২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা

- ছবি : সংগৃহীত

কুসিক নির্বাচনে কোন দলের প্রার্থী বিজয়ী হলেন তা নিয়ে তেমন আগ্রহের কারণ নেই। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তাহলে তাতেই আমাদের স্বস্তি ও সন্তুষ্টি। সেই সুষ্ঠু নির্বাচনে যে পদে যে দলের প্রার্থীই বিজয়ী হোন আমাদের বলার কিছু নেই। কিন্তু এখন আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা যেখানে গেছে সেটি বলতে গেলে একটি দুঃস্বপ্নের মতো। কুসিক নির্বাচনের পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও তাতে পরিবেশিত খবর খুব সতর্কতার সাথে পড়ার চেষ্টা করেছি। ১৬ জুন দৈনিক সমকালে একটি খবরের শিরোনাম ছিল- ‘সিইসি উৎফুল্ল নন, বেদনার্তও নন’। কুসিক নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন। এই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করলে এমনটি দাঁড়ায়- নির্বাচনী তরী তীরে এসে না ডুবলেও, হঠাৎ সৃষ্ট ঝড়ো হাওয়ায় তরী টালমাটাল হয়েছিল। যেমন- নির্বাচনকালে বহিরাগতরা বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে সমবেত হয়ে সাধারণ ভোটারদের ভোটদানে অসুবিধার সৃষ্টি করেছিল। এতে ভোটারদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ভোটের ফল ঘোষণার এক পর্যায়ে তুমুল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অথচ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি সেখানে লক্ষ করা যায়নি। কী কারণে তারা ছিল না তা জানা যায়নি। এসব ১০ মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা গো-মূত্রের মতোই। এ ছাড়া ইভিএম নিয়েও ছিল বড় বিপত্তি।

ইভিএম নিয়ে সমস্যা আসলে নতুন কোনো বিষয় নয়। একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া বড় দল বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে না পারা, এমপি বাহার ইস্যু ইত্যাদি মিলিয়ে ইসির সক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ তো থেকেই যাচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিলে আগামী বছর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কতটা আশাবাদী হওয়া যায় সেটিই বড় প্রশ্ন। এমপি বাহার ইস্যুকে সিইসি অতীতের ইস্যু ও তা শেষ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন। এমপি মহোদয় কি নির্বাচনী বিধিবিধান লঙ্ঘন করেননি? এখন তো মাত্র একটি ক্ষেত্রে এমন অনিয়ম। আগামী নির্বাচনের সময় যখন ৩০০ আসনে সিটিং এমপিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাগাতারভাবে বিধি লঙ্ঘন করতে থাকবেন, তখন ইসি কোথায় যাবে?

আমাদের সংবিধান মতে, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের ১২৩(৩)-এর বিধান হচ্ছে- সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে- ক. ‘মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’। সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন হলে এমপিদের কিভাবে অনিয়ম করা থেকে বিরত রাখবে ইসি সেই সক্ষমতা তাদের আছে। অবশ্য নির্বাচনী বিধিতে এ সম্পর্কে প্রতিবিধান রয়েছে, যেমন- সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা-২০১৬-এর ২২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগীরা নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবেন না। এমপিরাও এই বিশেষ সুবিধাভোগীদের আওতায় পড়েন। আমাদের সংবিধান অনুসরণ না করা নিয়ে বহু কথা বলা হয়েছে। সেখানে এসব বিধির তোয়াক্কা করবে কারা। যেমন করেননি এমপি বাহার। প্রচারণায় বিরত থাকার জন্য ইসি তাকে এলাকা ছাড়তে বললেও তিনি তাতে একটুকু তোয়াক্কা করেননি। তাকে এলাকা ছাড়তে বলার বিরুদ্ধে সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এর বিরোধিতা করেছেন। তারা এমপি বাহারের মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্নও তোলেন। কিন্তু অহরহ যে, এখানে সেখানে মানবাধিকার ধুলায় লুটোপুটি খায়, সেখানে কিন্তু কখনোই কারো দৃষ্টি নেই।

যাই হোক, এসবই কিন্তু গণতন্ত্রের পথকে অমসৃণ করে তুলছে। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অবশ্যই এমন বিধান অন্তরায় সৃষ্টি করবে। এসব নিয়ে আসলেই সবাইকে ভাবতে হবে। এ পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ইসি অসহায় হয়ে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের বাহু এত সবল নয় যে সে নিজেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সংবিধানের বিধানাবলি নিয়ে সমাজের অগ্রসর মানুষ, সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্র স্বার্থের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সবাইকে বহু দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। শুধু বর্তমান নিয়ে মত্ত থাকলে চলবে না। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। কিছু লোক দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন, মানবাধিকার সুরক্ষিত হোক, এসব মুখে বলে, কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেটি হাওয়া হয়ে যায়। সে জন্য ৫০ বছরেও এসব ব্যবস্থা কায়েম করা যায়নি। ফলে পদে পদে আমাদের হোঁচট খেতে হচ্ছে। সবাই স্বীয় স্বার্থের জগৎ থেকে দেশের স্বার্থ দেখার জন্য মর্তে নামতে পারেনি। এ কারণে সংবিধানের সব অনুচ্ছেদ ও বিধিবিধানের ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করা যায়নি। সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী হয়েছে। এর বেশির ভাগই ব্যক্তিস্বার্থে তথা সঙ্কীর্ণ স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। সেটি ব্যক্তি বিশেষকে সুরক্ষা দিয়েছে বটে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে তা কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সে সংশোধনীগুলো তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের জন্য হয়েছে বটে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কোনো কল্যাণ তাতে হয়নি। কেন না, সেখানে ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণের বিবেচনায়।

আমরা শুরুতে ইভিএম নিয়ে সামান্য ইঙ্গিত দিয়েছি। এটি নির্বাচনের জন্য যে ‘ট্রাবল ক্রিয়েটার’। সর্বশেষ কুসিক নির্বাচনেও সেটি লক্ষ করা গেছে। সে ক্ষেত্রে যখন আরো বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা হবে তখন সে ট্রাবল হবে অনেক বেশি। কিছু আইটি বিশেষজ্ঞকে ইভিএম পরীক্ষার জন্য ইসি আমন্ত্রণ জানিয়েছিল শুনেছি। কিন্তু ইসি গোড়ায় হাত দিচ্ছে না কেন? দেশের ৬৪ হাজারেরও বেশি গ্রাম-গঞ্জ রয়েছে। সেখানে অন্তত কিছু লোককে আমন্ত্রণ জানান (তবে বেছে বেছে আনবেন না), তাদের স্বাধীনভাবে ইভিএম চালাতে বলুন না কেন? দেখুন কী ফল হয়। এমনকি ঢাকা শহর থেকে সাধারণ মানুষকে ডেকে নিয়ে আসুন, দেখা যাক ফলটা কী দাঁড়ায়। আপনারা বলবেন, ভোট গ্রহণের সময় তাদের সাহায্য করতে তো লোক থাকবে। সে সাহায্যকারীদের কি আসমান থেকে নিয়ে আসবেন, না আমাদের মধ্য থেকে নেবেন! এসব মানুষের হুঁশজ্ঞান তো যথেষ্ট, অবশ্যই তাদের মনের গভীর কোণে একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস তো লালিত হচ্ছে। সেটি যদি ভোটে সাহায্য করার সময় বেরিয়ে আসে, তবে কী করবেন। আপনারা তো অন্তর্যামী নন যে মানুষের মনের মতলব জানবেন। সে যাক, পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম চালু করেও শেষে তা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কেন বেরিয়ে এসেছে জানার চেষ্টা করুন। এই উপ-মহাদেশেরও একটি দেশ সম্প্রতি ইভিএম থেকে সরে আসতে আইন পাস করেছে। আমরা প্রযুক্তির বিপক্ষে নই। আমাদের জিজ্ঞাসা হচ্ছে, নির্ভেজাল গণতন্ত্র আগে, না প্রযুক্তি আগে? এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। প্রয়োজনে জনগণের মতামত নিন না কেন। তারাই তো এ দেশের মালিক-মোক্তার, তাদের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করা ঠিক নয়।

আরেকটি কথা, ইভিএম ক্ষমতাসীন দলের মনোবাঞ্ছা আমরা জানি। ইভিএম ব্যবহারে নানা কারণে তাদের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। ক্ষমতাসীন দল অবশ্য নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু সে সাথে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের ইভিএম নিয়ে মতামত জানা ইসির জন্য অতিআবশ্যিক। ইভিএম নিয়ে তাদের মতামত জানার ব্যাপারে ইসির চেষ্টা-আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, এ প্রশ্নে ইসি যেন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির এমন ভূমিকা কেউই সমর্থন করবে না।

ইভিএম নিয়ে কথা শেষ করব নির্বাচন সম্পর্কিত একজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য দিয়ে। তিনি হচ্ছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম। একটি জাতীয় দৈনিকে তার একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘...নির্বাচনে পরাজিত প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু অভিযোগ করেছেন যে, তাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে প্রমাণ করা যাবে যে তাকে পরিকল্পিতভাবে হারিয়ে দেয়া হয়নি। কারণ ইভিএমে যে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে কোনো পেপার ডকুমেন্ট নেই যে, ভোট পুনর্গণনা করা যাবে এবং বলা যাবে যে, এতে অসঙ্গতি নেই। অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন আমাদের যে তথ্য দেবে সেটাই মেনে নিতে হবে। অথচ এর ওপর নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু।

ইভিএমের দু’টি দুর্বলতা সামনে এসেছে। একটি হলো- এই প্রক্রিয়া ভোটারদের ভোট দানে বিরত রাখছে ও অন্যটি এর কোনো পেপার ডকুমেন্ট থাকে না বলে এর ভোট গণনা প্রশ্নবিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে মরহুম প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীর কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যখন এই যন্ত্র কেনা হয়, তখন নির্বাচন কমিশনের কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। ওই সময় ইভিএম কেনার সুপারিশপত্রে তিনি স্বাক্ষর করেননি যন্ত্রটির এই দুর্বলতার জন্য। ভারতেও দেখা গেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইভিএমে পেপার ডকুমেন্ট যুক্ত করা হয়েছে।

এখন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও ইভিএমের দুর্বলতার বিষয়টি আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক। কারণ কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাত্র একজন সংসদ সদস্য প্রচারের সময় ছিলেন এবং আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন। আর জাতীয় নির্বাচনে থাকবেন ৩০০ এমপি। প্রশাসনের ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা যারা অতীতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন বা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছেন তারাও থাকবেন। এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ও কয়েক হাজার প্রার্থীও থাকবে। এতগুলো পক্ষ যখন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে, তখন তাদের ব্যাপারে ইসি কী করতে পারবে? সুতরাং যে ইভিএম মানুষকে ভোট দিতে বিরত রাখে, তা ব্যবহার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর যে দুর্বলতা- পেপার ডকুমেন্ট না থাকা, সেটি দূর না করলে নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে।’

আমাদের সরল প্রশ্ন আছে। সাক্কুর মতো সামান্য ভোটে যারা হেরে যাবেন, তারা যদি পুনরায় ভোট গণনার দাবি জানান। তাদের সে দাবি নিয়ে কী করা যাবে? যন্ত্র তো যন্ত্রই, সে তো একই ফল আবারো জানাবে। অথচ ব্যালটে ভোট হলে, দ্বিতীয়বার ভোট গণনার সময় বহু ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ফল উল্টে গেছে। এমন না হলে বহু প্রার্থীর অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে। সে ক্ষেত্রে ইভিএম বহু প্রার্থীর অধিকারকে তুচ্ছজ্ঞান করবে, ভোটের সঠিক ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীবিশেষ বঞ্চিত হতে বাধ্য।

ইসি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সাথে ইভিএম নিয়ে সংলাপ করেছে। প্রায় সবাই ইভিএমের বিপক্ষে কথা বলেছে। তবে এখন প্রধান দুই বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সাথে ইসির আলোচনা হয়নি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে ইভিএম নিয়ে তাদের নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এ লেখা প্রকাশের আগেই ইসি আরো কিছু দলের সাথে কথা বলবে। আমরা জানি না, যে মতামত ইতোমধ্যে প্রতিভাত হয়েছে তাতে ইসির পক্ষে জোর জবরদস্তি ছাড়া ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে কি না। তবে একটি ঘটনার পর মনে হচ্ছে, সিইসি এক ‘আন প্রেডিক্টেবল ম্যান’ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছেন। আমাদের এই ধারণার ভিত্তি হচ্ছে দৈনিক প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন। সেটি এখানে উদ্ধৃত করছি। সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে- ‘তখন চিঠিতে ইসি যা বলেছিল, এখন বলছে ঠিক তার উল্টোটা।’ খবরে বলা হয়, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে এলাকা ছাড়তে চিঠি দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ইসির চিঠি আমলে নেননি, এলাকা ছেড়ে যাননি। উল্টো ইসির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এর জবাবে তখন দুই নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, একজন সম্মানিত লোককে টেনে-হেঁচড়ে নামানো কমিশনের কাজ নয়। আর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন, সংসদ সদস্য এলাকা না ছাড়লে কমিশনের তেমন কিছু করার নেই।... ভোটের পাঁচ দিন পর বাহাউদ্দিনের বিষয়ে এখন ভিন্ন সুরে কথা বলেছে কমিশন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল কুমিল্লার ভোট নিয়ে গত ২০ জুন ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে (কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন) আমরা স্থান ত্যাগ করতে বলতে পারি না এবং বলিনি। কাজেই তিনি আইন ভঙ্গ করেননি। আমরাও ব্যর্থ হইনি। তবে সিইসি এখন এমন কথা বললেও ৮ জুন বাহাউদ্দিনকে দেয়া চিঠিতে ইসি বলেছে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি স্থানীয়ভাবে তদন্ত করালে লিখিত অভিযোগের সতত্যা পাওয়া যায়, যা মোটেই কাম্য নয়। উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, যেহেতু আপনি (বাহাউদ্দিন) বিধিবহির্ভূতভাবে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করেছেন, তাই আপনাকে ২৫৪ (সংসদীয় এলাকা) কুমিল্লা-৬ নির্বাচনী এলাকা ত্যাগের নির্দেশনা দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এমতাবস্থায়, অবিলম্বে আপনাকে উল্লিøখিত নির্বাচন এলাকা ত্যাগ করে আচরণবিধি প্রতিপালন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করছি।’

এমন অবস্থান নেয়ার পর ইসি কোন চাপে পশ্চাদপসরণ করল তা আমরা জানি না। এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে, বৃহত্তর পরিসরে নির্বাচনের সময় ইসি যে চিৎপটাং হবে তাতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রইল না।

কুসিক নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর ইসি তার একটি মূল্যায়ন করবে তাতে সন্দেহ নেই। পাঁচ বছরের মেয়াদ কোনো ইসির জন্য খুব কম সময় নয়। এ সময় জাতীয় পরিষদসহ অনেকগুলো নির্বাচন তাদের করতে হবে। কুসিক নির্বাচন ছোট পরিসরে হলেও এ নির্বাচন থেকে তাদের অনেক বিষয় বিবেচনায় নেয়ার ও বোঝার আছে বলে সবাই মনে করে। এই কমিশন ভবিষ্যতে কী করতে পারবে জানি না সত্য, কিন্তু এটি বুঝি যে, দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা গভীর এক খাদের তলায় পৌঁছেছে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব কিন্তু বর্তেছে আউয়াল কমিশনের ঘাড়ে।

সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন ছিল, তা নিয়ে কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। তেমনি ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের সরকার অনেক দিন ক্ষমতায় ছিল। সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি। উভয় ক্ষেত্রে কারণ মাত্র একটি, দুই জায়গাতেই অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় ছিল। আমাদের এখানে কিন্তু সেরকম মানসম্পন্ন নির্বাচন হয়নি বা হতে দেয়া হয়নি। অথবা তদনীন্তন ইসির সাংবিধানিক দায়িত্বে থাকা সিইসি ও অন্য কমিশনারদের সক্ষমতা বা আন্তরিকতার অভাব কিংবা অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হওয়ার কারণে টানা ১০ বছর জাতীয় অথবা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের কোনোটিই প্রশ্নমুক্ত অথবা সবার কাছের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো হয়নি। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সেসব নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তাই তো আমাদের গণতন্ত্রের ইতিহাস দীর্ঘ দিন কালো মেঘে ঢেকে আছে। আজ সবারই এই প্রশ্ন- বর্তমান আউয়াল কমিশন কি নির্বাচনের আকাশ মেঘমুক্ত করতে পারবে? কুসিক নির্বাচনের পর সিইসি যে মন্তব্য করেছেন তার প্রথমাংশ হচ্ছে, তিনি এ নির্বাচন নিয়ে উৎফুল্ল নন। প্রথম এসিড টেস্ট হিসেবে তিনি পাস মার্ক পেতে পারেন। এ দিয়ে কিন্তু চলবে না। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলো কিন্তু এখনো দেখা যাচ্ছে না। তা ছাড়া পথও দীর্ঘ ও সেটি মসৃণ নয়, কণ্টকমুক্ত নয়। সেই দীর্ঘপথ অতিক্রম করতে গিয়ে আঁধারও নামতে পারে। বজ্রাঘাত আসতে পারে। এ জন্য অকুতোভয় থাকতে হবে। সব কিছু সামলাতে হবে। যাদের ওপর ইতিহাস গড়ার দায়িত্ব তাদের কৌশলী হতে হবে, কূটকৌশলী নয়।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement