২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

অন্ধকূপের অসারতা

অন্ধকূপের অসারতা - ফাইল ছবি

ইতিহাসের এক মহানায়ক ছিলেন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তিনি ইতিহাসের এক ভাগ্যহত বীর! চার-চারটি যুদ্ধের সফল সেনানায়ক শহীদ সিরাজ একটি ষড়যন্ত্রমূলক ও প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মর্মান্তিকভাবে শহীদ হয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব ছিলেন মীর জাফর, জগৎশেঠ ও উমিচাঁদ গং। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে শহীদ সিরাজের চেতনার যেমন মৃত্যু হয়নি; তেমনিভাবে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রও অব্যাহত রয়েছে। পলাশীর ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধকে কিছুটা হলেও লঘু করার জন্যই এই বীর শহীদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা চালিয়েছে। ফরমায়েশি লেখক-গবেষকের মাধ্যমে বিভিন্ন কল্পকাহিনীও রচনা করা হয়েছে। কিন্তু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ও সত্যের মানদণ্ডে তা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি। শহীদ সিরাজের সার্থকতা সেখানেই।

মূলত, ষড়যন্ত্রকারীরা অতীতে যেমন সক্রিয় ছিল, এখনো আছে এবং আগামী দিনেও থাকবে। ষড়যন্ত্রকারীরা যে কত নিচে নেমেছিল তা সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য থেকে খুবই পরিষ্কার। কারণ, তিনি তার লেখায় মিথ্যাচারের সব সীমা অতিক্রম করেছিলেন। সিরাজ সম্পর্কে তিনি লিখেন, ‘সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি প্রায় সময়ে নদীতে বন্যার সময় নৌকা থেকে আরোহী উল্টিয়ে দিয়ে বা ডুবিয়ে দিয়ে এক সাথে এক দুইশ’ যুবক-যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু, সাঁতার না জেনে জলে নিমজ্জিত হওয়ার নিষ্ঠুর দৃশ্য উপভোগ করে আনন্দ লাভ করতেন।’ মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত না হলে কোনো সুস্থ মানুষের কাছে এমন নিম্নমানের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। শহীদ নবাব সিরাজ ছিলেন অত্যন্ত প্রজাবৎসল, হৃদয়বান ও দয়ালু প্রকৃতির। কিন্তু লেখক তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকেই বিতর্কিত করেছেন।

শহীদ নবাবকে অন্ধকূপের কথিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বাস্তবতার আলোকে এ অভিযোগ কল্পনাপ্রসূত ও অসার বলেই প্রমাণিত। অভিযোগ করা হয়, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের অভ্যন্তরে জানালাবিহীন ক্ষুদ্রাকৃতির একটি কামরায় ইংরেজদের কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। অমানবিক পরিবেশের কারণে এক রাতেই সেখানে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটেছিল বলে দাবি করেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী জন যেফানিয়াহ হলওয়েল (জন্ম-১৭১১, মৃত্যু-১৭৯৭) তার লিখিত ‘ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস’ নামক গ্রন্থে। তিনি নিজেকে কথিত অন্ধকূপ থেকে বেঁচে যাওয়া একজন বলে দাবিও করেছিলেন।

দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট এবং প্রস্থে ১৮ ফুট একটি কামরায় ১৪৬ জন মানুষকে আটক রাখা মোটেই বাস্তবসম্মত ছিল না। এমনকি সমসাময়িক ইতিহাসে এ ঘটনার কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা নবাবকে নির্দয়, উদ্ধত, স্বেচ্ছাচারী প্রমাণ করতে হলওয়েল বর্ণিত কাহিনীটি গ্রহণ করেছেন। অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত তার ‘সিরাজউদদৌলা’ (১৮৯৮) শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে এই কাহিনীর অসারতার বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৯১৬ সালের ২৪ মার্চ এশিয়াটিক সোসাইটিতে এক সভায় অন্ধকূপ হত্যা অলীক ও ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যা প্রচার তিনি প্রমাণ করেন।

অন্ধকূপ হত্যা ১৭৫৬ সালের ২০ জুন বাংলার নবাব সিরাজউদদৌলা কর্তৃক কলকাতা দখলের সময় সংঘটিত হওয়া কথিত ঘটনা। সে সময় থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর্যন্ত বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পরবর্তীকালে ‘হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ (১৮৫৮) গ্রন্থের প্রণেতা ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জেমস মিলের লেখাতেই বিষয়টি প্রথম গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। তারপর থেকে এর ওপর এত বেশি আলোকপাত করা হতে থাকে যে, পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭) এবং সিপাহী বিপ্লবের (১৮৫৭) পাশাপাশি এ কাহিনীও ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ইংল্যান্ডের স্কুলছাত্রদের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

উল্লেখ্য, ১৭৫৬ সালের ১৬ জুন ৩০ হাজার সেনার এক বাহিনী নিয়ে কলকাতা জয়ের লক্ষ্যে নবাব সিরাজউদদৌলা ফোর্ট উইলিয়ামের প্রবেশদ্বারে উপনীত হন। দু’দিন যুদ্ধের পর ইংরেজ গভর্নর রজার ড্রেক ১৯ জুন দলের বড় অংশ নিয়ে ফলতা পালিয়ে যান। হলওয়েল ইউরোপীয় এবং আর্মেনীয় সেনা ছাড়াও প্রায় ১৭০ জন শ্বেতাঙ্গ সেনার একটি দল নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে থেকে যান ও যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু নবাবের বন্দুকি সেনারা তাকে সফল হতে দেয়নি। ২০ জুনের সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধে ২৫ জন ইংরেজ সেনা নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়।

ফলে হলওয়েল আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। রাতের দিকে কিছু বন্দী সেনা নবাব বাহিনীর প্রহরীদের আক্রমণ করলে নবাব অভিযুক্তদের আটক রাখতে নির্দেশ দেন। হলওয়েল অভিযোগ করেন, নবাব বন্দীদের একটিমাত্র ক্ষুদ্র জানালাবিশিষ্ট ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রস্থবিশিষ্ট একটি কক্ষে আটকে রাখেন এবং জুনের প্রচণ্ড গরমের সে রাতে ইউরোপীয় ও ইংরেজ বন্দীদের ওই অন্ধকূপে ঠাসাঠাসি করে থাকতে বাধ্য করা হয়। ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এবং যুদ্ধাহত অবস্থায় অনেকেরই মৃত্যু ঘটে। ১৪৬ জনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১২৩ জন বলে ইউরোপে প্রচার করা হয়।

এই ঘটনা হলওয়েল অতিমাত্রায় অতিরঞ্জন করেছিলেন বলে জানা যায়। নবাব এসব বন্দীর সাথে মানবিক আচরণ করেছিলেন বলেই প্রমাণিত। বন্দীরা নবাবের সেনাদের ওপর হামলা করে বসে। তাই তাদেরকে হত্যা করাই অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু নবাব তা না করে তাদের আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরদিন হলওয়েল ও ইংরেজ কোম্পানির অপর তিন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ছাড়া আটকাধীন সব ইংরেজ সেনাকে মুক্তি দেয়া হয়।

নবাব হলওয়েল ও এ তিন শীর্ষস্থানীয় ইংরেজ কর্মকর্তাকে মুর্শিদাবাদের কারাগারে বন্দী রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েকদিন পর নবাব তাদের মুক্তি দেন। ইউরোপীয় বা ইংরেজদের পক্ষ থেকে মৃতের যে সংখ্যা দাবি করা হয়েছে তা স্পষ্টতই অতিরঞ্জন। আসলে আত্মসমর্পণের সময় থেকে ইউরোপীয় এ যুদ্ধবন্দীদের অন্ধকূপে স্থানান্তরের সময় পর্যন্ত কিছু সংখ্যক ইউরোপীয় বা ইংরেজ সেনা পালিয়ে যায় বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক মত প্রকাশ করেন।

অন্ধকূপে বন্দী ইউরোপীয় বা ইংরেজ সেনাদের সংখ্যার দাবিতে যে অতিরঞ্জন পরিলক্ষিত হয় তা পণ্ডিত ভোলানাথ চন্দ্রের বৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিনির্ভর পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়। ভোলানাথ প্রমাণ করেছিলেন, অন্ধক‚পের ২৬৭ বর্গফুট আয়তন ১৪৬ জন পূর্ণবয়স্ক ইউরোপীয় সেনার ধারণ ক্ষমতার বাইরে ছিল।

তিনি ১৮ ফুট/১৫ ফুট আয়তনবিশিষ্ট একটি স্থানকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে ইউরোপীয়দের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির ১৪৬ জন বাঙালি কৃষককে ঠাসাঠাসি করে ঢোকাতেও ব্যর্থ হন। ইউরোপীয় বা ইংরেজদের তুলনায় শারীরিক দিক থেকে খর্বকায় সমসংখ্যক বাঙালিকেও তথাকথিত অন্ধকূপের নির্দিষ্ট আয়তনে প্রবেশ করানো সম্ভব ছিল না। ফলে নবাবের বিরুদ্ধে অন্ধকূপ হত্যার যে কাহিনী প্রচার করা হয়, তা রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়।

ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়ী হওয়া এবং টিকে থাকার অনিবার্য উপায়টি হলো দেশপ্রেমিক শক্তি ও ব্যক্তির চরিত্র হনন করা। নবাব সিরাজউদদৌলার ক্ষেত্রে ইংরেজরা এ কাজটি সার্থকভাবেই করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের ১ মে অনুষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম সিলেক্ট কমিটির বৈঠকের ধারাবিবরণী থেকে জানা যায়, ওই বৈঠকে সিরাজকে উৎখাতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক পলাশীর যুদ্ধের পর নানাভাবে ইংরেজরা সিরাজের চরিত্র হননের ধারা চালু রেখেছিল।

ইতিহাস রচনায় নিয়োগ করা হয়েছিল ফরমায়েশি ও বশংবদ লেখকচক্র। কিন্তু তারা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডসহ সিরাজের বিরুদ্ধে যত গুরুতর অভিযোগ তার প্রায় শতভাগই মিথ্যা, ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অতিরঞ্জিত। বাঙালি ঐতিহাসিকদের মধ্যে একেবারে হাতে-কলমে এ কথাটি প্রমাণ করেছেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়।

তার লেখা ইতিহাস গ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সিরাজউদদৌলা সম্পর্কে লিখেছেন ‘...দ্বন্দ্বের হীনতা মিথ্যাচার প্রতারণার উপরে তাহার সাহস ও সরলতা, বীর্য ও ক্ষমা রাজোচিত মহত্ব উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে।’ কর্নেল ম্যালিসনের বিখ্যাত উক্তিটির উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘সেই পরিণাম দারুণ মহানাটকের প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে সিরাজউদদৌলাই একমাত্র লোক যিনি প্রতারণা করিবার চেষ্টা করেন নাই।’

অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র সিরাজদদৌলার আলোচনা প্রসঙ্গে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অকালে ঘটনার চক্রে তাহার মৃত্যু না ঘটিলে তিনি সম্ভবত রাজকর্মকুশল প্রজারঞ্জক রাজা হইতে পারিতেন।’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘হিন্দু-মুসলমানের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নবাব সিরাজউদদৌলা সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সর্বোপরি বাংলার মর্যাদাকে তিনি ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন এবং বিদেশী শোষণের কবল হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য আপনার জীবন-যৌবনকে কোরবানি করিয়া গিয়াছেন।’

অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে, ‘ইংরেজ বাঙালি সত্যের সম্মান রক্ষার্থে সরলভাবে আত্মোপরাধ স্বীকার করিতে সম্মত হইলে সকলকেই বলিতে হইবে, Siraj-ud-doula was more unfortunate than wicked.

ভারতীয় ইতিহাস লেখকদের কেউ কেউ শহীদ নবাব সিরাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে দীনতা ও সঙ্কীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। কলকাতার পাক্ষিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক হর্ষ দত্ত পত্রিকাটির ১৭ এপ্রিল ২০১১ সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠার ‘শেষ কথা’ নামের কলামে ‘কবে যে আমরা পুরোপুরি ইতিহাসমনষ্ক হবো!’

শিরোনামের লেখায় সিরাজউদদৌলাকে ‘অত্যাচারী ও অপরিণামদর্শী’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আশার কথা হলো- গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে সিকান্দার আবু জাফর, সাঈদ আহমেদ পর্যন্ত নাট্যকাররা ইংরেজদের চোখ দিয়ে সিরাজকে দেখেননি; বরং তারা প্রত্যেকেই নবাব সিরাজকে জাতীয়তাবাদী বীর, ধর্মপ্রাণ ও প্রজাবৎসল শাসক হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

হর্ষ দত্ত শহীদ সিরাজের চরিত্র নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, ইতিহাসের নিরপেক্ষ মানদণ্ডে তার কোনো গ্রহণযোগ্য ভিত্তি পাওয়া যায় না। কাজী নজরুল ইসলাম পলাশীর যুদ্ধকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর’। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হর্ষ দত্তরা এখনো সঙ্কীর্ণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বরং তাদের পূর্বসূরি হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের মতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইংরেজদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

অবশ্য হর্ষ দত্তের বক্তব্যের যথার্থ জবাবও এসেছে ভারতীয় গবেষকদের পক্ষ থেকেই। ১৭ মে ২০১১ সংখ্যা দেশ পত্রিকায় চিঠিপত্র বিভাগে সুরজিৎ দাশগুপ্ত হর্ষ দত্তের এই অবাস্তব বক্তব্যের যথোচিত জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘যে অল্পবয়সী সিরাজ পলাশীর যুদ্ধের আগে সবগুলো যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, তার সমর প্রতিভাকে অস্বীকার করা যায় কীভাবে? পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় কেন হয়েছিল সে কথা আমাদের জানা আছে। যারা ষড়যন্ত্র করে তাকে পরাস্ত করেছিলেন, তারাই তার কপালে অত্যাচারী, মাতাল, লম্পট প্রভৃতি তকমা সেঁটে দিয়েছিলেন।’

বিহারীলাল সরকার ‘ইংরাজের জয়’ গ্রন্থে লিখেন, ‘অন্ধকূপের বিবরণ অলীক। তবে সিরাজদদৌলার যে কলকাতা আক্রমণ করিয়া ইংরাজকে তাড়াইয়া ছিলেন ইহা সর্ববাদি সম্মত।’ কয়েকটি তথ্য উল্লেখ করে বিহারীলাল বলেন, ‘সিরাজকে কালিমালিপ্ত করে ইংরেজের সাম্রাজ্যবাদী আকাক্ষা প্রতিষ্ঠার কারণেই হলওয়েল মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন।’ আর হলওয়েল মনুমেন্ট ১৮১৮ সালে ভেঙে ফেলে আবার ১৯০২ সালে পুনঃস্থাপন ও ১৯৪০ সালে পুনরায় প্রত্যাহারের মাধ্যমে ইংরেজরাও ঘটনার অসারতা মেনে নিয়েছেন।

‘পলাশীর যুদ্ধ কোনো যুদ্ধ নয়, যেন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ এমনটিই মন্তব্য করেছেন ঐতিহাসিক শ্রী ঘোষ তার ইতিহাস গ্রন্থের ৫১৬ পৃষ্ঠায়। ‘এবার মিথ্যুক ইংরেজ অনুচর’ অন্ধকূপ হত্যার কাহিনীর মূল নায়ক হলওয়েলের কথায় আসি; যিনি সিরাজের বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়েছিলেন। অনেক কাহিনী যে শুধু গাঁজাখুরি কাহিনী, তার বাস্তব প্রমাণ হলো, হলওয়েলের সৃষ্ট অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী। সিরাজবিদ্বেষী ইংরেজদের কল্পিত অন্ধকূপে প্রায় দুইশ’ জন লোকের বন্দী থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু চিন্তা করার বিষয় হলো- সেই ঘরটির আয়তন ছিল মাত্র ১৮ ফুট-১৪ ফুট। এখানে জায়গা কম হওয়ার কারণে ১৪৬ জনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ধুরন্ধর প্রকৃতির ঐতিহাসিকরা পরে দেখলেন, এত লোকের কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই পরে ৬০ জনের কথা বলা হলো। এটিই হলো ইতিহাস।

নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর তার রচিত ‘সিরাজউদদৌলা’ নাটকের ভূমিকায় নবাব সিরাজ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘নতুন মূল্যবোধের তাগিদে, ইতিহাস বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐতিহ্য ও প্রেরণার উৎস হিসেবে সিরাজউদদৌলাকে আমি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছি। একান্তভাবে প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি থেকে এবং প্রতি পদক্ষেপে ইতিহাসকে অনুসরণ করে আমি সিরাজউদদৌলার জীবননাট্য পুননির্মাণ করেছি। ধর্ম ও নৈতিক আদর্শে সিরাজউদদৌলার যে অকৃত্রিম বিশ্বাস, তার চরিত্রের যে দৃঢ়তা এবং মানবীয় সদগুণগুলো চাপা দেয়ার জন্য যে ঔপনিবেশিক চক্রান্তকারীরা ও তাদের স্বার্থান্ধ স্তাবকরা অসত্যের পাহাড় জমিয়ে তুলেছিল, এই নাটকে প্রধানত সেই আদর্শ ও মানবিক গুণগুলোকেই আমি তুলে ধরতে চেয়েছি’।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তার রচিত নাটকের ভূমিকায় বলেন, ‘বিদেশী ইতিহাসে সিরাজ চরিত্র বিকৃত বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক বিহারীলাল সরকার, শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, শ্রীযুক্ত নিখিলনাথ রায়, শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিক্ষিত সুধী অসাধারণ অধ্যবসায় সহকারে বিদেশী ইতিহাস খণ্ডন করিয়া রাজনৈতিক ও প্রজাবৎসল সিরাজের স্বরূপ চিত্র প্রদর্শনে যত্নশীল হন।’ অপরদিকে শচীন সেনগুপ্ত তার সিরাজউদদৌলা নাটকের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘...আমি এই (সিরাজ) চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখাতে চেয়েছি, সিরাজের মতো উদার স্বভাবের লোকের পক্ষে, তার মতো তেজস্বী, নির্ভীক, সত্যাশ্রয়ী তরুণের পক্ষে কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করা সম্ভবপর নয়। বয়স যদি তার পরিণত হতো, কূটনীতিতে তিনি যদি পারদর্শী হতেন, তাহলে মানুষ হিসেবে ছোট হয়েও শাসক হিসেবে তিনি হয়তো বড় হতে পারতেন। সিরাজের অসহায়তা, সিরাজের পারদর্শিতা, সিরাজের অন্তরের দয়া-দাক্ষিণ্যই তাকে তার জীবনের শোচনীয় পরিণতির পথে ঠেলে দিয়েছিল। তার অক্ষমতাও নয়, অযোগ্যতাও নয়। বেশির ভাগ বাঙালির চরিত্রেরই এই বৈশিষ্ট্য। সিরাজ ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তাই তার পরাজয়ে বাংলার পরাজয় হলো। তার পতনের সাথে সাথে বাঙালিও হলো পতিত।’

নবাব সিরাজ একজন রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন। তাই তিনি কখনোই মানবীয় ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তাই তার ওপর দেবত্ব আরোপের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছে তার প্রায় শতভাগই মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আর অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল নিছক কল্পকথা মাত্র। বাস্তবতার সাথে তার দূরতম সম্পর্ক নেই। ঐতিহাসিক মানদণ্ডে ও যৌক্তিকতায় কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। মূলত শহীদ নবাব সিরাজ ছিলেন জাতীয় বীর।

শহীদ নবাব সিরাজউদদৌলা জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কাছে তিনি সফল হতে পারেননি। আমরাও তার যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই একজন পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক যথার্থই বলেছেন, ‘দেশই বরঞ্চ তাকে তার মাটির কোলে আবদ্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি কখনো তার দেশের প্রজাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। কখনো স্বেচ্ছায় স্বদেশকে বিকিয়ে দেননি। পলাশীর প্রান্তরে মর্মান্তিক নাট্যমঞ্চে একমাত্র তিনি ছিলেন মূল নায়ক।’
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement