লুটেরা মানসিকতা
- আমীর হামযা
- ২০ জুন ২০২২, ২০:১৪
মানবিকতা অর্জনের দিক থেকে আমাদের সমাজ যে খুব একটা এগোয়নি বরং যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে, সেটা বোধ হয় না বলাই ভালো। মানবিক হওয়ার বাসনা থাকলেও আমরা তা হয়ে উঠতে পারিনি। আগের মতই অমানবিক আচার আচরণেই অভ্যস্ত থেকে গেছি। এর নমুনা মাঝেমধ্যেই প্রকাশ পায় খুব নগ্নভাবে। বিশেষ করে বড় বিপদ বা দুর্যোগের সময় তার প্রকাশ ঘটে। এ দেশে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক ঠুনকো হয়ে গেছে, মিলেমিশে বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে, এমন উপসংহার কি খুবই বাড়াবাড়ি হবে! এ কথা তো ঠিক যে, আমরা অতীতে যেমন ছিলাম; এখনো সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে। জোর যার মুল্লুক তার মার্কা সমাজ ব্যবস্থাপনাই আমরা পছন্দ করি। সে কথা বলার জন্যই আজকের এ লেখার অবতারণা।
বাংলাদেশের জনমানসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য- অন্যের সঙ্কট পুঁজি করে নিজের আখের গোছানোর মানসিকতা। সবার মনে হতে পারে এ প্রবণতা মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীর। সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। সামাজিক এ দুষ্টক্ষত শুধু কতিপয় লুটেরা বা সুযোগসন্ধানীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধারণীকরণ করলে বড় ভুল হবে। প্রান্তিক এ উপসংহার আমজনতার প্রতি অপবাদ বৈ আর কিছু নয়। সবার মতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই এমন প্রান্তিক মন্তব্যের সপক্ষে কয়েকটি লক্ষণ উল্লেখ করে বক্তব্য তুলে ধরতে চাই।
অন্যকে পণবন্দি করে নিজের ষোলো আনা লাভ তুলে নেয়ার মানসিকতা অনেক পুরনো। মুখে যে যত কথাই বলি না কেন, মনে রাখা আবশ্যক, মানুষ তখনই মানবিক হয়ে উঠতে পারে যখন ঐশী জ্ঞানে হৃদয়-মন আলোকিত হয়। সেই আলোয় জীবননীতি পরিচালিত হয়। এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ কথা বলা যেতেই পারে, আমাদের সমাজের সব শ্রেণীর মনোজগৎই এখনো দূষিত। অমানবিক। হোক সে ধনী কিংবা গরিব। সবাই লোভের কাছে পরাভূত। ধনী-গরিবের মানসিকতা একাকার হয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়ায় অর্থ হাতিয়ে নিতে। তখন বৈধ, অবৈধের বাছবিচার আর থাকে না। লোপ পায়।
প্রবাদ-প্রবচন সমাজের আয়না। সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে কোনো মানব সমাজে এগুলোর প্রচলন হয়। আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে ঝোপ বুঝে কোপ মারার কথা। মানে, নিজের স্বার্থ সংরক্ষণে বা সুবিধায় কাজ করা। নিজেদের চার পাশে এখন এমন মানসিকতার লোক গিজগিজ করছে।
কথায় আছে ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’-এর মানে কী? পৌষ মাস একই সাথে কিভাবে কারো জন্য ভালো; আবার কারো জন্য সর্বনাশের কারণ হতে পারে? বাংলা বর্ষের অগ্রহায়ণ মানে মাঠের ফসল তোলা শেষে পৌষে আবহমান গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পার্বণের আনন্দ বয়ে যেত। এখন অবশ্য আনন্দ-উৎসবের ধরন কিছুটা পাল্টেছে। তবে এ কথা ঠিক, গ্রামে কৃষকসমাজে পৌষের উৎসবে ভাটা পড়লেও শহুরে বিত্তবানরা কিন্তু ঘটা করে নবান্ন উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে পড়েন। তা দেখে আমাদের চোখ জুড়ায়। সবাই আরাম পায়; এটা যে ঐতিহ্য!
উপরে উল্লিখিত প্রবচনের প্রচলন এ জন্য যে, পৌষ মাস শুধু আনন্দ-উৎসব বয়ে আনে না; অনেকের জীবনে সর্বনাশেরও কারণ হতে পারে, যদি তীব্র শীত বা হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ে; সেই ঠান্ডা সবার জন্য না হলেও দরিদ্রদের জন্য কষ্টদায়ক। গরম কাপড়ের অভাবে তারা শীতে হয়ে পড়ে বড্ড কাহিল। যার কারণে পৌষ মাস শুধু উৎসবেরই নয়; শীতের কষ্টও বয়ে আনে। পীড়ার কারণ হয়ে ধরা দেয় গরিবের জীবনে। তাই তো পৌষ মাস কারো আকাঙ্খার হলেও কারো জন্য দুর্ভোগের।
এত কথার অবতারণা সিলেট অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার দুর্যোগকালেও নৌকামালিকদের অমানবিক অচরণের বহিঃপ্রকাশ দেখে। বন্যাকবলিত এলাকায় নৌকা ভাড়ার দাবি করা হয় অবিশ্বাস্য রকমে। সেই আবদার না মেটানোয় (পড়তে হবে সামর্থ্য না থাকায়) অন্তঃসত্ত্বাকে ফেলে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঠিক একই ধরনের চিত্র দেখা যায়, শহরাঞ্চলে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় কিংবা ভ্যাপসা গরমে রিকশাওয়ালার রিকশা ভাড়া দ্বিগুণ হাঁকানোর প্রবণতা দেখে। দাবি অনুযায়ী ভাড়া না পেলে রিকশা পাওয়া মুশকিল। বলা ভালো, পাওয়া যায়ই না। যদিও অতিমানবিকেরা বলতে পারেন, কেন শুধু শুধু গরিবকে দোষারোপ। মুরোদ নেই ক্ষমতাবানদের লুটপাটের কাহিনী বয়ানে। শুধু শুধু শ্রমজীবী রিকশাওয়ালার সমালোচনা। অথচ তারা রোদ বৃষ্টি ঝড়ে কষ্ট করে যাত্রী বয়ে বাড়তি টাকা আয় করেন। বুর্জুয়া মানসিকতা আর কাকে বলে! কুৎসিত মনের নোংরামি! তবে ভয়াবহ বন্যায় সিলেটে নৌকা সঙ্কটে ভাড়া যে অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা তো সত্যি। এতে উদ্ধারকাজে নৌকা মিলছে না। নৌকার মালিকেরা দুর্গত মানুষকে পণবন্দী করে ২০০ টাকার ভাড়া ৫০ হাজার টাকা দাবি করেছেন। না দিলে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ফেলে যান। এই মওকা মারতে নৌকার মালিক-মাঝিরা একাকার। উভয়ের কারসাজি। দুর্যোগ তাদের কাছে আশীর্বাদ।
বিপদে যে কারো কারো বুদ্ধি খোলে দেশবাসী বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছেন করোনা অতিমারীর সময়ে। তখন স্যানেটারি উপকরণ বিক্রি করে দু-চার পয়সা বাড়তি কামিয়েছেন অনেকে। করোনা পরীক্ষায় যে কাণ্ড ঘটেছে তা ছিল নজিরবিহীন। ভুয়া করোনা পরীক্ষার কারিগর সাহেদ-সাবরিনার নাম এই সমাজে ‘মিসাইল’ হয়ে থাকবে বহুকাল।
দুর্দিনে সুযোগ সন্ধানীদের যে আয় বাড়ে ভাটি বাংলায় এর নজির অতীতেও যেমন ছিল; এখনো তা বহাল তবিয়তে আছে। সেই কৌশল (অপকৌশল) খুবই জনপ্রিয়; ব্যবসার নামে অনেকেই এই কম্মটি করছে অবলীলায়। প্রতারণার জাল বিছানো রয়েছে সামাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গভীরে। মনের গহিনে গেঁথে আছে মতলবি সব চিন্তা। ঐতিহ্যের যথাযথ সংরক্ষণ আর কাকে বলে! এ প্রসঙ্গে একটি গ্রামীণ গল্প বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। গল্পটি এমন-‘রাজার বাড়ি আগুন লেগেছে; এই সল্লকে (সুযোগ) আলু পোড়া খাওয়ার ধুম পড়েছে’। আগুন নেভালে সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে ভয়ে কেউ আর আগুন নেভাতে চায় না। পোড়া আলু ভক্ষণকারীদের সুবর্ণ সুযোগ কিভাবে আরো দীর্ঘায়িত হয় তাতেই তাদের মনোযোগ। এমন মানসিকতার অন্য রূপ হলো, সমাজ সামগ্রিকভাবে বিপদে আপতিত হলে মানুষের অসহায়ত্ব পুঁজি করে মুনাফাখোররা পুঁজির পাহাড় গড়তে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। তা না হলে চালের ভরা মৌসুমেও দাম বেড়ে যায় কেন? অবশ্য, এর মধ্যেও মুনাফাখোরদের কল্যাণ রয়েছে বৈকি। তারাই তো উপকারভোগী। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সব ‘ল্যাঠা’ চুকে যায়! তা হলে সিন্ডিকেটের অপবাদ আর থাকে না। কলঙ্ক তিলক ঘুচে যায়। জোগান ও সরবরাহের অজুহাতে সময়ে সময়ে মুনাফা করতে আর কোনো অসুবিধেয় পড়তে হয় না।
লেখার শুরুতেই বলছিলাম আমরা এখনো মানবিক হয়ে উঠতে পারিনি। এ কথার সপক্ষে আরো বহু নমুনা পেশ করা যায়। সেসব টানলে লেখা বড় হয়ে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। তাই বাদ দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আমাদের লুটেরা মানসিকতার কবে অবসান হবে?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা