শশী থারুরের ব্রিকস বুঝ!
- গৌতম দাস
- ১৩ জুলাই ২০২২, ২০:০৫, আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২২, ০৬:০০

শশী থারুর একজন ভারতীয়, কংগ্রেস রাজনীতিবিদ। মূলত, তিনি রাজনীতিকের চেয়ে বরং একজন কেরিয়ারিস্ট; তিনি প্রফেশনাল কেরিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কূটনীতি এবং গ্রাজুয়েশন করেছেন আমেরিকার স্বনামধন্য ফ্লেশ্চার স্কুল থেকে। এই অর্থে তার এক নামী একাডেমিক ইনস্টিটিউশনাল ব্যাকগ্রাউন্ডের। কিন্তু তিনি ততটুকুই রাজনীতিবিদ হতে পেরেছেন বা চেয়েছেন যতটুকু তার কেরিয়ার বাড়াতে দরকার মনে হয়েছে। অনেকের মতে, তিনি যতটা যোগ্য হয়েছেন তার চেয়ে বেশি একাডেমিক (ফ্লেশ্চার) বড়াই বা গর্ব করে থাকেন। তার সমসাময়িক বা এল্যুমনিদের মধ্যে যারা এমনকি বাংলাদেশী তাদেরও এমন অভিযোগ করতে দেখা যায়।
মোদির ২০১৪ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার আগের যে টানা দুই টার্ম (২০০৪-১৪) কংগ্রেসের মনমোহন সিংয়ের কোয়ালিশন সরকার ছিল; সেই সময়কালে থারুরের কেরিয়ার ও রাজনৈতিক উত্থান। সে সময়টা ছিল কংগ্রেস সরকারের- তাই তিনি কংগ্রেস দলের (কেরালা থেকে) এমপি-মন্ত্রীও হয়েছিলেন। মানে সে সময় অন্য দলের সরকার হলে তিনি সেই দল করতেন হয়তো, এ রকম কেরিয়ারিস্ট তিনি। কেন এমন বলছি?
বলছি, সেকালে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই যেমন এতদিন তিনি ছিলেন মোদিবিরোধী কংগ্রেসম্যান। কিন্তু গত ৭ জুলাই ২০২২ তিনি প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে এক আর্টিকেল লিখেছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে- অবস্থান বদলে নিতে চাচ্ছেন তিনি। বাইডেনের উদ্যোগে নবগঠিত বা চলতি যে ‘পশ্চিমা জোট’ শক্তি তৈরি হচ্ছে (সাম্প্রতিকালে জি-৭ আর ন্যাটোর সম্মেলন ডেকে বাইডেন হইচই ফেলতে চেয়েছেন, ‘পশ্চিমা জোট’ বলে পরিচয় করিয়েছেন সেখানেই) শশী থারুর আর বসে থাকতে পারেননি; একেবারে এর পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকালতি শুরু করেছেন। যেখানে এতদিন তিনি আমেরিকান ভারত পলিসি প্রসঙ্গের ক্রিটিক ছিলেন। শশী থারুর নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন।
সেখানে তার ব্যক্তি অবস্থান হিসেবে যে লাইন তিনি পারসু করতেন বা পক্ষে কথা বলতেন তা হলো যেমন- কেন আমেরিকা ভারতকে চীন ঠেকানো বা চায়না কনটেনমেন্টের এ কাজের ঠিকা দিয়েছে; এর সমালোচক ছিলেন তিনি। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই চীন ঠেকানোর পুরস্কার বা মজুরি হিসেবেই ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল।
থারুর এই ‘চায়না কনটেনমেন্ট’ প্রশ্নেই মোদির প্রো-আমেরিকান হয়ে লেপ্টে থাকার নীতির সমালোচক ছিলেন। ফলে যেন কংগ্রেসি হিসেবেই মোদির সমালোচক তিনি, এ পরিচয় লটকে চলতে চাইতেন। কিন্তু এবার তিনি পাশ ফিরছেন; মোদির সমালোচক হয়ে বাইডেনকে অতি আপন করে নিতে চাইছেন। যেটি অনেকে পাল্টিমারাও বলতে পারেন। কিন্তু কী প্রসঙ্গে ছিল সেই লেখা?
এবারের আলোচ্য সেই লেখার শিরোনাম হলো- ‘ব্রিকস থেকে ভারত কি বেরিয়ে যাবে?’ এটি বাংলাদেশে অনেকে এভাবে বাংলা করে ছেপেছে- যেটা ভালো বাংলা হয়নি। কারণ, মূল ভাষ্যটা ছিল- ‘ব্রিকস কী ভেঙে পড়বে’-এরকম। বা ইংরেজিতে ‘আর দ্য ব্রিকস ব্রেকিং আপ?’।
প্রতি বছর ব্রিকস এ জোটের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবার ২৩-২৪ জুন হয়েছিল চীনে। একইসাথে তা বিশেষ গুরুত্বে ‘বেইজিং ঘোষণা’ বলে এক ঐক্যমতের দলিলে স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানে। আর এবার ব্রিকস সম্মেলন হয়েছে এমন পটভূমিতে যখন বাইডেনের ‘পশ্চিমা-শক্তি’ আগেই ঘোষণা দিয়েছে, মূলত চীন ও সাথে রাশিয়া এবং এদের সহযোগী সব রাষ্ট্রকে একঘরে করবে, কোনো সম্পর্কও রাখবে না। এটি অনেকটা ১৯৯২ সালের আগে সোভিয়েত-আমেরিকা এভাবে দুই-ব্লকে ভাগ হয়ে থাকা সময়কালে দুনিয়া যেমন ছিল তেমনি।
সেখানে আবার ফিরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বাইডেনের এটি এক অবাস্তব কল্পনা মাত্র। সেটি ‘কোল্ডওয়্যার’-এর সেকাল বলে অনেকে চিনে থাকে যার মূল অমন বৈশিষ্ঠ যে ব্লকে ভাগ হতে পেরেছিল যে, তাতে সোভিয়েত-আমেরিকা বলে এ দুই ব্লকের মধ্যে কোনো বাণিজ্যিক পণ্য-পুঁজিবিনিয়োগ কোনোকিছুরই বিনিময় সম্পর্ক ছিল না।
মূল কারণ, খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ব্লকের কোনো দেশই কেউ আইএমএফের সদস্যপদ নেয়নি। যে সুযোগে পরে আমেরিকাও সদস্যপদ না দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বাইডেনের নয়া-কল্পনা অনেকটা সেকালের মতোই যা একালে আবার সেখানে পৌঁছানো যায় কি না; এই তার আকাঙ্খা। যদিও একালে সে বাস্তবতাই ভেঙে গেছে, আর উপস্থিতিও নেই। তবু এ জায়গায় বাইডেন নির্বিকার। কিন্তু জিদ ধরেছেন সেকালেই ফিরতে চান! বাইডেনের ভাষায় বললে, তার নেতৃত্ব গড়ে তোলা ‘পশ্চিমা শক্তির’ সাথে চীন ও এর বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নাকি ‘মূল্যবোধে’ এক বিশাল ফারাক আছে; তাই তিনি যেন অবাস্তব জেনেও এ জিদ ধরেছেন।
এ ছাড়া এবারের ব্রিকস সম্মেলনের আরেক তাৎপর্য ছিল, এতদিন এতে পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র শুধু এতে অংশ নিয়েছে। এবারই প্রথম অতিথি হিসেবে আরো ১৩টি রাষ্ট্র অংশ নিয়েছে। দেশগুলো হলো- আলজেরিয়া, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, উজবেকিস্তান, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। আমরা বলতে পারি, এর মানে, এদের কাছে বাইডেনের উদ্যোগে নবগঠিত যে ‘পশ্চিমা জোট’ করেছে, চীনকে একঘরে করবে বলে হুমকি দিয়েছে- সেসব দিক এসব দেশের কাছে কোনো গুরুত্বই পায়নি। কেন এভাবে বলছি?
প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিকস (বিআরআইসিএস) কী আসলে :
এক কথায় বললে, এখনো আমেরিকা গ্লোবাল ইকোনমির নেতা হয়ে থাকলেও এটির অবস্থা শেষ পর্যায়ে। বিপরীতে চীনের নেতৃত্বে উত্থিত হয়ে তা সেই জায়গা নিতে চাইছে। আমরা এখন এই জংশনে আছি। গ্লোবাল অর্থনীতি-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আছে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক; যেটা আছে আবার আমেরিকার একক নিয়ন্ত্রণে।
কারণ, এর নিয়ন্ত্রক বড় শেয়ার মালিকানা একা আমেরিকার নিজের হাতে রেখে দিয়েছে। চীনের সাথে শেয়ার ছেড়ে দিয়ে রাজি হয়নি। আর তা থেকেই ওয়াল স্টিটের পরামর্শে ব্রিকস ব্যাংকের জন্ম! তাহলে ব্রিকস হলো সেই আগামী আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তা সক্রিয় ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা নেবে যখন চীন গ্লোবাল নেতৃত্বে আসীন হতে পারবে তখন। কেন? এখন নয় কেন?
ইকোনমিক-টেকনিক্যাল কারণে একই দুনিয়াতে দু’টি ‘আইএমএফ’ ধরনের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। ঠিক যে কারণে একটি দেশে একই সাথে দু’টি সরকার থাকতে পারে না। তাই ২০০৯ সাল থেকে ব্রিকসের জন্ম হলেও এখনই দুনিয়াজুড়ে ‘আইএমএফ’-এর সমান্তরালে সক্রিয় হয়নি, ইচ্ছা করেই।
চীন, ভারত, রাশিয়া, সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিল- এই পাঁচ রাষ্ট্রকে নিয়ে ব্রিকস গঠিত। যদি অনুমান করে নিই আমাদের চেনা দুনিয়ার বাইরে কেবল এই পাঁচ রাষ্ট্রকে নিয়ে সমান্তরাল আরেকটি দুনিয়া যেন আছে; তবে এই পাঁচ রাষ্ট্রের জন্যই শুধু ব্রিকস যেন সেই দুনিয়ায় আরেক আইএমএফ হিসেবে হাজির আছে।
এভাবে মনে করা যেতে পারে। যেদিন গ্লোবাল নেতৃত্বে চীন আসীন হবে সেদিন ব্রিকস আর আইএমএফ মিলিত হয়ে এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে যাবে বলে অনুমান করা হয়। তবে তা আজকের আমেরিকান প্রভাবের আইএমএফ যেমন, সেই রকম তখন সেটি চীনের প্রভাবের একটি নয়া আইএমএফ প্রতিষ্ঠান হবে, তাতে নতুন নাম কিছু একটা হবে হয়তো বা পুরনোটাই থাকবে। কিন্তু নয়া মালিকানা শেয়ারে বড় ভাগটা চীনের পক্ষে পুনর্গঠিত হবে তা সহজে অনুমান করা যায়। কাজেই চীনকে উপেক্ষা করে নয়া দুনিয়া সাজানোর বাইডেনের আমেরিকার এক মরণ খায়েশ মাত্র। অথচ এ অবস্থানের পরোয়া না করে ১৩ রাষ্ট্রের এবার ব্রিকসের অতিথি হওয়া- নিজেদের স্বাধীন পতাকা উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাটি ঘটিয়েছে যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাইডেন যেখানে চীনকে গ্লোবাল বাণিজ্য থেকে বের করে একঘরে করার জিদ ধরেছেন; সেখানে এই ১৩ রাষ্ট্রের এমন পদক্ষেপ নজর করার মতোই বলতে হবে!
তবে ওদিকে একই দুনিয়াতে বিশ্ব ব্যাংক টাইপের প্রতিষ্ঠান একাধিক হতে পারে। টেকনিক্যাল অসুবিধা নেই। যেমন ইতোমধ্যেই ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ (এডিবি) অথবা ইসলামী ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) আসলে বিশ্ব ব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে জন্ম হয়েছে। এ ছাড়া চীনা এআইআইবি অথবা ব্রিকসের ভেতরেই আরেকটি ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ নামে বিশ্ব ব্যাংকের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে আছে।
সার কথায় বললে, ব্যাপারটি হলো, শশী থারুরকে এতদিন ব্রিকস নিয়ে কোনো কথা বলতে দেখা যায়নি। বরং ভারত-আমেরিকার চীন ঠেকানো নিয়ে কথা বলতেন। সেই তিনি এখন ‘ব্রিকস ভেঙে যাবে কি না’ তা নিয়ে কথা বলছেন!
আগেও অনেকবার বলেছিলেন গ্লোবাল ইকোনমি বা আইএমএফ প্রসঙ্গে কথা বলার সময় সাবধান হওয়াই ভালো এটি সাধারণ কোনো কূটনীতির ইস্যু বলে ঠাওরে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। নিজের বিদ্যের দৌড় প্রকাশ হয়ে পড়বে- তাই অসাবধানে এ ইস্যুর সাথে আচরণ করা ভুল। আর ঠিক সেই ভুল ও ফাঁদে আটকে গেছেন শশী থারুর!
আগে বলে নেয়া যাক- কেন এবারের ব্রিকস সম্মেলনে ‘বেইজিং ঘোষণা’ জিনিসটা কী যার ওপরই মূলত শশী থারুর ক্ষোভ বা আপত্তি!
পাকিস্তানি আবদুল রহমান মক্কিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ঘোষণা নিয়ে তিন পর্যায় :
প্রথমত, ব্রিকস সম্মেলন শুরুর আগের সপ্তাহে ১৭ জুন, একজন পাকিস্তানি কিন্তু আইএস সদস্য আবদুল রহমান মক্কির নাম জাতিসঙ্ঘের সন্ত্রাসী তালিকায় তোলা হবে কি না এ নিয়ে ভারত-আমেরিকার এক যৌথ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে চীন এটি আরো ছয় মাস দেরি করার পক্ষে ভেটো প্রয়োগ করে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, চীনে ব্রিকস সম্মেলনের ভারতের মোদি বক্তৃতায় সরাসরি এ প্রসঙ্গটির উচ্চারণ না করে তবে প্রসঙ্গটি মাথায় রেখে বলেন, ‘আমাদের (ব্রিকসের সদস্যরা) একে অপরের নিরাপত্তা উদ্বেগ বোঝা উচিত, সন্ত্রাসী চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা দেয়া উচিত; যাতে এমন ইস্যুর রাজনীতিকরণ না হয়ে যায়।’
আর এতে তৃতীয় পর্যায়ের ঘটনাটি হলো, ব্রিকস সম্মেলন শেষে ‘চায়না ঘোষণা’ নামে এক প্রস্তাব পাস হয়েছে। বিষয়টি সারকথায় বললে, আগে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইস্যুসহ অন্যান্য ইস্যুতে ব্রিকস সদস্যরা একসাথে জাতিসঙ্ঘে অবস্থান নেয়াতে কত ভালো কিছু হয়েছে; তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে এখন থেকে আবার পরস্পরের সহযোগী হয়ে কাজ করতে হবে।
কেন বারবার চীন-ভারত একসাথে থাকতে পারেনি :
গ্লোবাল নেতৃত্বের পরিবর্তনের একালে গত ২০ বছর ধরে ভারত যে নীতি অনুসরণ করে এসেছে তার মৌলিক বোঝাবুঝিই ত্রুটিপূর্ণ থেকে গেছে বা রাখা হয়েছে বলে এর উল্টো ফলই ভারত বারবার পেয়েছে। যেমন- ভারত মনে করে এসেছে, এ যুগে চীন-আমেরিকার প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব ইত্যাদিকে ব্যবহার করে ভারত এদের দুজনের মাথার উপরে উঠে যেতে পারবে। কিন্তু এটি এতই উচ্চাশা যে, এ নিয়ে কথা বলাই সময় নষ্ট। কারণ, এখানে মূল বিষয়টি হলো কূটনীতিক দক্ষতা দেখানোর নয়- বরং ‘নিজ অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের’। নিজেকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করে দেখানোর।
মোদি ভালো নেতা কি না, বা দেশপ্রেমিক জাতিবাদী কি না কেবল তা দিয়ে বা এই কর্তাসত্তা দেখিয়ে দাবি করা অর্থহীন যে- ‘অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি’ অর্জন হয়েছে। ফলে এখন চীন-আমেরিকাকে কূটনীতিক চাতুরি দিয়ে টেক্কা মেরে দিলেই সব অর্জন হয়ে যাবে? না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ হয়ে দেখাতে হয়। তার আগেই নিজেকে পরাশক্তি দাবি করা অর্থহীন। বাগাড়ম্বর! আর কিছু হওয়ার আগেই আমি বিরাট কিছু এই বাগড়ম্বরতা ভারতের কিছু না হতে পারার কারণ। সর্বোপরি আছে হিন্দুত্ববাদ এই ভুল রাজনীতি।
সম্প্রতি ভারতের জনসংখ্যা চীনকেও ছাড়িয়েছে। গ্লোবাল অর্থনীতির প্রধান কেউ হতে হলে বড় জনসংখ্যা এর জন্য অবশ্য একটি ইতিবাচক উপায় ও সুযোগ। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বড় জনসংখ্যার কোনো দেশ হয়ে যাওয়া মানেই পরাশক্তি হয়ে গেছে। কারণ, ওই বড় জনসংখ্যাকে অর্থনীতিতে কাজে লাগিয়ে সম্পদ বানাতে রূপান্তর করতে সক্ষম হতে হবে আগে- তবেই বড় জনসংখ্যা ইতিবাচক; না হলে ওই জনসংখ্যাই হবে বড় বোঝা বা ভার।
আর এই ভারতীয় ভুল মনোভাবকেই ফুসলিয়ে চীনের বিরুদ্ধে দিল্লিকে নিয়ে গেছে আমেরিকা; উল্টা ভারতকে ব্যবহার করেছে। চীন ঠেকানোর ঠিকা দিয়েছে। অথচ আমেরিকা হলো গ্লোবাল অর্থনীতিতে ‘পতিত শক্তি’। অর্থাৎ ভারতসহ উদীয়মান যেকোনো অর্থনীতির জন্য বিপরীত শক্তি।
এবার সুনির্দিষ্ট করে জঙ্গি ইস্যু :
চীনের উইঘুর ইস্যু। আপনি উইঘুর বাসিন্দাদের পক্ষে চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সহানুভূতি ও সমর্থন নিয়ে অবশ্যই এগিয়ে যেতে পারেন এবং যাওয়া উচিতও। কিন্তু এক শর্তে! তা হলো- উইঘুররা আবার আফগানিস্তানে আইএসের সহযোগী হয়ে সশস্ত্র তৎপরতা করে বেড়াতে পারবে না। আসলে বর্তমানে তালেবানেরাও উইঘুর (ইটিআইএম) এদের এমন তৎপরতা করতে আপত্তি ও বাধা জানিয়েছে।
কিন্তু তারা তবু ভারত ও আমেরিকার হয়ে পাকিস্তানে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। যে কাজে কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচরাও থাকছে।
পাকিস্তানে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা ইনস্টিটিউটে হামলা বা পাকিস্তানে গোয়াদর ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পে চীনা প্রকৌশলী মারতে বেলুচদের সাথে মিলে উইঘুরের বাসিন্দারা যদি তৎপরতা চালায় তবে এরপর আপনি আর একই সাথে তাদের প্রতি চীনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সহানুভূতি প্রকাশের সুযোগ পাবেন না। এটাই স্বাভাবিক। গত ২০০১ সাল থেকে উইঘুররা আমেরিকান সন্ত্রাসী দলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ ২০২০ সালে ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগে তাদের আমেরিকান সন্ত্রাসী তালিকা মুক্ত করে দেয়। আর বাইডেন তাদের ওপর চীনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বেইজিংয়ের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। রফতানিতে চীনা তুলা বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তাহলে বাইডেন আসলে কী চায়?
সম্প্রতি পাকিস্তানি তালেবান গ্রুপ টিটিপির সাথে এদের মিলিত তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগানিস্তান সীমান্তে আশ্রয় অঞ্চলগুলোতে বোমাবর্ষণ করে তাদের তৎপরতা স্তিমিত করেছে। আসলে বটমলাইন হলো- আপনি আরেক দেশে সন্ত্রাস উসকে দিয়ে নিজ দেশের সন্ত্রাসমুক্ত বা নিয়ন্ত্রিত রাখতে পারবেন না। আমেরিকার সাথে মিলে ভারত, পাকিস্তান-আফগানিস্তানে সন্ত্রাস উসকে তোলার নীতিতে চলে নিজ দেশ সন্ত্রাসমুক্ত রাখতে পারবেন না। সন্ত্রাস প্রসঙ্গে সবখানেই সব ফোরামেই একই নীতিগতভাবে অবস্থান নিতে হবে। এটিই একমাত্র পত এ থেকে মুক্তির উপায়। পিস-মিল করে একেক সন্ত্রাসের ঘটনায় একেক অবস্থান নেবেন এটি শেষ বিচারে কোনো কাজের অবস্থান হবে না।
যেমন যদি প্রশ্ন করি, ভারত মুক্কি ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে আমেরিকার সাথে জাতিসঙ্ঘে যৌথ প্রস্তাব উত্থাপনে গেল কেন? একই সাথে এ ইস্যুতে চীনের সাথে কথা বলা ও একই নীতি তৈরি করে উভয়েই তাতে চলতে চাইল না কেন? সমস্যা তো এখানেই! ভারত তো আসলে মুক্কি ইস্যুতে মানে সন্ত্রাস ইস্যুতে চীনের সাথেও এক অবস্থানে যেতে চায় না। চাইলে একই পথ ধরত। ভারত চেয়েছিল আমেরিকার সাথে গলা মিলে চীনকে জাতিসঙ্ঘের আসরে বিব্রত করতে। ভারত সমাধান চাইলে আগেই চীনের সাথেও একই অবস্থান নিয়ে কথা বলত। যেটি মোদি ব্রিকসের সভায় নিজ বক্তৃতায় বলেছেন, ‘ব্রিকসের পাঁচ সদস্যের সবাই অন্যের সন্ত্রাস নিয়ে নিরাপত্তা উদ্বেগ আমল করা উচিত’। কিন্তু ভারত তা না করার নীতিতে চলেছে। না হলে পাকিস্তানে ও আফগানিস্তানে আমেরিকার সাথে মিলে বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী, উইঘুর বা আইএস সশস্ত্র তৎপরতাকে সাহায্য সমর্থন না করে তা থেকে দূরে সরে আসত!
আগেই বলেছি, মূল কথা- ভারত মনে করে চীন-মার্কিন বিরোধে আমেরিকার দিকে কান্নি মেরে, এরপর এ থেকে ফয়দা তোলার কূটনীতিতে চলতে হবে। চীন-আমেরিকার বিরোধ কাজে লাগিয়ে এভাবেই নিজ স্বার্থ উদ্ধার করতে হবে। যেন ভারতের কূটনীতিই খুবই বুদ্ধিমান থাকবে! কিন্তু সময়ে তা কিছুটা আদায় হলেও হতে পারে হয়তো, কিন্তু এ থেকে ভারতের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়বে কীভাবে? অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের সাথে কূটনীতিতে ওস্তাদ হওয়া বা না থাকার কী সম্পর্ক? চালাকি আর অর্থনৈতিক সক্ষমতা কী এক জিনিস? না কি এটি ক্ষতি করবে? এখানে কবি নীরব! অথচ ডুবে যাওয়া দিনে শশী থারুর এ নিয়েই আমেরিকার পক্ষে তৎপর হতে উঠে দাঁড়ানোর সঠিক সময় ভাবলেন।
ভারত কিসে ডুবে যাচ্ছে?
মুসলমান নির্যাতনে। মুসলমান নিধনেই মোদি নির্বাচনে বাক্স ভরার নীতিতে তাকে চলতে হবে মনে করেন। কারণ অর্থনীতির পারফরম্যান্স আর ভালো করার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না। ওদিকে বাইডেনের দুই অস্ত্র অবরোধ আর মানবাধিকার সবার উপর প্রয়োগ করা ছাড়া তার অস্ত্র ভোঁতা- তাই বাইডেনের পক্ষে ভারতকে বন্ধু হিসেবে পেতে চাওয়া আবার দিল্লির ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রয়োগ না করা স্ববিরোধী।
অথচ থারুর ভাবছেন মোদি তার মতো বুদ্ধিমান নন। তাই তিনি ভেবেছেন বাইডেনের এ নয়া উদ্যমে চীনের বিরোধিতাকে ভারতের নিজের কাজে লাগাতে বাইডেনের বন্ধু ও আরো ঘনিষ্ঠ ভাব দেখাতে হবে।
শেষ কথাটি হলো- শশী থারুর যে গ্লোবাল অর্থনীতি বুঝেন না সেটিই এতে উদাম হয়ে গেছে। তিনি বলছেন ‘ব্রিকসকে আরো চীনকেন্দ্রিক করা হোক, সেটি ভারত চায় না’। আসলে এই হলো হাজার কথার এক কথা। শশী থারুর যে ব্রিকস কী ধরনের প্রতিষ্ঠান এটাই বুঝেন না, তার এক শক্ত প্রমাণ এটি।
কারণ, ফ্যাক্টস হলো- চীন নেই এবং প্রধান ভূমিকায় নেই, তবে ব্রিকস বলে কোনো প্রতিষ্ঠানই হবে না, দাঁড়াবেই না। দাঁড়ানোর দরকার হবে না। কেন?
আসলে ব্রিকস প্রতিষ্ঠান দরকার কেন? এ নিয়ে শশী থারুর নিজেই প্রশ্ন করে যেসব জবাব দিয়েছেন তাতেও তার বিদ্যা-বুদ্ধি প্রকাশিত। যেমন তিনি বলছেন- প্রথমত, ব্রিকস বৃহত্তর অর্থে অর্থনৈতিক নাকি ভূরাজনৈতিক জোট?
এর জবাব হলো- ব্রিকস না অর্থনৈতিক না ভূরাজনৈতিক জোট। যদি প্রশ্ন তোলা হয়- আইএমএফ কী কোন জোট? অর্থনৈতিক না ভূরাজনৈতিক জোট? এটি তেমনই এক প্রশ্ন হবে।
ব্রিকস আইএমএফের সমতুল্য প্রতিষ্ঠান। এখন আইএমএফ কেমন প্রতিষ্ঠান এটি যখন আপনার ধারণায় নেই তখন ব্রিকসও আপনি বুঝবেন না। কেবল প্রশ্ন করবেন আর নিজের বোকামি তুলে ধরবেন!
কাজেই মুখ খোলার আগে শশী থারুরের উচিত হবে আইএমএফ প্রতিষ্ঠানটি কী- এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। ফ্লেশ্চার স্কুল আইন আর কূটনীতিতে জোর দেয় সত্ত্বেও এটি মান্টিশেডের প্রতিষ্ঠান। এর বাকি শেডগুলো নিজ যোগ্যতায় পূরণ করে নিতে হবে। সেদিকে মনযোগ দেন আগে। দ্রুত মুখ খুলবেন না! এটি অপ্রয়োজনীয়!
এ কারণে শশী থারুর ভারত ব্রিকসের সদস্য ঠিকই হতে চায়। কিন্তু চীনকেন্দ্রিক ব্রিকস চায় না। এর মানে কী আমেরিকাকেন্দ্রিক আইএমএফে কী ভারতের জন্য বিরাট জায়গা আছে? আমেরিকা বসে আছে?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা