আন্দোলনের পূর্বাপর জাতীয় সমঝোতা সনদ
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২২ জুন ২০২২, ২০:৪৪, আপডেট: ২২ জুন ২০২২, ২০:৪৭
একটি জাতিরাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই সমঝোতার মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এ সমঝোতার বিষয়টি কখনোই আকস্মিক নয়। দীর্ঘকালব্যাপী সংগ্রাম, সক্রিয়তা ও সাধনার মাধ্যমে তা অর্জিত হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেতাবি ভাষায় একে বলা হয়, ‘ন্যাশনাল কন্সেনসাস’ বা জাতীয় ঐকমত্য। বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের পূর্বাপর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে নদীর বহমানতার মতো সে ইতিহাস অতিক্রম করেছে ‘গিরি-দরি-বন,পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, সাগর-অতল’। ১৯৭১ সালে জাতি হিসেবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর নিরঙ্কুশ জাতীয় সমঝোতা বা জাতীয় ঐক্য অর্জিত হয়নি। ঘোষিত স্বাধীনতার লক্ষ্য- ‘সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা’ অর্জিত হয়নি ৫০ বছরেও। শাসনব্যবস্থা পরিচালনার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জন করেনি। যারা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতা দখল করেছিল তারাই বাকশালের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছে। উদার সামরিক তন্ত্র ও অনুদার সামরিক তন্ত্রের আবর্তন-বিবর্তনে গণতন্ত্র অবশেষে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়েছে। অব্যাহত অস্থিরতা ও অসমঝোতার পর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনে বিরল সাময়িক রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
সে সময়ের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী জাতিকে একটি সমঝোতার রূপরেখা উপহার দিয়েছিল। আন্দোলনরত তিনটি জোট চূড়ান্ত পর্যায়ে জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি করেছিল। এ তিনটি জোট ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দল ও বামপন্থীদের ৫ দল। ইসলামপন্থী জামায়াতে ইসলামী একই সাথে এ যৌথ আন্দোলনে শামিল ছিল। ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই তিনটি জোট আলাদা আলাদা সমাবেশে রূপরেখা তুলে ধরে। যুগপৎ যৌথ আন্দোলনের এতটাই তীব্রতা ছিল যে, ১৫ দিনের মাথায় এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। রূপরেখা অনুযায়ী প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছিল। একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হয়েছিল। জনগণের ভালোবাসায় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপি। তিন জোট ও এক দলের সমঝোতার ভিত্তিতে দেশে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার বদলে সংসদীয় ব্যবস্থা মেনে নিয়ে জাতীয় সমঝোতার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। জাতীয় সমঝোতার এ প্রাথমিক অর্জন পরবর্তী ইতিহাস সুখের নয়।
ত্রিপক্ষীয় জোটের জাতীয় সমঝোতায় অনেক কথা বলা হয়েছিল। সরকারি দল ও বিরোধী দল জাতির কাছে ওয়াদা করেছিল তারা নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের পথ অনুসরণ করবে। সরকার, বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়ন করবে না। আর বিরোধী দল নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথে চলবে। উভয়পক্ষের অঙ্গীকার ছিল তারা হত্যা, অভ্যুত্থান ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করবে না। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠিত হবে। নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত থাকবে। আইনের শাসন অব্যাহত থাকবে। মৌলিক অধিকার পরিপন্থী আইন বাতিল করা হবে। সেদিন সব রাজনৈতিক দল ও জোট জাতিকে আশ্বস্ত করেছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথে দেশ চলবে। তিন জোটের তুমুল আন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো ‘পারস্পরিক আচরণবিধি’ নামে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল।
আচরণবিধির তিন নম্বর ধারায় অঙ্গীকার করেছিল ‘আমাদের তিনটি জোটভুক্ত দলগুলো ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা এবং অপর দলের দেশ প্রেম ও ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে কটাক্ষ করা থেকে বিরত থাকব’। কেউ কথা রাখেনি। সরকারি দল নিরঙ্কুশ ও নির্ভেজাল গণতন্ত্রের অনুশীলন করেছিল বলা যাবে না। ১৯৯০-এর নির্বাচনে নির্বাসিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সমঝোতার রূপরেখা অস্বীকার করে অস্থিরতা ও অরাজকতার পথ বেছে নেয়। বিরোধী দল সংসদ বর্জন করেছিল। নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছিল। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ দিন হরতাল পালন করেছিল, অবরোধ করেছিল, অগ্নিসংযোগ করেছিল, অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্জিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করে তারা সেই ত্রিপক্ষীয় যৌথ ঘোষণার বিপরীত কাজই করেছিল। স্বভাবসুলভ অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার এবং অবিচারের পথে হেঁটেছিল তারা। অবশেষে ২০০১ সালের অবাধ নির্বাচনের জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় ফিরে আসে। এবারও স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি তাদের সেই অঙ্গীকার পরিত্যক্ত হয়। সমঝোতার পথে না গিয়ে সঙ্ঘাতের পথে যায় তারা। ঘটে যায় রাজপথে সেই লগি বৈঠার নিষ্ঠুর তাণ্ডব। পরিকল্পিতভাবে ঘটে ১/১১-সেই ষড়যন্ত্র।
দূরবর্তী ও নিকটবর্তী শক্তির যৌথ প্রযোজনায় তারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত ২০০৯ সাল থেকে আজ ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করছে এক দুঃশাসনের দুষ্টচক্র। গত দেড় দশকে যা হয়েছে তা দেশের সাধারণ মানুষ তাদের যাপিত জীবন দিয়ে অনুভব করছে। মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। গুম, খুন, হামলা-মামলায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে গণজীবন। দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত দেশ। দ্রব্যমূল্যের লালঘোড়া দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে জনজীবন। লুটপাট, অর্থপাচার, ভূমিদস্যুতায় বাংলাদেশ বিপর্যস্ত। মানুষ এ দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়। যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের আওয়াজ উচ্চকিত হয়, প্রতিকার প্রত্যাশিত হয়, এবং ন্যায়বিচারের আশা জাগ্রত হয়Ñসেসব প্রতিষ্ঠান আজ অকার্যকর। আইনসভার নিকৃষ্ট বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে, প্রশাসনের নিকৃষ্ট দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, বিচারবিভাগের নিকৃষ্ট দলীয়করণ পরিদৃষ্ট। মানুষ এ দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়। মুক্তির আকাক্সক্ষায় উদ্বেল। যেকোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর জন্য উদ্বিগ্ন তারা।
পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে নির্বাচন তা নির্বাসিত হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ প্রমাণ রেখেছে যে তারা পরিবর্তনে কতটা আকুল ও ব্যাকুল। ক্ষমতাসীন দল নিশ্চিত হয়েছে যে ব্যালটের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার আশা তাদের শুধুই নিরশা। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যম ব্যতীত তাদের ক্ষমতায় থাকার কোনো উপায় নেই। বিরোধী ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠী এমনকি অরাজনৈতিক জনস্বার্থমুখী সংগঠনকেও তাদের ভয়। কোথাও দাঁড়াতে দেয় না তাদের। ইদানীং পুলিশেও ভরসা পাচ্ছে না মনে হয় তারা। তাই তরী হয়েছে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনী। সর্বত্র ভীতির রাজত্ব। সারা দেশ পরিণত হয়েছে এক অঘোষিত কয়েদখানায়।
বাংলাদেশ জন্মগতভাবেই গণতন্ত্রের দেশ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, এ দেশের মানুষ অতিমাত্রিক রাজনীতিক। তাই ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যায়-অনাচার, অত্যাচার যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে মুক্তির আকাক্সক্ষা। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রকামী মানুষ নিরন্তর সংগ্রাম করে আসছে। বার বার তাদের সংগ্রাম, আন্দোলন ও আত্মত্যাগ ব্যর্থ হয়েছে শক্তি প্রয়োগে, নির্মম, নিষ্ঠুরতায়। শুধু তাই নয় পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক মাধ্যম নির্বাচনকেও ব্যবহার করতে পারেনি বিরোধীপক্ষ। শাসকদলের ছলবল ও কলাকৌশলে পরাজিত হয়েছে তারা।
আবারও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি পরিবর্তনের সুযোগ সমাগত। ২০২৩ সালের নির্বাচনকে একটি সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে চায় জনগণ। প্রথমত শাসকদল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এটি ক্ষমতাপাগল শাসক দলের জন্য স্ব-আরোপিত সর্বনাশের কারণ ঘটাতে পারে। দ্বিতীয়ত অন্যায় অভ্যুত্থান ও ন্যায়ের গণ-অভ্যুত্থানের চেয়ে শ্রেয় এই সাংবিধানিক পরিবর্তন। আওয়ামী লীগ যদি হেরে যায় এ নির্বাচনে তাহলে তাদের অগৌরবের কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের বিগত বার্ষিক সভায় বলেছেন, জনগণের রায় তিনি মেনে নেবেন। অবশেষে যদি তার শুভবুদ্ধির উদয় ঘটে তাহলে তা হবে বাংলাদেশের মানুষের জন্য তার শ্রেষ্ঠ উপহার। ঘরপোড়া গরু নাকি সিঁদুর দেখতে ভয় পায়। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা শুভবুদ্ধির পরিবর্তে অশুভবুদ্ধি দেখতেই অভ্যস্ত। ২০১৪ সালে বলা হয়েছিল আরেকটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে। মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছিল তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল।
২০১৮ সালে বলা হয়েছিল, আমায় বিশ্বাস করুন। জনগণ তাকে বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে জনগণ এ কথা বলতেই পারে, ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘুঘু তোমায় করিব খান খান।’ এই খান খান বা পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতোমধ্যেই সরব সমীকরণ লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা আশার কথা যে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এ মুহূর্তে সব রাজনৈতিক দলের প্রত্যাশা ও কর্মসূচি লক্ষ করা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাম ঘরানার সাতটি রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ এর শুভ সূচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদের ঘোষণা মোতাবেক জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় এটি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে এ কথা জানা যায়।
বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রত্যয়ে বিএনপি এখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ শুরু করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অন্য দিকে ডান-বাম, দক্ষিণ-পশ্চিম সবধরনের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের পক্ষে তাদের কর্মসূচির কথা ঘোষণা করছে। এ লক্ষ্যে চরমোনাই পীর সাহেবের রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলন’-এর তৎপরতা লক্ষ করার মতো। অন্যান্য ইসলামী দলগুলোও একই লক্ষ্যে সক্রিয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী সব দলমত ও পথের লোকেরা একই প্লাটফর্মে আন্দোলন করবে, এটা আশা করা যায় না। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে তাই একক ও যৌথ আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৯০ সালে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সব আন্দোলনে বিরোধী দল ভিন্ন ভিন্নভাবে এবং যৌথভাবে আন্দোলন পরিচালনা করে। এভাবে ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বিরোধের মাঝে ঐক্য অর্জিত হলে পরিবর্তন প্রক্রিয়া সহজতর হবে। সব আন্দোলনকারী দল ও জোটের অভিন্ন রূপরেখা ও কর্মসূচি অনিবার্য বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। এ লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ধারায় আরেকটি যৌথ রাজনৈতিক সনদে পৌঁছানো যায় কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের বিরাজিত রাজনৈতিক বিভাজন হ্রাস করার জন্য অনেক দিন ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন কাজ করে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক সঙ্কটের টেকসই সমাধানের জন্য সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার একটি ‘জাতীয় সনদ’ উপস্থাপন করেছিলেন। এই জাতীয় সনদের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যাগুলো রাজনৈতিকভাবেই সমাধানের প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি আশা করেন যে, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। তিনি প্রস্তাব করেন যে, সংলাপের মাধ্যমে যতগুলো বিষয় জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠবে কতগুলো বিষয়ে একটি জাতীয় সনদ প্রমিত ও স্বাক্ষরিত হতে পারে।
অতীতে তিনি সম্ভাব্য ঐকমত্যের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেন এভাবে, ক. নির্বাচনকালীন সরকার, খ. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নর্বাচনী আইন সংস্কার, গ. নির্বাচন পরবর্তী সরকারের জন্য করণীয়। তিনি মনে করেন নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলতন্ত্রের ভয়াবহ প্রভাব বিস্তারের কারণে অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোও যে কারচুপি ও কারসাজিমুক্ত হবে না, তা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এ যে এখন ২০২২ সালে এসে ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে সবাই নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে। এ ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মনোভাব এতই শক্ত যে নির্বাচনের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিএনপি সব রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনা কৌশল আঁটছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার নির্বাচন পূর্ববর্তী ও নির্বাচন পরবর্তী অবস্থান ঠিক থাকে না। রাজনৈতিক ব্যক্তি দল ও গোষ্ঠী সবসময় সুবিধাজনক ব্যাসার্ধ গ্রহণ করে। তখন ছোট ছোট রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবর্গ বিব্রত হয়। তা ছাড়া জাতীয় আশা ও আকাক্সক্ষার বিষয়ে দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত থাকে। সেগুলোর সমন্বয় করাও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের গণ-আকাক্সক্ষা ‘পরিবর্তন’। মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ঠেকা থেকে শিখে মানুষ। তারা বলে, ‘যে যায় লঙ্কা সে হয় রাবণ।’ ক্ষমতায় গেলে অতীতের কথা মনে থাকে না। নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি ভুলে যায় তারা।
১৯৭৪ সালে যে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট হয়েছিল তা বাতিলের কথা জানিয়েছিল প্রতিটি রাজনৈতিক দল। ক্ষমতায় গিয়ে তারা কথা রাখেনি। বরং ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাক্টের মতো কালাকানুন জারি করে ক্ষমতার মসনদকে নিরাপদ করে তারা। সে জন্য সব কিছু লিখিত হওয়া ভালো। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল মনে করে ২০১৪ সালের বোগাস নির্বাচন পরবর্তীকালের বিদেশী চাপে তিনি যে শিগগিরই আরেকটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা যদি লিখিত হতো বা সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি আকারে প্রকাশিত হতো তাহলে এত সহজে বিশ্বাস ভঙ্গ করা যেত না। আবার একই কথা হয় ২০১৮ সালের নির্বাচন প্রশ্নে। বড় বড় নেতারা গণভবনে গেলেন। ভদ্রতার সৌজন্যে আপ্লুত হলেন। ভুলে গেলেন যে সংলাপের একটি লিখিত সারমর্ম প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়া প্রয়োজন। যদি সেদিন এটি হতো বিশ্বাস ভঙ্গ করা সহজ হতো না।
সম্ভবত এসব বিষয়ে বিবেচনা করে প্রবীণ রাজনীতিক বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ উদ্দিন একটি লিখিত চুক্তির কথা বলেছেন। গত শনিবারে প্রেস ক্লাবে এক সেমিনারে তিনি সম্ভাব্য রাজনৈতিক আন্দোলনের আগে সব মত ও পথকে সমন্বিত ও নিশ্চিত করার জন্য এ কথা বলেন। উল্লেখ্য, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় সরকারের কথা বলেছেন। এতে আন্দোলনকারীরা রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতার প্রশ্নে আশ্বস্ত হবে। এখন যদি আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী আন্দোলনের লক্ষ্য ও কর্মসূচি সম্পর্কে একটি লিখিত চুক্তিতে উপনীত হয়, তাহলে জাতীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের আগে ও পরে স্বাক্ষরিত জাতীয় সমঝোতা একটি স্বীকৃত সনদ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ধরনের জাতীয় সমঝোতা সনদকে অনেকে ন্যাশনাল চার্টার বলেও অভিহিত করেন। সংশ্লিষ্ট সবার অংশগ্রহণে অর্থাৎ নেতা ও জনগণের অংশগ্রহণে এটি হয়ে উঠবে জাতির মুক্তিসনদ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা