স্বৈরশাসকদের পরিণতি
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ১৯ জুলাই ২০২২, ২০:৪১
নানা কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের আবির্ভাব ঘটে। কখনো কখনো এসব স্বৈরশাসকের উত্থান শুরু হয় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। কখনো কখনো এরা বিপুল ভোটে জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়। মানুষ অনেক আশা নিয়ে তাদের ভোট দেয়। একবার, দুইবার। ক্ষমতা পেয়ে স্বৈরশাসকরা ক্রমেই উন্মত্ত হয়ে ওঠে। তারপর জনগণের ওপর চালাতে থাকে নানা ধরনের নির্যাতন। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি তখন তাদের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। যে জনগণ তাদের ভোট দিয়েছে, তাদের সামান্য সমালোচনাও আর সহ্য করতে পারে না। নতুন নতুন নিবর্তনমূলক আইন জারি করে। তারপর জনগণের ওপর চলে নির্যাতনের স্টিমরোলার। প্রথম দিকে জনগণ নীরব থাকলেও আস্তে আস্তে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। স্বৈরশাসকদের নির্যাতনের ভয়ে যদি বা কথা বলতে না পারে, তাহলে ভেতরে ভেতরে বলক তোলা পানির মতো ফুঁসতে থাকে। শেষপর্যন্ত ঘটে গণবিস্ফোরণ। সে বিস্ফোরণে বৈশাখের শিমুল তুলার মতো উড়ে যায় স্বৈরশাসকেরা, ঘটে বিপ্লব।
ইতিহাসে এর নির্মম সাক্ষ্য রয়েছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী নিন্দিত এডলফ হিটলার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন। তারপর তার অপশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল জার্মানি, তখন তিনি নিজের জনগণকে দমনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন নিপীড়নকারী গেসটাপো বাহিনী। তাদের হাতে দেয়া হয়েছিল অপরিসীম ক্ষমতা। হিটলারের সামান্য বিরোধিতায়ও তাদের খুন বা গুম করে ফেলা হতো। কোনো বিচার ছিল না। বিচারব্যবস্থাও নিয়ন্ত্রণ করতেন হিটলার নিজে। ফলে জার্মানি এক নরকে পরিণত হয়েছিল।
হিটলারের দম্ভ ও লোভে লেগে গিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে সারা পৃথিবীতে ছয় কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছিল। তখন হিটলারকে ধরার জন্য জার্মানবাসী ও সারা বিশ্ব একাট্টা হয়ে অভিযান পরিচালনা করেছিল। পালানোর কোনো পথ পাচ্ছিলেন না হিটলার। শেষপর্যন্ত এক অন্ধকার গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরিণতিতে জার্মানি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল জার্মানি। সেই ধ্বংসস্ত‚প থেকে উঠে দাঁড়াতে জার্মানির দীর্ঘ সময় লেগেছিল। আর স্বৈরশাসক হিসেবে হিটলার এখনো বিশ্বব্যাপী ঘৃণিত একটি নাম।
পৃথিবীতে হিটলারের আগে-পরেও অনেক ছোটখাটো স্বৈরশাসকের জন্ম হয়েছিল। তাদেরও হিটলারের পরিণতিই বরণ করতে হয়েছিল। সাম্প্রতিককালে ইরানে এসেছিলেন আরেক স্বৈরশাসক রেজা শাহ্ পাহলভী। ১৯১৯ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেছিলেন রেজা শাহ। তিনি লেখাপড়া করেছেন সুইজারল্যান্ডে। তার বাবা রেজা শাহ ইরানের শাহ বা বাদশাহ ছিলেন। তিনি প্রথম বিয়ে করেন মিসরের বাদশাহ ফারুক-১-এর বোনকে। কিন্তু ১০ বছরের মধ্যে তাদের বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর তিনি আরো তিনটি বিয়ে করেন। পিতার কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি ইরানে নির্বিচার স্বৈরশাসন চালাতে থাকেন।
ইরানের ইসলামিক সমাজে তিনি ক্রমেই পশ্চিমা ধাঁচের সংস্কৃতি ও জীবনাচার প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। কিন্তু তার এই নীতি তেহরানে বল প্রয়োগের মাধ্যমে যতটা কার্যকর করা গিয়েছিল, তেহরানের বাইরে তা মোটেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তেহরানে নারীরা পরতেন পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক-আশাক। পর্দা-পুশিদা বলতে কিছু ছিল না। তাই গ্রামের মানুষ বা ছোট শহরগুলোর মানুষ শাহ ও তেহরানবাসীকে ঘৃণা করতে শুরু করে। তেহরানে তিনি চালু করেন সুইমিংপুল, ডিসকোথেক। বেশির ভাগ হোটেলে চালু করেছিলেন প্রায় নগ্ননৃত্য। পর্দা করা নারীরা তেহরানে নিষিদ্ধ ছিলেন। তারা সেখানে যেতেনও না। মদ্যপান সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ খবর যাতে ছোট শহর বা গ্রাম-গ্রামান্তরে ছড়িয়ে না পড়ে, তার জন্য তিনি তেহরান আগমনকারীদের জন্য পাসের ব্যবস্থা করেন। পাস থাকলে তেহরান ঢোকো, না থাকলে ফিরে যাও। শাহ নিজেও থাকতেন ভোগ-বিলাসে মত্ত। তিনি গড়ে তুলেছিলেন সম্পদের পাহাড়।
শাহ হিটলারের মতোই গড়ে তুলেছিলেন সাভাক বাহিনী। কেউ শাহের শাসনের বিরোধিতা করলে এই গুপ্ত বাহিনী তাকে খুন বা গুম করে ফেলত। সাভাক বাহিনী শুধু তেহরানেই তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল সাভাকের নির্যাতন। ফলে শাহের শাসন ইরানিদের জন্য ছিল আতঙ্কের নাম। ইরানের ধর্মপ্রাণ মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছিল। তাদের নেতা ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি। শাহের নির্যাতনে তিনি ফ্রান্সের এক ছোট গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখান থেকে ইরানবাসীর করণীয় সম্বন্ধে নির্দেশনা দিতে থাকেন। সে নির্দেশনা স্ফুলিঙ্গের মতো গোটা ইরানে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শাহ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ২২ বছরেরও কম। একটি পুত্রসন্তানের আশায় তিনি একের পর এক বিয়ে করতে থাকেন। অবশেষে চতুর্থ স্ত্রীর ঘরে তার একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে।
এ দিকে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাকে ইরানে বিপ্লব দানা বাঁধতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত গোটা ইরান শাহের শাসনের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। কম বয়সী শাহ নিজেও যেমন অপরিপক্ব ছিলেন কিন্তু পরিপক্ব মন্ত্রীদের পরামর্শের কোনো মূল্য দেননি। ফলে তিনি সেনাবাহিনীর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ১৯৪৯ সালে শাহকে হত্যার একটি পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইরানে মার্কিনপন্থী দল যেমন ছিল তেমনি রুশপন্থী দলও ছিল। শাহ মার্কিনপন্থী দলগুলোকে মদদ দেন এবং নিজে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝান যে, ইরানে মার্কিন স্বার্থ রক্ষায় তার কোনো বিকল্প নেই। একই সাথে তিনি সোভিয়েতপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ওই সব দলের প্রতি সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সাড়া ছিল না।
মানুষকে শান্ত করার জন্য তিনি রাজনৈতিক সংস্কার করেন। মেয়েদের ভোটাধিকার দেন, ভূমি সংস্কারেরও উদ্যোগ নেন। শিক্ষা কার্যক্রমও জোরদার করেন। তার এসব পদক্ষেপের ফলেও ধর্মীয় নেতারা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ১৯৭৬ সালে তিনি ইসলামিক ক্যালেন্ডার বদলে রাজকীয় ক্যালেন্ডারের প্রবর্তন করেন। তিনি এক ধরনের নির্বাচন চালু করার চেষ্টা করেন, তবে তাতে কোনো ফলোদয় হয়নি। ’৭০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি ক্রমেই জনগণের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকেন। সাভাক বা তার অনুগত লোকজন দিয়েও তার শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ডাকে ইরানে বিপ্লব ঘটে যায়। শাহ তখন একটি বিমানে করে তার পরিবার পরিজন নিয়ে কোনো দেশে আশ্রয়ের জন্য ঘুরতে থাকেন। প্রথমে তিনি যান বাহামায়। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যান আশ্রয়ের জন্য।
তখন ইরানের ছাত্র ও ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ ওই বছরই জানুয়ারি মাসে তেহরানের মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করে ৫০ জন মার্কিনিকে জিম্মি করে ফেলে। তারা ওই ৫০ জনকে ৪৪৪ দিন আটকে রাখে। যুক্তরাষ্ট্র তখন শাহকে তাদের দেশ থেকে সরিয়ে দেয়। শাহ চলে যান মিসর। গুরুতর ক্যান্সারে আক্রান্ত ইরানের শাহ ১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই মিসরে ইন্তেকাল করেন।
এখন আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরছেন আরেক স্বৈরশাসক শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তিনিও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শ্রীলঙ্কায় গণতান্ত্রিক শাসন চলছে, কখনো সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেনি। এর মধ্যে উত্থানপতন ছিল, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু রাজাপাকসের পরিবার প্রায় সব সময়ই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। গোল বাধল করোনা মহামারীর সময় থেকে। শ্রীলঙ্কার প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন; কিন্তু করোনার কারণে সে শিল্পে ধস নেমেছে।
কোনো পথেই রাজাপাকসেরা তার সমাধান বের করতে পারেননি। বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট, খাদ্য সঙ্কট, জ্বালানি সঙ্কটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষ। জনগণকে দেখানোর জন্য সরকার অনেক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল; কিন্তু তার বেশির ভাগই টাকার অভাবে অসম্পূর্ণ পড়ে আছে। জ্বালানি তেল কেনার পয়সাও নেই। ফলে সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। শ্রীলঙ্কানরা এখন এক দিন খেলে আরেক দিন না খেয়ে থাকে। স্কুল কলেজ বন্ধ। অফিস আদালত বন্ধ। বরং ঋণ দেয়ারও কেউ নেই। শ্রীলঙ্কার সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছিল। ঋণ পাওয়া যায়নি। শ্রীলঙ্কাবাসী একযোগে রাস্তায় নেমে আসে।
তারা দখল করে নেয় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। আগুন জ্বালিয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে। গোতাবায়ার বেডরুমে ঢুকে সেখানে শুয়ে থাকে। তাদের পারিবারিক সুইমিংপুলে সাঁতার কাটে। এ ছাড়া সরকারের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা সবাই রাজাপাকসে পরিবারের সদস্য, এগুলো মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে বিপ্লব হয়ে গেছে শ্রীলঙ্কায়। দেশ এখন জনতার দখলে। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সেনাবাহিনীকে গুলি চালানোর; কিন্তু গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা জনগণকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছে।
তখন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। কিন্তু বিমানবন্দরের কর্মচারীরাই তাকে আটকে দেয়। তারপর তিনি বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি সেনা ছাউনিতে আশ্রয় নেন। কোথায় পালাবেন? ভারতে ঢুকতে চেয়েছিলেন। ভারত রাজি হয়নি। শেষে নৌবাহিনীর একটি বিমানে করে তিনি স্ত্রী ও দুই দেহরক্ষী নিয়ে যান মালদ্বীপে। কিন্তু সেখানে অভিবাসী শ্রীলঙ্কান ও মালদ্বীপবাসী গোতাবায়ার উপস্থিতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকেন। বিপাকে পড়ে মালদ্বীপ সরকার। গোতাবায়া তখন মালদ্বীপ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান। সেখানেও আশ্রয় মেলেনি। এখন তিনি যাওয়ার চেষ্টা করছেন জেদ্দা কিংবা দুবাই। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত ওই দুই দেশেরও অনুমতি পাওয়া যায়নি। এখন কোথায় যাবেন গোতাবায়া রাজাপাকসে?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা