ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেতে পারে। সরকার কিছু উদ্যোগ নিলেও জনশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে আমরা ইতোমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি। সরকারের উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগসহ বহু খাতে ফোকাস করা। শিক্ষা হতে হবে দক্ষতা ও বাজারমুখী, সার্টিফিকেটনির্ভর নয়।

রফতানি, বেসরকারি ও সরকারি খাতের সম্প্রসারণ এবং স্ব-উদ্যোক্তার সুযোগ সৃষ্টির অভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হারিয়ে যাবে। কারণ দেশের কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার বর্তমান বৃদ্ধি আগামী এক দশক বা তারও বেশি সময়ের মধ্যে বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে রূপান্তরিত হবে। বাংলাদেশ যে বর্তমান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড উপভোগ করছে তার থেকে সেরাটা তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এর মাধ্যমে একটি পেনশন তহবিলের ব্যবস্থা করার সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে পারে যা বয়স্কদের প্রয়োজনে কাজে লাগবে। প্রকৃতপক্ষে, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কর্মচারীদের জন্য বাংলাদেশের বীমা কোম্পানিগুলোকে সম্পৃক্ত করে পেনশন ও অন্যান্য অবসর তহবিল তৈরি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই এর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। অন্যথায়, বিষয়গুলো সম্ভবত আরো খারাপের দিকে মোড় নিতে পারে।

গত দুই বছরের করোনা অতিমারী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে আরো চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। তার ওপর বিশ্বব্যাপী চলছে যুদ্ধের দামামা, কমছে বিদেশের কর্মের সুযোগ, দেশের অনেক শিল্পকারখানাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম, ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়ছে। ফলে, বাড়তি জনসংখ্যা দেশের জন্য সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে; আগামী ১০-১৫ বছর পরে এই টোটাল জনসংখ্যাই দেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে যাবে। সুতরাং এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement