০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আমলাদের শুধু চাই আর চাই

-

বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যে সুবিধা ভোগ করে পৃথিবীর কোনো দেশ সম্ভবত এই শ্রেণীর লোকদের জন্য এত চাই চাই, খাই খাই নাই। এরা হলো এমন এক প্রজাতি যারা খেয়ে কোনো তৃপ্তি পায় না। সবসময় আরো খেতে চায় আর ‘এইমাত্র খেয়ে বলে কিছু খাই নাই’। অথচ চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই তারা দুধের ওপর থেকেই সরটুকু খেয়ে নেয়। আর খেয়ে খেয়ে এমন বদ-অভ্যাস হয়ে যায় যে, যা কিছু দেখে তাই তাদের সুড়ৎ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। এখন তো নুলো ডুবিয়ে সব মাখন খেয়ে নিচ্ছে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের অত্যন্ত নির্মম নিয়ম হলো এদের প্রত্যেককেই এক সময় অবসরে যেতে হয়। এই যে চলতে-ফিরতে পারছি ক্লাবে গিয়ে দু’পাত্র মারতে কখনো কখনো গাড়ির স্টিয়ারিং ধরতে পারছি। তাহলে আমার আবার অবসর কী? কেন আমার মতো যোগ্য শিক্ষিত যেকোনো সরকারের অনুগত দালালকে বলা হবে ‘যাও বাচ্চে শে রাহো’।

সরকারের পায়ে তেল মারতে মারতে সচিব হয়েছি, সে পথেই হয়েছি সিনিয়র সচিব। আমাকে কেন অবসরে যেতে হবে? না হয় আমার বয়স সরকার এক্সটেনশন দেয়ার ফলে এখন ৬৫। সরকারের একটু কৃপা পেলে আমি এখনো দেখিয়ে দিতে পারি কী অপরিসীম যোগ্যতা রাখি। সরকার যে এটা বুঝে না তা বলা মুশকিল, কারণ তার প্রমাণ ঢাকা বা চট্টগ্রামের ওয়াসার ডিজিকে দাদাভাই মার্কা বয়স পর্যন্ত এমডি পদে বহাল রাখতে পারে এবং রাখছেও। এদের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার এমডি আরেক কাঠি সরেস। কিন্তু কখনো কখনো তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকায় থাকেনও না। ওয়াসার খবর রাখেন না। মাঝে মধ্যে কিছু এলোমেলো বিতর্কিত কথা বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

এই দাদা যদি সচিব সিনিয়র সচিব চুক্তিভিত্তিক মহাসচিব পদে চাকরি করতে পারেন তাহলে আমি কেন নই? সরকার এই যুক্তি মানে বটে। প্রথমত এসব আমলাদের কোয়ালিটি অনুযায়ী তাদের নিয়োগ দেয়া হয় বিভিন্ন কমিশনে ও কাউন্সিলে। কমিশনে তবু কিছু কাজটাজ থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু কাউন্সিলে কোনো কাজ নেই। কাউন্সিলর বা চেয়ারম্যান সাহেবরা সরকার প্রদত্ত লেটেস্ট মডেলের দামি গাড়িতে করে অফিসে আসেন, ভেতরের কিংবা বাইরের লোকদের নিয়ে আড্ডা-টাড্ডা দেন, কালে ভদ্রে দু-একটা ফাইল টাইল সই করেন। বাসা থেকে আনা কিংবা সরকারি পয়সায় নানা সুখাদ্য দিয়ে লাঞ্চ সারেন। তারপর ঘড়িতে ৫টা বাজলে কোনো ক্লাবে ফের আড্ডায় বসেন। মাস শেষে বিরাট বেতন। এমন সুযোগ যদি থাকে, তাহলে সেটা হাতছাড়া করতে চায় কোন বেকুব? ফলে সব আমলাকেই চাই চাই, আরো চাই রোগে পেয়ে বসে। এ নিয়ে যার যেমন সাধ্য ও যোগাযোগ সে মোতাবেক তদবির শুরু করেন। মূল চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে থেকেই। সেসব তদবির কখনো কখনো চাকরি এক্সটেনশন হয়, আর এক্সটেনশন হওয়া মাত্রই ওই আমলার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে পড়ে, কিভাবে সরকারের একটি উচ্চপদে আসীন হওয়া যায়।

এক ভদ্রলোককে তো আমি নিজেই ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে একসাথে টকশো করতাম। তিনি এক্সটেনশনের পর তদবির শুরু করছিলেন আরো একটি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের। অনুষ্ঠানে এসে বলতেন, সিদ্দিকী সাহেব, সামনে একটা সুযোগ আছে দয়া করে আমাকে এমন কোনো প্রশ্ন করবেন না যাতে এই সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যায়।

আমার সিনিয়র ভদ্রলোক মানুষ। আমি বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে প্রশ্ন করতাম। সেসব প্রশ্নের সূত্র ধরে তিনি অকারণে সরকারের গীত গাইতেন এবং কিছু দিনের মধ্যে তিনি সেই বড় পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন।

এরকম নজির এই সরকারের আমলে ভূরিভূরি। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ তার একটি উদাহরণ। সরকারি চাকরিতে থাকাকালে তিনি নির্লজ্জভাবে আওয়ামী লীগের দালালি করেছেন। অবসরে যাওয়া ঠিক আগের দিন তিনি ইউরোপের একটি শিক্ষা সফর শেষে দেশে ফিরেছেন গত ২১ মে। প্রশ্ন উঠেছে, একজন আমলা হিসেবে কর্মজীবনের শেষ দিনে শিক্ষা সফর সরকারের বা জনগণের কী কাজে আসবে? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্য হলো- যাতে কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে তিনি অধিকতর দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু যে ব্যক্তি কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিক্ষা সফর করে এলেন এবং পরদিনই অবসরে গেলেন তিনি আর কীভাবে তার এই অভিজ্ঞতা কর্মজীবনে প্রয়োগ করবেন। তার জন্য যে মাসতুতো ভাইয়েরা এ প্রশিক্ষণ বা বৃত্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন তারাও সম্ভবত ছিলেন এই লোকটার সুবিধাভোগী। যে যাই করুক আমরা তো বলব যে, সরকারই তার জন্য এ ধরনের একটি ভ্রমণের আয়োজন করেছিল। চাকরি জীবনে হেলালুদ্দীন সম্ভবত ইউরোপের এই দুটি দেশ সফর করেননি। চাকরি শেষে যদি তাকে নেদারল্যান্ডস সফর করতে হতো তাহলে বিপুল অঙ্কের অর্থ তার পকেট থেকে যেত। সুতরাং দে গরুর গা ধুইয়ে।

এ ধরনের প্রশিক্ষণ যদি দিতেই হয় তবে সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের মিড লেভেল কর্মকর্তাদের দেয়া উচিত ছিল। যাতে দীর্ঘদিন ধরেই এই প্রশিক্ষণ দেয়া জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু শুধু সরকারের নির্লজ্জ দালালির কারণে তাকে এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। হেলালুদ্দীন এমন কোনো অপরিহার্য চৌকস অফিসার নন। তোষামোদি তার অঙ্গের একমাত্র ভূষণ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এটা অনৈতিক ছিল। তার তো শিক্ষা সফরের দরকার নেই। এটা নতুন কর্মকর্তাদের জন্য প্রয়োজন।

এ প্রশ্নে মুখ খুলেছেন হেলালুদ্দীন আহমদ। তিনি বলেছেন, অবসর নিলেও আমার এই অভিজ্ঞতা যেকোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে। ওয়াসা, এলজিইডিসহ কত সংস্থাই তো রয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রকল্পে আমাদের কাজে লাগাতে পারে। অর্থাৎ তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এরপর তিনি কোথায় নিয়োগ চান। জনাব হেলাল ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কমিশনের সচিব ছিলেন।

তার এত সুবিধা প্রাপ্তির মূল কিন্তু এখানেই যে, তিনি ২০১৮ সালের কলঙ্কিত নির্বাচনকালে ওই কমিশনের সচিব ছিলেন। যত রকম অনিয়ম-দুর্নীতি জালিয়াতি সব কিছুর সাথে ছিলেন হেলালুদ্দীন আহমদ। পুরস্কার তো তাকে দিতেই হবে। কিন্তু শুধু নেদারল্যান্ডস, স্পেন সফরের মধ্য দিয়ে সরকারের ঋণ শোধ হয়নি। এখন তিনি এলজিইডিতে চাকরি চাইছেন। আশা করি পেয়ে যাবেন। তিনি বলেছেন, তার বয়স খুব একটা বেশি না। ফলে টুকটুকিকে তার কাছে বিয়ে দেয়া যায়। এবার ইউটিউবে গিয়ে শুনুন যশোর অঞ্চলের একটি লোকগান। ‘বয়স আমার বেশি না, ওরে টুকটুকির মা, খালি টুল কয়ডা পাইকা গেছে বাতাসে। তোমার মাইয়াডা আমারে দিবা না/ও কথা মোটো কবা না’ তাহলে কিন্তু মরে যাবানি হুতাশে।’

হেলালউদ্দীনের বয়স খুব বেশি না, তাকে ওয়াসার এমডি কিংবা এলজিইডির কোনো বড় প্রকল্পে বড় চাকরি দিতে বাধা কোথায়?

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement