০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের কাঁধে শায়খের লাশ

তুরস্কে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অগ্রদূত শায়খ মাহমুদ আফেন্দি

তুরস্কে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অগ্রদূত শায়খ মাহমুদ আফেন্দি - ফাইল ছবি

মুসলিম বিশ্বের খ্যাতনামা আলেম, নকশবন্দি তরিকার সুফি ও তুরস্কে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অগ্রসেনানী শায়খুল ইসলাম শায়খ মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দি আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে চলে গেছেন গত ২৩ জুন, ২০২২। ইস্তাম্বুলে মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩। তার আসল নাম মাহমুদ ওছমানোগলু। মুসলিম বিশ্বে তিনি শায়খ মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দি নামে সমধিক পরিচিত। মসজিদে ফাতেহ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত নামাজে জানাজায় লাখ লাখ মানুষ অংশ নেন। প্রেসিডেন্ট এরদোগান শায়খের লাশ কাঁধে বহন করে কবরস্থানে নিয়ে যান।

তুরস্কে যখন উসমানি খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটানো হয়, কামাল আতাতুর্কের মতো ধর্মবিদ্বেষী লোকেরা যখন ইসলামকে তুরস্ক থেকে নির্বাসিত করতে চেয়েছে, মসজিদগুলোকে মিউজিয়ামে পরিণত করে, আরবি বর্ণমালার পরিবর্তন, আরবিতে আজান নিষিদ্ধ করে এবং দ্বীনী তালিম বন্ধ করে দেয়, মাদরাসাগুলোর সব সম্পত্তি ক্রোক করে নেয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়, সেই সময়ে তুর্কি আলেমরা শহর ছেড়ে চলে যান প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন অজপাড়াগাঁয়ে। তখন সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে যারা ইসলামকে জিন্দা রাখার ব্রত নিয়ে মাঠে সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে শায়খ মাহমুদ আফেন্দি মুজাদ্দেদি নকশবন্দি অন্যতম। আলেম-ওলামা গোপনে গোপনে ও গাছের নিচে গ্রামগঞ্জে শিশুদের দ্বীনী শিক্ষা দিতে শুরু করেন। সেখানকার লোকেরা যখন সেনাদের আসতে দেখত, শিশুরা তৎক্ষণাৎ কৃষিকাজে লেগে যেত। দেখে মনে হতো, এসব শিশু কোনো শিক্ষা অর্জন করছে না, বরং কৃষিকাজে মশগুল রয়েছে।

শায়খ মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দি তার ছাত্রদের আঙুলের ইশারায় সরফ-নাহু তথা আরবি ব্যাকরণশাস্ত্রের পাঠদান করতেন এবং হাতের ইশারায় হজ ও নামাজের মাসয়ালাও বুঝিয়ে দিতেন। এখনো তুরস্কের কিছু জায়গায় এ পদ্ধতি চালু আছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোগান, অনেক মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাসহ ৬০ লাখ অনুসারী তার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলামী সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিকাশে তৎপর রয়েছেন। বর্তমান তুরস্ক ও বলকান অঞ্চলে যে ইসলামী পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাচ্ছে, তা শায়খ আফেন্দির মতো প্রভাবশালী আলেমদের কঠোর পরিশ্রম, তাকওয়া ও নিষ্ঠারই ফল। ২০১৩ সালে শায়খুল ইসলাম শায়খ মাহমুদ আফেন্দিকে তুর্কিস্তানে দ্বীনী শিক্ষা প্রচার-প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ইমাম কাসেম নানুতুভি রহ: অ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয়।

ইসমাইল আগা জামাতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা শায়খ মাহমুদ আফেন্দি নকশবন্দি ১৯২৯ সালে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ ট্রাবজনের মাইকো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলী আফেন্দি ও মা ফাতেমা হানিম আফেন্দি নিজ এলাকায় ধর্মপরায়ণ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। বাবার তত্ত্বাবধানে তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে পবিত্র কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। ১৬ বছরে উপনীত হলে তিনি আরবি, ফারসি, হাদিস, উসুলে হাদিস, ফিকাহ, বালাগত, কালাম, মানতিক ও ইসলামিয়াত বিষয়ে মাদরাসা থেকে ইজাজত লাভ করেন।

১৯৫২ সালে দুই বছরের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বান্দিরমা যান এবং সেখানে বিশিষ্ট স্কলার শায়খ আলী হায়দার আফেন্দির সাথে পরিচয় ঘটে। তিনি তাকে মুর্শিদ রূপে বেছে নেন এবং তার নির্দেশে তিনি ১৯৫৪ সালে ইসমাইল আগা মসজিদে ইমাম নিযুক্ত হন। ৪২ বছর ধরে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে তিনি নকশবন্দি ও মুজাদ্দেদি তরিকায় সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। পরবর্তীকালে এই তরিকার শায়খ হিসেবে তিনি স্বীকৃতি লাভ করেন। প্রতি বছর তিন সপ্তাহ তিনি দাওয়াতি, ইসলাহি ও মিশনারি তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে উজবেকিস্তান, ইংল্যান্ড, সিরিয়া, ভারত, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করতেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ তার হাতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন ও বহু পথহারা মানুষ সিরাতুল মুস্তাকিমের সন্ধানপ্রাপ্ত হন। ‘রুহুল ফুরকান’ নামে তুর্কি ভাষায় তিনি পবিত্র কুরআনের ১৮ খণ্ডের তাফসির প্রণয়ন করেছেন।

মুজাদ্দিদ শায়খ মাহমুদ আফেন্দি মানুষকে জ্ঞানার্জন ও ইবাদত করতে উৎসাহিত করেন শুধু কথার মাধ্যমে নয়, তার কর্মের মাধ্যমেও। তিনি কখনোই কোনো প্রকার ইবাদত পরিত্যাগ করেননি বা অবহেলা করেননি এবং যারা তার দৃঢ়তা দেখেছেন তাদের জন্য তিনি ছিলেন উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি তার অনুসারীদের ঈমান, তাকওয়া, নৈতিকতা ও মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও জ্ঞানে শিক্ষিত করার জন্য সারা জীবন মেহনত করে গেছেন। সুন্নাহ সম্পর্কে শায়খ মাহমুদ আফেন্দির অসামান্য জ্ঞান, শরিয়তের বিজ্ঞান সম্পর্কে তার গভীর মনীষা ও সামগ্রিকভাবে তার ইসলামী আচার-আচরণ মুসলিম বিশ্বের আলেম ও বিদ্বান মানুষ উভয়ের ওপরই দারুণ প্রভাব ফেলেছে। যাদের সাথে তিনি তার ভ্রমণকালে সাক্ষাৎ করেছেন অথবা যারা তার সাথে দেখা করতে এসেছেন প্রত্যেকেই সম্মোহিত হয়েছেন তার ক্যারিসম্যাটিক ব্যক্তিত্বের প্রভায়। সুতরাং শায়খ মাহমুদ আফেন্দি ন্যায়সঙ্গতভাবে ইসলামী বিশ্বে একটি নেতৃস্থানীয় অবস্থান আসীন হন এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রশংসা ও স্নেহে সম্মানিত হয়েছেন। তিনি অনেক আন্তর্জাতিক ইসলামিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামে সভাপতিত্ব করেন। মানুষকে জ্ঞানার্জন ও নবী মুহাম্মদ সা:-এর সুন্নাহ অনুসারে কাজ করতে উৎসাহিত করেন।

ধর্মশিক্ষা, ধর্মপ্রচার, অধ্যাত্ম সাধনার পাশাপাশি তিনি মানবসেবাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। মারিফাত সমিতি, ফেডারেশন অব মারিফাত অ্যাসোসিয়েশন্স, আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াত নামে দাতব্য, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তুরস্ক ও বলকান অঞ্চলে তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের আমলের মাধ্যমে সুন্নাহ ও তাকওয়ার শিক্ষা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তাকে অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৬০ সালের অভ্যুত্থান, জরুরি অবস্থা, সামরিক প্রশাসন কর্তৃক নানা নির্দেশ এবং ১৯৮২ সালে এস্কোদার অঞ্চলের মুফতি হত্যায় তাকে জড়ানো হয় এবং আড়াই বছর পর আদালত তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেন।

১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আদালতে উল্লেখ করা হয়, তার বক্তব্য ও পাঠ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থার প্রতি হুমকিস্বরূপ কিন্তু আদালত থেকে তিনি নির্দোষ হিসেবে খালাস পান। ২০০৭ সালে তাকে হত্যাচেষ্টায় তার গাড়িতে গুলি করা হয়। শত বাধা ও বিপত্তির মধ্য দিয়ে তিনি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন। ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বরের অভ্যুত্থানের আগে ডান ও বামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলাকালেই শায়খ মাহমুদ আফেন্দি তার কাছে আসা লোকদের বলেছিলেন, ‘আসুন জিহাদ করি, আমাদের দায়িত্ব হলো মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করা। ভালো কাজের নির্দেশ দেয়া ও অপকর্ম থেকে বিরত থাকা, মানুষ হত্যা করা আমাদের দায়িত্ব নয়।’ তিনি জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং অনেকাংশে সফল হন।

শায়খ মাহমুদ আফেন্দিকে ‘শতাব্দীর মুজাদ্দিদ’ মনে করা হয়। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই, আল্লাহ এমন একজন ব্যক্তিকে উত্থাপন করবেন যিনি প্রতি শতাব্দীর শুরুতে এই উম্মতের জন্য দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করবেন’ (আবু দাউদ, আল-মালাহিম-১ নং-৪২৯৩, ৪/১৭৮)। এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়- ‘তাজদিদের অর্থ হলো কুরআন ও সুন্নাহর ওপর আমল করা ও এটিকে এমন সময়ে পুনরুজ্জীবিত করা যখন কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশ ধ্বংস হয়ে যায়।’ সুতরাং এই হাদিসের ওপর ভিত্তি করে, আলেমরা প্রতি শতাব্দীর শুরুতে একজন মুজাদ্দিদ নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন। ১৬ জিলকদ, ১৪৩১ (২৪ অক্টোবর, ২০১০) আনুমানিক ৪৩টি দেশ থেকে ৪০০ জন প্রসিদ্ধ ও সম্মানিত উলামা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ইস্তাম্বুলে তারা ঘোষণা করেন, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি ১৫ হিজরি/২১তম গ্রেগরিয়ান শতাব্দীর মুজাদ্দিদ (পুনরুজ্জীবনকারী) ছিলেন এবং তাকে ‘মানবতার জন্য অসামান্য পরিসেবা’ পুরস্কার দেন।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর মুসলিম স্কলার্সের প্রেসিডেন্ট ড. ইউসুফ আল-কারাদাভি, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি তার অনুসারীদের ঈমান, তাকওয়া, উন্নত নৈতিকতা এবং মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও জ্ঞানের আলোতে প্রশিক্ষিত করার জন্য অনেক কাজ করেছেন। শায়খ মাহমুদ আফেন্দি আন-নকশবন্দি একজন সুফি ও হানাফি পণ্ডিত। তবে তিনি কুসংস্কার, বিদআত উদ্ভাবন বা বিভ্রান্তি ছড়ানো লোকদের অন্তর্ভুক্ত নন; বরং তিনি আল্লাহর কিতাব ও নবী সা:-কে দৃঢ়ভাবে মেনে চলেন। আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ইসলামিক পণ্ডিত ও মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা মোহাম্মদ আলী আস-সাবুনি, শায়খ মাহমুদ আফেন্দির অনুসারী হয়ে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি শুধু তুরস্কের নয়, পুরো বিশ্বের শায়খ।’

শায়খ মাহমুদ আফেন্দির পৃষ্ঠপোষকতায় তার আস্থাভাজন সেবা দল মাসিক মারিফাত নামে একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও সাংস্কৃতিক পত্রিকা প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে মুসলিম জনগণ, দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ও সহযোগিতার উন্নয়নে আগ্রহ সৃষ্টি এবং একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালানো হয়। ২০১১ সালে ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে তিনি পবিত্র মক্কা গমন করলে ৫০ হাজার ভক্ত-অনুরক্ত তার সফরসঙ্গী হন। এতে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা আঁচ করা যায়। ফতেহ উল্লেহ গুলেনও তুরস্কে আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে অনেকের পছন্দ। কিন্তু তার ব্যক্তিজীবনে সুন্নতে রাসূলের অনুসরণ নেই। শায়খ মাহমুদ আফেন্দি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি নিজে সুন্নতের পাবন্দ ও অন্যদের সুন্নাতের অনুসারী করার মেহনত করেছেন সারা জীবন। আমরা এই মুজাদ্দিদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি এবং প্রার্থনা করি, আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে তার দারাজাত বুলন্দ করে দিন, আমিন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement