২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সব এথনিক ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সমমর্যাদা ও সমঅধিকার

-

গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ভারত মানে এখন নূপুর শর্মারা এই ইস্যু। গত ২০১৪ সালে বিজেপির মোদি ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এত খারাপভাবে ‘হিন্দুত্ববাদী’ এ রাজনীতি মুসলমান ইস্যুতে পরাজয় ও পশ্চাদপসরণ করেনি। অথচ চলতি বছরের মার্চের মধ্যেও উত্তরপ্রদেশসহ ও অন্য পাঁচ রাজ্যে নির্বাচনে সরাসরি ও প্রকাশ্যে মুসলমান কোপানোর (দমন, পীড়ন ও নিগ্রহ) কথা বলে ওই হিন্দু ভোট সব বিজেপির বাক্সে জোগাড়ের এমন তৎপরতা এর আগে কেউ দেখেনি; অর্থাৎ যেটা মনে হচ্ছিল, কোনো বিজেপি নেতা মুসলমান কোপানোতে কে কত নৃশংস এই হিন্দুত্ববাদই ভারতের একমাত্র রাজনীতি সেই রাজনীতি যেন হঠাৎ প্রচণ্ড ধাক্কা খেল। ভারতের দেশী-বিদেশী মিডিয়ায় এখন এ নিয়ে অন্তত এমন সাব-হেডিং দেখতে পাওয়া যাবে যে ‘বিজেপি বা মোদি শক খেয়েছে’!

মানুষের সমাজের হাটবাজার মানুষের সমাজের মতোই সমান পুরনো। আর হাটবাজার-গঞ্জ এগুলো হলো সেই জায়গা, যেখানে সমাজের আমরা আসলে সবাই একে অপরকে পরস্পরকে স্বীকৃতি দেই, তাতে সেটি সচেতন থেকে বা না থেকে যেভাবেই করি। আর তাতে যথোপযুক্ত সম্মান-মর্যাদাসহই পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়েই তা করি। কিন্তু সেটি কিভাবে? যখন আমরা হাটে পরস্পরের সাথে পণ্য-বিনিময় সম্পর্ক করি, তাই একটি হাট মানে এর মূলকথা হলো, নিজ পণ্য বা অর্থের বিনিময়ে অনের কাছ থেকে পণ্য বা অর্থ নেয়া, এর এক লেনদেন। যেটা একদিক থেকে দেখলে পরস্পরের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়াও বলা যায়। আবার অন্য দিক থেকে দেখলে পণ্য বিনিময়কারী আমরা এর মাধ্যমে পরস্পরকে স্বীকার করে নিয়ে থাকি যেটা আসলে উপযুক্ত সম্মানসহ পরস্পরকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া-নেয়া। এক কথায় তাই, হাটবাজার মানে আসলে যেখানে মানুষ পরস্পরকে সামাজিক সম্মান ও স্বীকৃতি আদান-প্রদান করি। সমাজে পারস্পরিক উপস্থিতি স্বীকার করে নেই।

আবার এই গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত হাটবাজারগুলোরই বৃহত্তম অর্থে এ রূপটাই হলো এক ‘গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা’ বা সিস্টেম। এক গ্লোবাল স্বীকৃতির আদান-প্রদান ব্যবস্থা গ্লোবাল বাণিজ্য যেটা দুনিয়াজুড়ে এখন সব রাষ্ট্রেরই প্রাণভোমরা। সব রাষ্ট্রের জন্যই এটি জরুরি যে, এই গ্লোবাল ব্যবস্থার অংশ হয়ে এতে অবস্থান নিয়েই তাকে থাকতেই হবে। সোজা কথা, এই ‘গ্লোবাল বাণিজ্যে’ আপনার রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তা নেই; আপনি এর কেউ নন; আপনাকে ছাড়াই এই ব্যবস্থাটা চলছে অথবা তা ন্যূনতম ঢিলেঢালা এটি টের পেলেই সেই সরকার ও দেশের মানুষ বুঝে যায় খারাপ দিন আসছে, এখন সাফার করতে হবে। খেয়ে না-খেয়ে মরার দশায় পড়াসহ যেকোনো কিছুই এখন আসন্ন হতে পারে।

পুরনো গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত হাটবাজারগুলোর কথায় যদি আবার ফিরি আর এবার যদি কল্পনা করি যে, ওই হাটবাজারে মানুষ পারস্পরিক স্বীকৃতির আদান-প্রদানও করবে বা পণ্য বেচাকেনাও করব কিন্তু একই সাথে হাটে কিছু কিছু ব্যক্তির বাবা-মা নাম ধরে গালাগালি ও নিচা দেখানোর রেওয়াজও আমরা চালু রাখতে চাই- তাহলে কী সেটি করা যাবে?

আসলে সে ঘটনাটাই ঘটেছে মোদির ভারতের ক্ষেত্রে, মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রগুলো সেসব দেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতদের তলব করে প্রকারান্তরে এই হুমকিটাই তৈরি করেছে যে, ভারতের সাথে গ্লোবাল বাণিজ্য সম্পর্ক করব না যদি ক্ষমা না চায়। কারণ তুমি আমার নবীকে অপমান করেছ। মোদির ভারত গ্লোবাল বাণিজ্যে পারস্পরিক পণ্যবিনিময় ও স্বীকৃতির চাওয়ার সাধারণ তৎপরতা এবং একই সাথে নবীর অপমান ও ইসলামবিদ্বেষ চাইতে পারে না। এ কথাটিই মুসলমান রাষ্ট্রগুলো মোদির ভারতকে তলব করে জানিয়ে দিয়েছে।

এক কথায় বললে, এ দুটো আসলে একেবারেই পরস্পরবিরোধী। তাই সে ক্ষেত্রে তখন হয় সম্মানের সাথে পরস্পরকে স্বীকৃতি দিয়ে আগের মতোই হাটবাজারটা চলবে আর নয়তো এই হাটবাজারকে উঠে বা ভেঙে যেতেই হবে। এ ছাড়া কথা আরো আছে। যেমন- আবার মানুষ তো কেউ একা নয়। এমনকি কেউই কেবল সে আর তার মা-বাবাই আছে, এমন হয় না। বরং সব মানুষের কাছেই অজস্র তার সম্মানিত অন্যান্য অনেক ব্যক্তিত্বরাও থাকেন। আর সেটি আরো ছাড়িয়ে একেবারে তার স্ব স্ব ধর্মীয়জগতের সর্বোচ্চ সম্মানীয় স্থানে অধিষ্ঠিত ও অবস্থিত ব্যক্তিত্বরাসহ আরো অনেকেই থাকেন! সে কারণেই হাটবাজারে ব্যক্তিদের পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়া-নেয়া কথাটার ব্যবহারিক মানে হলো, এখানে ব্যক্তি বললে সবারই স্ব স্ব সংশ্লিষ্ট এমন ধর্মীয় জগতের সর্বোচ্চ সম্মানীয় ব্যক্তিত্বের সম্মান করাসহ।

একমাত্র পথ সব এথনিক ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সমান মর্যাদা ও সমঅধিকারের এক দুনিয়া
আমরা সবাই নিজের একেকটা সভ্যতাগত (সিভিলাইজেশন) পরিচয় বহন করি, যাকে এথনিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বলি। আর এথনিক পরিচয়ের অনেক উপাদান থাকে যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলো থিওলজিক্যাল পরিচয় বা ধর্মীয় পরিচয়। থিওলজি যা আমাদের বৈষয়িক চাহিদার মতোই মানুষের আরেক ধরনের চাহিদার নাম। তবে থিওলজি, এটিই আমাদের স্পিরিচুয়াল চাহিদা মিটিয়ে এসেছে পুরনো সেই যুগ থেকে। কাজেই মানুষমাত্রই তার আরেক থিওলজিক্যাল গ্রুপ ও ট্রাডিশন-সহ পরিচয়ও থাকে। আপনি ধর্ম মানা বা চর্চায় কতটা সিরিয়াস বা সক্রিয় সেটি বিষয় নয়। কিন্তু কেউ আমাকে আমার থিওলজিক্যাল পরিচয় ধরে নিচা দেখানোর চেষ্টা করলে সেই আমিই সম্ভবত নিজ ধর্মীয় আইডেনটিটির পক্ষে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে কঠিন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাব!

ভারত মধ্যপ্রাচ্যে কাতারের কাছে কাতারীয় গ্যাস-বিক্রির ক্রেতা; এক বিরাট বাজার। কিন্তু কাতার ভারতের কাছে নিজ গ্যাস বিক্রির লোভে ভারতকে তার ঘাড়ে পা রেখে হাঁটতে দেয়নি। বরং সোজা তার নবীর অপমানের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে। ব্যবসা অনেক পরে; আগে আত্মসম্মান, নিজ মহানবীর মর্যাদা, এই চিন্তা অনুসরণে!

ভারতে হিন্দুত্ববাদের নষ্টামি
ভারতে হিন্দুত্ববাদের নষ্টামির উৎস অনেক পুরনো; ব্রিটিশ আমলের প্রায় শুরু থেকেই, জেনে না জেনে রামমোহনের আমল থেকে (১৮১৫) তার হাত ধরে ও তার অবাস্তব ও কিছু ভুল চিন্তার কারণে। এরই পরিণতিতে, সবাইকে কথিত এক ‘হিন্দুজাতির অংশ’- জবরদস্তিতে তা কল্পনা করে নিয়ে ‘কংগ্রেস’ হলো সেই ‘হিন্দুজাতির’ ভারত গড়ার প্রথম রাজনৈতিক দল। আর এর প্রায় শত বছর পরে আরো বড় ভুল ও কট্টর রেসিজম হলো ‘সাভারকারদের’ হিন্দু মহাসভা দল যেটা আবার কংগ্রেসের মতো ঠিক রাখঢাক না করা ও এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। তার উত্তরসূরি হলো এখনকার আরএসএস-বিজেপি। গত আট বছর মোদির বিজেপি ক্ষমতায়, সামনে তৃতীয়বারও (২০২৪) ক্ষমতায় আসা তার স্বপ্ন। কিন্তু মোদির অর্থনীতি বারবার তার হাত ছেড়ে দিয়ে বিগড়ে যেতে চেয়েছে। তাই গত বছর থেকে মোদির রাস্তা হয়েছে এখন সরাসরি মুসলমান কোপানো এমনকি প্রকাশ্যে সংসদেসহ সবখানে বসে বেপরোয়াভাবে সে কথা বলা। এতে অবস্থা এমন যে, সুপ্রিম কোর্ট বা নির্বাচন কমিশন- এসব প্রতিষ্ঠান নিজেই মোদির সামনে নিজেকে গুটিয়ে সরে থাকাটাই করণীয় মনে করছে। ভারত রাষ্ট্রকে আরো দুস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। সর্বশেষ, ভারতের তিন নির্বাচন কমিশনারের একজন যিনি কমিশনকে আইনমাফিক পরিচালিত করতে চাইতেন তিনি এখন আর চাপ সহ্য করতে না পেরে আপসের রাস্তায় নিজ চাকরি বদলে নিয়েছেন। তিনি এখন নির্বাচন কমিশন ছেড়ে ম্যানিলায় এডিবির (এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক) হেড অফিসে মোদির প্রতিনিধি হয়ে নিজ চাকরি বদলে নিয়েছেন!

বিজেপি দলীয় প্রধান মুখপাত্র
একটি দল যখন কাউকে দলের ‘মুখপাত্র’ বলে ঘোষণা করে, তা বলতে বোঝানো হয় তিনি দলের ফরমাল বক্তা ও প্রতিনিধি। অর্থাৎ মুখপাত্র ছাড়া অন্য কারো বক্তব্যই বরং দলের বক্তব্য নয় মনে করতে হবে, এই হলো এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এই বিচারে নূপুর শর্মাকে দলের মুখপাত্রই করা হয় যদিও নূপুর শর্মা সিরিয়াস বিশ্বাসী বলতে যা বোঝায় তেমন আরএসএস-বিজেপির কেউ নন। বরং একজন ‘কেরিয়ারিস্ট’ বললে আমরা যা বুঝি তাই বোঝায়। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট থাকার সময় সংসদের ভিপি ছিলেন ও পরে তার লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে একটি ল’এর ডিগ্রি আছে অর্থাৎ তিনি চিন্তায় মডার্ন ওরিয়েন্টেশনের, প্রজ্ঞা ঠাকুর নন; তুলনায় নূপুর শর্মা, তিনি যেমন সরাসরি আরএসএস কর্মী ও এমপি ‘প্রজ্ঞা সাধ্বী ঠাকুর’-এর মতো কেউ নন। বরং দিল্লি রাজ্য নির্বাচনে এক পরাজিত প্রার্থী। তিনি আসলে টেবিল টকের বক্তা হিসেবে ভালো পারফরম্যান্সের বলে বিজেপি তাকে উপস্থাপক হিসেবে ভাড়া করেছিল এই অর্থে তিনি বিজেপির সাথে সম্পর্কের।

এদিকে গত বছর থেকে মোদির রাস্তা এখন সরাসরি মুসলমান কোপানোর পথের, ‘হিন্দু ভোট বিজেপির বাক্সে আনতেই হবে’। আসলে এই নীতি-পলিসির কারণে ভারতে টিভি টকশোতে নূপুর শর্মার মতো বক্তা-পারফরমারের প্রয়োজন বিজেপির কাছে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে মোদি চিন্তাও করেননি, এখানে মুসলমান-কোপানো তৎপরতায় ‘কোনো সীমারেখা’ বলে দেয়ার দরকার আছে বা হবে। কারণ মোদির ভারতে মুসলমানরা নয়, বরং উল্টো হিন্দু নাগরিকই যেন মুসলমানের হাতে ভিকটিম- এই ইমেজ, এই রেসিজম ইসলামবিদ্বেষ-ঘৃণা অবলীলায় মোদি খাড়া করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন, যা ভারতের ‘হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব’ এই নিকৃষ্ট বর্ণবাদী চিন্তার প্রাবল্যের তলে ফেলেছিল সবাইকে। অবস্থা এমন করা হয়ে আছে যেন কেউ এ থেকে ন্যূনতম দূরত্ব তৈরি করতে চাইলে বা সমর্থন না করা দেখাতে চাইলেই এর যেন একটাই অর্থ হয় যে ‘সে হিন্দু দেশদ্রোহী’ এমন ইমেজ তৈরি হতে পারে, এই ভয়ে তটস্থ থাকে- তাই করে রাখা হয়েছিল। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও যেন ব্যবসার লোভে ক্রমেই ‘মুসলমান কোপানো মোদি’ পরিচয় ও তৎপরতা দেখেও যেন এদিকে আর তারা দেখছিল না। এসব মিলিয়ে মোদি দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছেন। কিন্তু মহানবী সম্পর্কে নূপুর শর্মার অসম্মানজনক মন্তব্য করা এবং তা ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এই সীমা ছাড়ানো তৎপরতা যাতে আর কেউ সহ্য করতে পারেনি। ভারতীয় মিডিয়ার মতেই এ পর্যন্ত প্রায় ২০টা মুসলমানপ্রধান দেশ নিজ নিজ ওসব দেশে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া আপত্তি জানানো, ব্যাখ্যা চাওয়া, মাফ চাইতে বলা ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল। এর পরও টানা সাত দিন নূপুর শর্মা (ও এর সমর্থকরা) নিজেদের পক্ষে ভোকাল ছিলেন। কিন্তু প্রথমে মূলত কাতার, কুয়েত ও ইরানের অ্যাকশন; এতে বাকি সবার তৎপর হয়ে উঠতে এটিই মোদির জন্য টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল।

তাতে কী দাঁড়াল এখন
সারা দুনিয়ার ভূগোলের সবখানেই এবং একসাথে মানুষ-প্রজাতির কৃষিকাজভিত্তিক নতুন থিতু জীবনযাপন শুরু হয়নি। এই নয়া জীবনযাপন যাকে আমরা সভ্যতার জীবন শুরু বলে থাকি। এভাবে নানা সভ্যতার শুরু এটিকেই আমরা কালক্রমে এখন বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতার জীবন বলে গণ্য করি পরিণতিতে যেখান থেকে বিভিন্ন জাতির এথনিক (এথনিক-জাতির) জীবনের শুরু মনে করা হয়। দুনিয়ায় এখন অসংখ্য এথনিক জাতিগত জনগোষ্ঠীর দেখা পাওয়া যায়। তবে শেষ প্রায় ছয়শ’ বছর ধরে ইউরোপীয় কলোনি দখলদার এমন নানা এথনিক জাতিগত জনগোষ্ঠী অন্য সব এথনিক জনগোষ্ঠীকে অধীনস্থ করে শাসন করে এসেছিল। এখান থেকে অন্য এথনিক জাতিগত জনগোষ্ঠীকে নিচা দেখানো- এই রেসিয়াল-এথনিক বর্ণবাদ তখন থেকে এখনো প্রায়ই ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলার ছিলেন তেমনই এক এথনিক রেসিজমের প্রবল প্রকাশ। এটি বোঝার এক সহজ প্রকাশ হলো, যখনই আমরা দেখব কেউ নিজ ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলছে বা নিজ এথনিক জাতিগত জনগোষ্ঠীকে শ্রেষ্ঠ বলছে- সোজা কথায় নিজের যেকোনো কিছু আইডেনটিটির ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করছে যার আসল উদ্দেশ্য অন্যকে দমিয়ে রাখতে চায় আর বিপরীতে তাকে নিচা দেখানো- এমন রেসিজমেরই একটি হলো ‘হিন্দুত্ববাদ’।

এখন আমাদের এই একটাই দুনিয়াতে যদি সব এথনিক জাতিগত বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীগুলোকে পাশাপাশি ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একসাথে বসবাস করতে পারতে হয় তবে একটাই নীতিতে তা সম্ভব হতে পারে। তা হলো কোনো এথনিক পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ বলে কিছু নেই, বরং বৈষম্যহীনভাবে সবার সমমর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতেই একমাত্র তা হতে পারে।

কিন্তু মোদির হিন্দুত্ববাদ হলো সেই রেসিজম, যা সব এথনিক জাতিগত বা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে সমাধান চায় না। যেমন ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে হিন্দুত্বের আধিপত্য; এর এক শাসনব্যবস্থার কায়েম চায় বিজেপি-আরএসএস। কারণ বিজেপি-আরএসএসের বিচারে ভারতে হিন্দু জনগোষ্ঠী ৮০ ভাগের বেশি বলে হিন্দুত্ববাদ, এই শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে আরামে হিন্দু ভোট ভোটের বাক্স ভরে শাসন ক্ষমতায় আসা ও থাকা সোজা বলে তাদের বিশ্বাস। অথচ শ্রেষ্ঠত্ব মানেই রেসিজম। অবশেষে এই প্রথম মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য গ্লোবাল বাণিজ্যে এসে মোদির হিন্দুত্ববাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিকে তারা আটকে দিয়েছে, তা সাময়িক হলেও।

আর এর ফলাফলেই আমরা দেখছি, মোদির সাময়িক পিছু হটা। কিন্তু অচিরেই যত তাড়াতাড়ি পারা যায় মোদি আবার মুসলমান কোপানো রাজনীতিতে ফেরত আসতে চাইবেন। খুব সম্ভবত কেবল নবী-পয়গম্বর প্রশ্নে হয়তো সংযত থাকার চেষ্টা করবেন। এ পথে তাদের সম্ভাব্য ফিরে আসার মূল কারণ, এ ভিন্ন তাদের অন্য রাজনীতি নেই। আবার ভারতের অর্থনৈতিক ন্যূনতম সমৃদ্ধির আশু সম্ভাবনা নেই। বাইডেন প্রশাসন নিজের মুখেই এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধে ডেকে আনাতে তা তাদেরকে ২০০৮ সালের মতো আরেক নয়া গ্লোবাল মহামন্দার দিকে নিচ্ছে কি না এ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। এসব কারণে মোদির কাছে হিন্দুত্ববাদ ও মুসলমান কোপানোর নীতিভিন্ন অন্য কিছুতেই নিজ সম্ভাবনা তারা দেখে না। এরই মধ্যে সেসব ইঙ্গিত ভারতে বিজেপি দেয়া শুরু করে দিয়েছে।

এর মধ্যে আমরা দেখছি বাংলাদেশের সরকার মোদির নূপুর ইস্যুতে কোনো সমালোচনা করেনিই বলে, আমাদের তথ্যমন্ত্রী ভারতীয় সাংবাদিক ডেকে তাদের দিয়ে, এটি নাকি বাংলাদেশ সরকারের ক্রেডিট- এই হিসেবে তুলে ধরাচ্ছে। আবার মোদি সরকারও বাংলাদেশের এ আচরণকে তার সরকারের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে।

অথচ এক কথায় বললে, এটি এ দুই দেশের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। বিশেষত বাংলাদেশের জন্য। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশ- এটি আমেরিকান অবরোধের মুখে। তাই এটি বাংলাদেশের সরকারকে মিস-ক্যালকুলেশনে প্রো-ইন্ডিয়ান (তাও আবার এই সময়ের) ও এক অ্যান্টি মুসলমান অবস্থানের পক্ষে দাঁড় করাবে। এতে হাসিনা সরকারের কর্তৃত্ব ও ইমেজ আরো নেতি হবে। হয়তো এ সবের পেছনে এমন অনুমান থাকতে পারে যার কল্পনাটা হলো, এটা অ্যান্টি আমেরিকান এক বাংলাদেশ-ভারত জোট আর ওদিকে রাশিয়া এবং সাথে চীনের সমর্থনে কিছু একটা দাঁড়িয়ে যেতেও পারে।

কিন্তু না, এটি ঘটবেই না। এটি একেবারেই এক ভিত্তিহীন কল্পনা। মূল কারণ মোদির ভারত এখন যে পক্ষে অবস্থান নিবে সেই পক্ষটাই হেরে ধংস হয়ে যাবে। আগামী ২০২৪ সালের মে এর কেন্দ্রীয় নির্বাচন তো মোদির জন্য অনিশ্চিত বটেই, এমনকি এ বছর দ্বিতীয়ার্ধে ও আগামী বছর ভারতের রাজ্য নির্বাচনগুলো মোদির জন্য অনিশ্চিত হয়ে গেছে। এসব অনিশ্চয়তার মধ্যে মোদির ভারত বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্য এক মারাত্মক লায়াবিলিটি হয়ে উঠেছে। মোদি এটি জানেন। তবে মোদি বরং চেষ্টা করছেন বাংলাদেশকে কী করে নিজের ইমেজ পুনরুদ্ধারে ব্যবহার করবেন। এ কথাটাই প্রকাশ পেয়েছে ভারতে দ্য প্রিন্ট পত্রিকার জ্যোতি মালহোত্রার লেখায়, যিনি আমাদের তথ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি মুসলমান-জনসংখ্যা প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও আরো প্রায় ২০টি রাষ্ট্রের মতো তাদের স্ব স্ব দেশে তারা যেমন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করতে আপত্তি ও ক্ষমা দাবি করেছে বাংলাদেশ তেমন করেনি বলে হাসিনা সরকারের প্রশংসা করেছেন। তিনি এমনও লিখেছেন, বাংলাদেশের কাছে মোদিভিন্ন ভালো বিকল্প নেই, এটি নাকি আমাদের সরকার বুঝে গেছে। এ বক্তব্য মোদির অভ্যন্তরীণ ইমেজ বাড়াতে কাজে লাগলেও এটি ঠিক ততটাই বা এর বেশি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে এর মধ্যে গেছে। মানে লাভের গুড় খেয়েছে মোদি সরকার আর এতে পয়সা ঢেলেছে আমাদের সরকার নিজের ক্ষতি করতে- ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে!

মানে পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে প্রায় দু-এক দিন পরপরই ভারতের প্রতি আমাদের সরকারের অবস্থান অদলবদল হয়ে যাচ্ছে এবং তা কোনো কার্যকর লাভালাভ ছাড়াই।

আরেক তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষণ হলো, ভারতে মহানবীকে অপমান ও ইসলামবিদ্বেষ-ঘৃণা ইস্যুতে দুনিয়ার যে অঞ্চল অপরাধীর মতো প্রায় নিশ্চুপ, সেটি হলো ইউরোপ। তাদের এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই যেখানে জাতিসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেলও ‘হেট স্পিচের’ দায়ে ভারতকে অভিযুক্ত ও সাবধান করেছেন। আবার ওদিকে পশ্চিমা শক্তি বলতে বাইডেন প্রশাসনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র বলেন, তারা বিজেপির সাবেক কর্তার (নূপুরের) মন্তব্যের নিন্দা জানান।

অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ব্রিটিশ-ফরাসি শক্তির অটোমান সাম্রাজ্য দখল করে নেয়া এবং তুরস্কে কামাল-কিয়ার শাসনের আড়ালে নিজ প্রভাব কায়েম আর ওদিকে ‘রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করার’ অসৎ ও ভুয়া তত্ত্ব হাজির করা- এসবই ছিল এক কথায় পরিকল্পিতভাবে ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণার শুরু, যা এখনো চলছে; যা এবার ভারতের ঘটনায় সম্ভবত সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশিত।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement