কোম্পানীগঞ্জে কাড়াকাড়ি
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ২১ জুন ২০২২, ২০:৩৪, আপডেট: ২২ জুন ২০২২, ০৫:৫৩
বন্যা এখনো চলছে। সিলেট অঞ্চলে বিশেষ করে বন্যার প্রাদুর্ভাব বেশি। এমনি এক বন্যায় ডুবেগিয়েছিল সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ। বন্যা হলে সরকার ত্রাণ কার্য পরিচালনা করছে এমন তো দেখাতে হয়। সে দেখানোর ত্রুটি ছিল না। এমপি এসেছিলেন কিছু ত্রাণও এনেছিলেন। ক্যামেরা অফ, ত্রাণ বন্ধ। এ সম্পর্কে ঢাকার একটি প্রথম সারির পত্রিকা রিপোর্ট করেছে, ‘কোম্পানীগঞ্জে ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি’।
সে রিপোর্টে বলা হয়েছে, সিলেটে ত্রাণের জন্য ছুটছে মানুষ। ক্ষিদের জ্বালায় অস্থির বন্যার্তরা। কোথাও কোথাও ত্রাণ কেড়ে নিচ্ছে তারা। হয়ে উঠছে উচ্ছৃঙ্খল। শৃঙ্খলা ফেরাতে পুলিশ লাঠিচার্জও করেছে। ২১ মে দুপুরে ঘটে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের সদরে এ ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রী ফিরে আসার পর স্বল্প পরিমাণ ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে কয়েক শ’ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। এর আগের দিন বিকেলে নগরীর কুমারগাঁওয়েও ঘটেছে একই ঘটনা। মেয়র ত্রাণ নিয়ে গেলে শ’খানেক মানুষ হাজির। এখানেও ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে বন্যাকবলিত সিলেট জেলার অর্ধেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের ১২টি ওয়ার্ড পানির নিচে। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ নেই অনেক এলাকায়। দুর্যোগে আটকা পড়েছেন অনেকেই। ফলে আবার সঙ্কট চরমে পৌঁছেছে। বন্যায় আক্রান্ত বহু মধ্যবিত্ত পরিবার অভুক্ত রয়েছেন বা শুকনো খাবার খেয়ে দীনাতিপাত করছেন। সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ। অথচ যে ত্রাণ এসেছে সেগুলো এক-তৃতীয়াংশ মানুষও পাবে না। এ কারণে হাহাকার বেড়েছে। গত সপ্তাহে সিলেট সফর করে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান। তারা বলে গিয়েছিলেন সরকারের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। কেউ অভুক্ত থাকবে না। এর পরও সিলেটে ত্রাণ সঙ্কট কাটেনি। বেসরকারি উদ্যোগও তেমন নেই। ব্যক্তি পর্যায়ে এগিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন। জৈন্তাপুর, বয়ানঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এই তিন এলাকা নিয়ে সিলেট-৪ আসন। সীমান্ত ঘেঁষা ওই তিন উপজেলা সবার আগে প্লাবিত হয়েছে। ত্রাণ একেবারে নেই তা নয়, তিন উপজেলার ৬০ ভাগ এলাকা পানির নিচে। বহু মানুষ পানিবন্দী। দুর্গতদের মধ্যেই অর্ধেকেই পাচ্ছে না ত্রাণ। এলাকার সংসদ সদস্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহম্মদ গতকালই আসেন নিজের এলাকায়। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম জোরদার করতেই তার এই আগমন। সকালে সিলেট বিমানবন্দরে নেমেই তিনি ছুটে যান কোম্পানীগঞ্জে, সাথে ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। উপজেলা সদরের প্রধান সড়কের পাশে তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন। মন্ত্রী আসার খবরে কয়েক শ’ বন্যার্ত মানুষ অবস্থান নেন উপজেলা সদরে। মন্ত্রীর উপস্থিত থেকে ৩০ জনের হাতে ত্রাণ বিতরণ করেন। ত্রাণ বিতরণের আগে তিনি উপস্থিত বন্যার্ত মানুষের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। ‘তিনি বলেন, আপনারা আপাতত কষ্টে আছেন, আমি চেষ্টা করব আপনাদের কষ্ট লাঘবের।’ এ সময় তিনি প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমার আসার আগেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা ত্রাণ বিতরণ শুরু করে দিয়েছেন। আমাদের কাছে ত্রাণসামগ্রীর অভাব নেই।
এ দিকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে মন্ত্রী যখন গাড়িতে উঠে রওনা দেন, তার পরই ওখানে ঘটে উচ্ছৃঙ্খল ঘটনা। মন্ত্রী চলে আসার পরপরই জানিয়ে দেয়া হয়, আর ত্রাণ নেই। পরে দেয়া হবে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন উপস্থিত কয়েক শ’ বানভাসি। তারা ত্রাণের জন্য হট্টগোল শুরু করেন। স্থানীয় মুজিবনগর আশ্রয়কেন্দ্র ও এম সাইফুর রহমান আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য রাখা হয়েছিল ৬০টি ত্রাণের প্যাকেট। এই প্যাকেটগুলো ছিনিয়ে নিতে এক সাথে সেগুলোর ওপর হামলে পড়েন বেশ কয়েকজন। এতে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেকে ত্রাণের প্যাকেট ছিনিয়েও নেন। পরে উপস্থিত পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে লাঠিচার্জ করে। ছয়টি ইউনিয়নে প্রত্যেক চেয়ারম্যানের হাতে নাকি ২০টি করে প্যাকেট দেয়া হয়েছে। এর বাইরে আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য প্যাকেট ছিল। ইউএনও লুসিকান্ত জানিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য প্যাকেট ছিল। এখন তালিকা করে সবার কাছে ত্রাণ পৗঁছে দেয়া হবে। সিলেটের ত্রাণ কর্মকর্তা বলেছেন, জেলার জন্য সরকার থেকে ৪০০ টন চাল বরাদ্দ এসেছে। এর মধ্যে ২৯৫ টন বণ্টন করা হয়েছে। তিনি জানান, এখন তালিকা করে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।
নগরীর টুকের বাজারেও ঘটেছে একই ঘটনা। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সেখানে ত্রাণ বিতরণ করতে যান। তার সাথে ছিল অল্পকিছু ত্রাণের প্যাকেট। কিন্তু ত্রাণের জন্য উপস্থিত হন শ’খানেক মানুষ। ত্রাণ ফুরিয়ে গেলে বন্যার্ত মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি দেখা দেয়। এতে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। উপস্থিত মানুষের কথা বিবেচনা করে, অতিরিক্ত ত্রাণ নিয়ে এসে ওই এলাকায় বিতরণ করেন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান জানান যে, সিটি করপোরেশনের জন্য এ পর্যন্ত ১৩ টন চাল সরকার থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এই চাল পর্যাপ্ত নয়। নগরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী এক-তৃতীয়াংশ লোককেও ত্রাণ দেয়া সম্ভব হয়নি। রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে।
ত্রাণ নিয়ে এই কাড়াকাড়ি ঘটনার পেছনে ঘটে গেছে আরো এক ঘটনা। মন্ত্রী এলে ত্রাণ দেয়া হয়েছিল বটে, তবে মন্ত্রী চলে যাওয়ার পর বন্যার্তদের কাছ থেকে স্থানীয় মাস্তানরা সে ত্রাণ ফিরিয়ে নেয়। বলে যে, আরো বেশি করে ত্রাণ দেয়া হবে, তারপর ফুটুস।
আওয়ামী লীগ শাসনকালে ত্রাণ নিয়ে এই কাড়াকাড়ি নতুন ঘটনা নয়। ১৯৭৪ সালের বন্যায় ত্রাণ নিয়ে এমনি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও গুণ্ডা-পাণ্ডারা। এই লুটপাটের ফলেই ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তাতে খাদ্যের অভাবে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেসবের কোনো কৈফিয়ত দেয়নি। তখনো ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি হয়েছে। আওয়ামী লীগের লোকেরা ত্রাণ চুরি করেছে। ত্রাণের চাল গম মানুষের কাছে পৌঁছেনি। ফ্যান ভিক্ষা করেছে, সম্পন্ন পরিবারের সদস্যরা। কিশোরীরা দেহ বিক্রি করেছে। রাস্তায় হাড্ডিসার হাজার হাজার মানুষের চোখের দিকে তাকানো যেত না। এ সময় ট্রাকে ট্রাকে চাল ও খাদ্যসামগ্রী ভারতে পাচার হয়ে গেছে। কামনা করি, তেমন দিন আর ফিরে না আসুক। সে রকম গজবের হাত থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা