বরকতময় আরাফার দিন ৯ জিলহজকে স্বাগতম
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ০৪ জুলাই ২০২২, ২০:২১
বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশগুলোর ধর্মপ্রাণ মুসলমান ভাই-বোনেরা পবিত্র হজব্রত পালনের জন্য এখন সৌদি আরবে রয়েছেন। করোনা মহামারীর কারণে গত দু’বছর সীমিত পর্যায়ে হজ হয়েছে। সৌদি আরবের বাইরের দেশ থেকে কেউ হজ যেতে পারেননি।
আলহামদুলিল্লাহ, এবার ১০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবার হজ করার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে সুযোগ পেয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার। আশা করা যায় আগামী বছর থেকে হজ কার্যক্রম পুরোদমে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আগের মতো ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ হজ করতে পারবেন। এবার ৬৫ বছর বয়সের বেশি কাউকে হজ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। এবার বাংলাসহ ১৪টি ভাষায় আরাফার খুতবা অনুবাদ করে সম্প্রচার করা হবে। বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি মুসলমানদের কাছে এই খুতবা পৌঁছে দেয়া হবে।
আর তিন দিন পরেই পবিত্র ৯ জিলহজ, আরাফাতের ময়দানে সমবেত হবেন ১০ লক্ষ নারী-পুরুষ। খোশ আমদেদ ‘ইয়াওমুল আরাফা’। স্বাগত, আরাফার দিন ৯ জিলহজ। জিলহজের আরাফার এই দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠতম দিন। যেমন শ্রেষ্ঠতম রাত লাইলাতুল কদর (শবেকদর)।
হাদিস শরীফে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘আল আরাফা, আল হাজ আরাফা’ অর্থাৎ হজ হলো আরাফার দিন। আরাফাই হজ (আবু দাউদ)। অন্য এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, আরাফার দিনটিই মূলত হজের দিন। ‘আরাফাতে অবস্থান করাই হলো হজ’ ( সুনান নাসাঈ, ৩০৪৪)।
জাবালে রহমতের পাদদেশ থেকে নামিরা মসজিদ পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে ২ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ২ কিলোমিটার এলাকাই হলো আরাফাতের ময়দান।
হজরত আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:) বেহেশত থেকে পৃথিবীতে আসার পর পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তিন শ’ বছর পর আরাফাতের ময়দানে আবার তাদের সাক্ষাৎ ঘটে। কৃতকর্মের জন্য তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাঁদের ক্ষমা করে দেন। আরাফাত ময়দান তাই আদম ও হাওয়ার স্মৃতিবিজড়িত মিলন স্থল। এজন্য এটা হজের মূল রুকন।
এ দিনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, আরাফার দিনে মহান আল্লাহ এত সংখ্যক বান্দাকে এক সাথে ক্ষমার ঘোষণা দেন যে, বছরের অন্য কোনো দিনে এত মানুষকে ক্ষমা করেন না। আবার শয়তান এদিনে এতটা লাঞ্ছিত ও অপমানবোধ মনে করে যে, বছরের অন্য কোনো দিন এতটা অপমানিত হয় না।
এদিনটি হচ্ছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির দিন। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, ‘আরাফার দিনে এত সংখ্যক বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে দেন, যা অন্য কোনো দিনে দেয়া হয় না। সেদিন তিনি বান্দাদের অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়ে যান এবং ফেরেস্তাদের সাথে গর্ব করে বলেন, আমার এসব বান্দা কী চায় (সহিহ মুসলিম, ৩৩৫৪)। আরাফার দিন হলো দোয়া করা ও দোয়া কবুলের উত্তম দিন।
আবু কাতাদাহ থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী এদিন যারা সিয়াম পালন করবে তাদের পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহ বা পাপমোচন হবে (সহিহ মুসলিম)।
তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজীদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কারণ নবী করিম (সা:) আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজাবিহীন অবস্থায়।
আরাফার দিনের শ্রেষ্ঠত্বের আরেকটি কারণ দ্বীন হিসেবে ইসলামকে এদিন মহান আল্লাহ পরিপূর্ণ করে দেন, কুরআনে আয়াত নাজিলের মাধ্যমে।
একজন ইহুদি আলেম উমর (রা:)কে বললেন, হে ইসলামের খলিফা উমর, আপনারা কুরআনের এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন, যদি সে আয়াত আমাদের মাঝে নাজিল হতো তাহলে আমরা সেদিনকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করতাম। উমর (রা:) বললেন, নিশ্চয়ই আমি জানি সে আয়াত কোনটি এবং তা কখন কোথায় রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর ওপর নাজিল হয়েছিল। সেদিনটি হচ্ছে আরাফাতের দিন। মহান আল্লাহর শপথ আমরা তখন রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সঙ্গে আরাফাতেই ছিলাম। সে আয়াত হচ্ছে- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য আমার দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পূর্ণ করলাম এবং আমি তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন বা জীবনবিধান হিসেবে মনোনীত করলাম’ (সূরা মায়েদা, আয়াত-৩)।
নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সা:) শুক্রবার, ৯ জিলহজ, দশ হিজরি সনে এই আরাফা ময়দানে লক্ষাধিক সাহাবার সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। জাবির (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা:) আরাফার ময়দানে উপস্থিত হলেন। যখন সূর্য ঢলে পড়ল, কাছওয়াতে আরোহণ করে বাতনে ওয়াদিতে এলেন এবং সমবেত মানুষের উদ্দেশ্য খুৎবা দিলেন (সহিহ মুসলিম ২১৩৭)।
মহান আল্লাহ কোরআনের সূরা ফাজরে এদিনের কসম করেছেন। আয়াত ১-৩ এ বলা হয়, ‘শপথ ফজরের, শপথ দশটি রাতের (জিলহজের দশ দিন), শপথ জোড় ও বেজোড়ের।’ এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, জোড় দ্বারা ঈদুল আজহা অর্থাৎ কুরবানির দিন এবং বেজোড় দ্বারা আরাফার দিনকে বোঝানো হয়েছে (ফাতাহুল কাদির, শাওকানী,খণ্ড-৭, পৃষ্ঠা ৪৮৯)।
আল কুরআনের সূরা বুরুজেও আল্লাহ তায়ালা এ দিনটির কথা বলেছেন। আয়াত-৩ এ বলা হয়, ‘আর প্রতিশ্রুতি দ্রষ্টা ও দৃষ্টের।’ এর মধ্যে আরাফার দিনকে বলা হয়েছে দৃষ্ট। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘প্রতিশ্রুত দিন হচ্ছে কিয়ামতের দিন, দৃষ্ট দিন হচ্ছে- আরাফার দিন। আর দ্রষ্টা হচ্ছে জুমার দিন’ (সুনানে তিরমিজি)।
জিলহজের মহিমান্বিত দশ দিনের মধ্যে অন্যতম হলো আরাফার দিন। এদিন ইহরামের পোশাকে (সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড়) হাজীগণ মিনা থেকে তালবিয়া অর্থাৎ ‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা- শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নেয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা- শারিকা লাকা।’ অর্থ ‘হে আল্লাহ আমি হাজির আছি, আমি হাজির আছি। আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির আছি। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নেয়ামত আপনারই এবং সমগ্র বিশ্বজাহান আপনার। আপনার কোনো শরিক নেই’ পাঠ করতে করতে আরাফার ময়দানে সমবেত হন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন।
আরাফার দিন যে আমলগুলো করার জন্য নবীজী (সা:) শিক্ষা দিয়েছেন তা হচ্ছে : ১. আরাফার দিন ৯ জিলহজ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ জিলহজ আছরের নামাজ পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর তাকবির তাশরিক পাঠ করা; ২. বেশি বেশি জিকির, তাওবা ইস্তেগফার করা; ৩. দরুদ পাঠ এবং কুরআন তিলাওয়াত; ৪. জোহর থেকে আছর মধ্যে আরাফা দিনের দোয়াটা বেশি বেশি পড়া; ৫. জিলহজ মাসের প্রথম ১৩ দিন দু’ধরনের তাকবির পাঠ সুন্নাহ। একটি হলো সাধারণ তাকবির পাঠ; ৬. জিলহজের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত দোয়ায় বিশেষ করে সন্তান, পরিবার পরিজন, সারা বিশ্বের মুসলমান এবং দেশের ও সব মানুষের কল্যাণ চেয়ে দোয়া করা।
আরাফাত ময়দান ও আরাফা দিনের আরো বৈশিষ্ট্য
জিবরাইল (আ:) যখন হজরত ইব্রাহিম (আ:) কে হজের বিধি-বিধান শিক্ষা দেন, তখন তাঁরা আরফাতের মসজিদে নামিরার পাশে ছিলেন। জিবরাইল (আ:) শিক্ষা দেয়ার সময় ইব্রাহিম (আ.)কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘হাল আরাফতা’- আপনি কি বুঝতে পেরেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এর থেকেই নাম হয়ে যায় আরাফাত। মক্কা থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত একটি সমতল অঞ্চল। জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হজের দিন হজযাত্রীরা মিনা থেকে এখানে উপস্থিত হন। আরাফাতে হজের খুৎবা পড়া হয় এবং জোহর ও আছরের নামাজ একত্রে পড়া হয়। সন্ধ্যায় আরাফাত ছেড়ে মুজদালিফায় রওনা ও হজের অন্য কার্যক্রম করা হয়। যেমন- পশু কোরবানি, শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ, কাবা শরিফে তাওয়াফ, সাফা- মারওয়া পাহাড়ের নির্দিষ্ট স্থানে দৌড়ানো বা সা-ঈ করা, মাথা মুন্ডানো, বিদায়ী তাওয়াফ ইত্যাদি।
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে হজ করা ও তাঁর হুকুম পালনের তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
abdal62@ gmail.com
(তথ্যসূত্র : তফসির মা’আরেফুল কুরআন, তফসির কুরতুবি, মক্কা ও মদিনার খুৎবা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খন্দকার অনূদিত, বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ)।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা