নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতার নমুনা
- আমীর হামযা
- ১৩ জুন ২০২২, ২০:১৯
কে এম নুরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়। নতুন ইসি কাজ শুরু করলেও সবার মাঝে এখনো আগ্রহ বা কৌতূহল সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নতুন ইসির গঠনপ্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই অনাস্থা প্রকাশ করেছে। তারপরও বসে নেই আউয়ালের নেতৃত্বাধীন ইসি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি অংশীজনের সাথে সংলাপের মাধ্যমে ধারাবাহিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নতুন ইসি দেশবাসীকে একটিই বার্তা দিতে চায়, দেশে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক অবাধ স্বচ্ছ করতে তারা বদ্ধপরিকর।
তবে বর্তমান ইসি কেমন নির্বাচন করার সক্ষমতা রাখে এর নমুনা একটু হলেও প্রস্ফুটিত হচ্ছে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে। এই কমিশনের পক্ষে আদৌ অবাধ-স্বচ্ছ নির্বাচন করা সম্ভব কি না, তার প্রাক-প্রস্তুতি পরীক্ষা চলছে। বিরোধী দলের শঙ্কা, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে দেশে গ্রহণযোগ্য ভোটগ্রহণের সামর্থ্য কোনো ইসি রাখে না। বিএনপি নেতৃত্ব বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবেন না। বিএনপির এখন পর্যন্ত দাবি, দলীয় সরকার বহাল রেখে কোনো ইসির পক্ষেই নির্বাচন অবাধ হবে না।
এই দাবির বাস্তবতা কি তাহলে বিমূর্ত থেকে মূর্ত হচ্ছে, মানে বাস্তবতায় ধরা দিচ্ছে? কুমিল্লা-৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে চিঠি দিয়েছেন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মো: মনিরুল হক। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তিনি পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগও করেন। পোস্টার ছেঁড়া নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো: শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সুন্দর নির্বাচন করতে চাই। কারো প্রচারণায় বাধা, পোস্টার ও ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়।’
বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান, দলীয় কার্যালয় ও বিভিন্ন হল ব্যবহার করে মহানগর, সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা, প্রচার প্রচারণার অভিযোগ করেন মনিরুল। একই সাথে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মাদরাসার প্রতিনিধিদের সাথে নির্বাচনী কার্যক্রম চালানোর অভিযোগও আনা হয়েছে।
অবশ্য সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আচরণবিধি লঙ্ঘন করি না। আমি কোনো নির্বাচনী সভায় অংশগ্রহণ করি না। নির্বাচন ছাড়াও আমার অনেক কাজ আছে, সেগুলো আমাকে করতে হয়। সেই কাজ আমি করি।’ আর স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক বলেন, ‘আচরণবিধি লঙ্ঘন করে তিনি (সংসদ সদস্য) নির্বাচনী কাজ করছেন। আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের কাছে এর প্রতিকার চাই। এতে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিতে সমস্যা হচ্ছে।’
ইসিতে দায়ের করা এক চিঠিতে মনিরুল উল্লেখ করেন, নির্বাচন ঘিরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে সব প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যক্রম চলছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বহিরাগত নেতাকর্মীদের আনাগোনা ও চলাচল দিন দিন বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করে ও আচরণবিধি লঙ্ঘন করে মহানগর দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় নেতাকর্মীদের একত্র করছেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসার প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের সাথে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসি চিঠি দিয়ে কুমিল্লা-৬ আসনের এমপি বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয় ইসি। কিন্তু তিনি ওই নির্দেশের তোয়াক্কা না করে এখনো এলাকায় রয়েছেন। এদিকে সংশ্লিষ্ট এমপি এলাকা না ছাড়লে ইসির কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইসি ভবনে এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও ইসির সাবেক সচিব-অতিরিক্ত সচিবদের সাথে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এই অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন সিইসি। তাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, কুমিল্লা নির্বাচনে আপনাদের চিঠির নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। জবাবে সিইসি বলেন, ‘আচরণবিধিতে বলা আছে, অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এলাকায় থাকবেন না, থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বা প্রচার চালাবেন না। কুমিল্লার সংসদ সদস্য তেমনটা করছিলেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা কিন্তু আমাদের এখান থেকে তাকে চিঠি দিয়ে বলেছি, এলাকা ত্যাগ করতে। তিনি ত্যাগ করেননি। শুনেছি, তিনি আদালতে মামলা করেছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের আচরণ বিধিমালাতে এটা আছে, যদি সরে থাকেন তাহলে নির্বাচনটা ভালো হয়। সেই চিঠি আমরা প্রকাশ্যে দিয়েছি। এটাই যথেষ্ট একজন সংসদ সদস্যের জন্য, সেটা সম্মান করা। যদি তিনি সম্মান না করেন, তাহলে সেখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।’
সিইসির এই বক্তব্যে মনে প্রশ্ন জাগে, নির্বাচন কমিশনকে যে সাংবিধানিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, নতুন ইসি কি তা প্রয়োগ করতে সক্ষম? যেখানে সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যকেই ইসি আচরণবিধি লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারছে না, সেখানে সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হওয়া জাতীয় নির্বাচনে শত শত প্রভাবশালী ব্যক্তিকে আইন মানাতে বাধ্য করা তো দূরপরাহত। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। সরকারি দলের মেয়র পদপ্রার্থীর বিপরীতে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন মনিরুল হক। অন্য দিকে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের অনুগত আরফানুল হক আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন। তাকে জেতাতে না পারলে কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহাউদ্দিনের প্রভাব-প্রতিপত্তি হুমকিতে পড়বে। তাই মেয়র নির্বাচনে মনিরুল প্রকারান্তরে এমপি বাহাউদ্দিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বক্তব্য, এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী এরফানুল হক রিফাত না জিতলে সরকারি দলের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন দলীয় এবং ব্যক্তিপ্রভাব খর্ব হবে। যার রেশ বহুদূর গড়াতে পারে। আর ভোটে দাঁড়ানোর কারণে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক মেয়র মনিরুল হারলে রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যেতে পারেন। নির্বাচনে এরফানুল পরাজিত হলে বাহাউদ্দিনের ম্যাজিক ফিকে হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে দলে তার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষরা সরব হবেন, যা তার নিজের নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে। আর মনিরুল পরাজিত হলে তাকে সরকারি দলের ধকল সইতে হবে। যে কারণে অতীতে মনিরুলের মতো এবার এরফানুল নির্বাচিত হলে তিনিও বাহাউদ্দিনের ‘ছায়া মেয়র’ হিসেবে থাকবেন বলে এলাকার রাজনীতিসচেতনরা মনে করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে কুমিল্লায় প্রচার আছে, বাহাউদ্দিনের সাথে হাত মিলিয়েই বিএনপির কেন্দ্রীয় ও কুমিল্লার দায়িত্বশীল নেতা মনিরুল এর আগে দুবার মেয়র হয়ে সিটি করপোরেশন চালিয়েছেন। ওই দুই নির্বাচনেই তার জয়ের নেপথ্যে বাহাউদ্দিনের নীরব ভূমিকা ছিল বলে নিজ দলেই সমালোচনা ছিল। ওই দুই নির্বাচনে বাহাউদ্দিনকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ততটা সক্রিয় দেখা যায়নি।
২০১২ সালে মনিরুলের প্রথম মেয়র নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের আফজল খান, ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা। এই পরিবারের সাথে বাহাউদ্দিনের রাজনৈতিক বিরোধ পুরনো। এবারও আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা, ছেলে মাসুদ পারভেজ খানসহ ১৪ জন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বাহাউদ্দিনের অনুগত এরফানুলই মনোনয়ন পান।
স্থানীয়ভাবে প্রচার আছে, বাহাউদ্দিনের ধারণা ছিল, মনিরুলকে বললে তিনি প্রার্থী হবেন না। মনোনয়ন নেয়ার আগে দলকেও এমন বার্তা দেয়া হয়েছিল। বরং নির্বাচনের ব্যাপারে মনিরুল এতটাই উৎসাহী যে, এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্তও মানেননি। ফলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে নির্বাচন-প্রক্রিয়ার শুরুতেই বিএনপি তাকে দলের সব পদ-পদবি থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে। নির্বাচনের ব্যাপারে নিজ দল বিএনপির সাথে মনিরুলের একগুঁয়েমি অবস্থান, অন্য দিকে এরফানুলকে প্রার্থী করাতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বাহাউদ্দিনের অনড় অবস্থান নিজ নিজ দলে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ফলে এ থেকে বের হতে দু’জনই মাঠে সক্রিয়। যে বাহাউদ্দিনকে কুমিল্লার গত দুটি মেয়র নির্বাচনে সেভাবে সক্রিয় দেখা যায়নি, সেই তিনিই এখন নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ উপেক্ষা করে নির্বাচনী এলাকায় থাকছেন।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যেখানে একজন এমপি তার নিজস্ব প্রভাব বলয় ধরে রাখতে নিজের লোককে নির্বাচিত করতে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন আর ইসির নির্দেশনার তোয়াক্কা করছেন না; সেখানে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে বিন্দুমাত্র পরাজয়ের আশঙ্কা থাকলে কিভাবে ইসি দলীয় সরকারের অধীনে তা মোকাবেলা করে সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেবে? যেখানে রকিব কমিশন ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন এবং কে এম নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালে মধ্যরাতে ভোটবাক্স ভরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে, সেখানে দলীয় সরকারের অধীনে আউয়াল কমিশন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে তা নিয়ে ঘোরতর সংশয় থেকেই যায়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা