০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইতিহাসবিদ ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক

ইতিহাসবিদ ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক - ছবি : সংগৃহীত

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হকের কথা আমরা ভুলতে বসেছি। মৃত্যুর সাত বছরেও তার জীবন ও কর্ম নিয়ে আমরা কোনো স্মারকগ্রন্থ বের করতে পারিনি। আত্মবিস্মৃতির এই বেদনা কোথায় রাখি? ভারত-বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ছিল গবেষণাক্ষেত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও নন্দিত ইতিহাস গবেষক ড. আবদুল করিমের সাথে গবেষণাকর্ম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় তিনি ছিলেন ঋদ্ধ। তার শত শত শিক্ষার্থী সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা পেশায় যুক্ত আছেন। ৭৬ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মনীষী ২০১৫ সালে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তার বাবা প্রফেসর মাওলানা নূরুল আবছার একসময় ফেনী কলেজের আরবি বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। আরবির প্রফেসর হয়েও ইংরেজি ভাষায় তার পারঙ্গমতা অবাক করার মতো। তার লিখিত ‘মুন্তাখাব আল-আরবী’-এর ইংরেজি ভাষ্য সাবসিডিয়ারিতে ছাত্ররা রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করত। ‘মুন্তাখাব আল-আরবী’ মূলত আহমদ শাওকি, হাফিজ ইবরাহিম, মুতানাব্বি, ইমরাউল কায়েস, লাবিদসহ প্রাচীন যুগের কবিদের লিখিত দিওয়ানের বাছাইকৃত কবিতার সঙ্কলন। ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান ছিলেন। তার বড় ভাই অধ্যাপক খায়ের-উল-বশর ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর।

তিনি ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার গুপ্তখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদরাসা বোর্ডের অধীনে ফাজিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের তত্তাবধানে তিনি ১৯৮১ সালে পিএইচডিপ্রাপ্ত হন। তার থিসিসের শিরোনাম ছিল Bengal Towards the Close of Aurangzeb’s Reign. প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ ও চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি দীর্ঘ দিন বিএনসিসি-চবি শাখার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এবং লে. কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান হিসেবেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তিনি ১৯৯৫ সালের ৯ মে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৯৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন।

শিক্ষকতার পাশাপাশি তার গবেষণামূলক আটটি গ্রন্থসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের মধ্যে‘ Sale Deed of Calcutta Sutanuti and Govindpur, An Analysis of the Position of the English in it’ নিবন্ধটি গবেষকদের কাছে বেশসমাদৃত হয়। তার প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে ‘বাংলার ইতিহাস : ভারতে ইংরেজ রাজত্বের সূচনাপর্ব’, ‘সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর’, ‘সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর’, ‘ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস’, ‘ভারতে মুসলমান ও স্বাধীনতা আন্দোলন’,‘A Short History of Muslim Rule in Indo-Pakistan’, ÔBengal Towards the Close of Aurangzeb’s Reign.’ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বিদগ্ধ পণ্ডিতদের লেখা Society and Culture in Islam’ নামক একটি সঙ্কলন তিনি সম্পাদনা করেন।

একজন দক্ষ অনুবাদক হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র্রের ইরানি অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ইয়াহিয়া আরমাজানি লিখিত ‘ Middle East Past and Present বাংলায় ভাষান্তর করেন, যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৬৬। বাংলায় এটির নাম ‘মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান’। ১৯৭৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এ গ্রন্থটির চারটি সংস্করণ বের হয়। মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের মোগল শাসন ছিল তার আকর্ষণীয় গবেষণার ক্ষেত্র। জীবনের শেষ দিকে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর লিখিত আত্মজীবনী ‘তুযুক-ই-বাবরী’ বাংলায় ভাষান্তর করেন, যার নামকরণ করেন ‘বাবুরনামা’। তার ভাষা ছিল সহজ, সরল ও ঝরঝরে।

এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা একাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদের তিনি আজীবন সদস্য। প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য American Biographical Institute তাদের International Directory of Distinguished এর ৭ম, ৮ম ও ৯ম (Millennium) সংস্করণে, Biography Today-এর প্রথম খণ্ডের New Millennium Edition-এ তার জীবনী প্রকাশিত হয়। তিনি Commonwealth Organization for Learning কনফারেন্স, কমনওয়েলথ ভাইস চ্যান্সেলর কনফারেন্স, Commonwealth Organization for Learning কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৯৬-৯৭ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।

ইতিহাসচর্চা, পাঠদান ও গবেষণার প্রতি ছিলেন ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক নিবেদিতপ্রাণ। বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ ছাত্রদের পরিষদের আজীবন সদস্য করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ইতিহাস তার হৃদয়-প্রাণ ও রক্ত-মাংসের সাথে এমনভাবে মিশেছিল যে, নিজের তিন ছেলের নাম রাখেন তিনজন মুসলিম সেনাপতির নামানুসারে : ¯েপন বিজয়ী মুসা, তারেক ও পারস্য বিজয়ী মোসান্নার নামে। জনাব মুসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন। জনাব নূরুল মোস্তফা তারেক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ও জনাব নুরুল ফেরদাউস মোসান্না গ্রামীণফোনে কর্মরত আছেন।

ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক আমার সরাসরি শিক্ষক। ১৯৭৬-৮৩, এ সময়ে অনার্স ও মাস্টার্সে শ্রেণিকক্ষে তিনি আমাকে পাঠদান করেন। স্যারের সাথে বহু দিন নিবিড়ভাবে গবেষণাকর্ম করারও আমার সুযোগ হয়। ওমরগণি এম.ই.এস কলেজ শিক্ষক মিলনায়তনে দুপুরের পরে ড. মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক, ড. শব্বির আহমদ এবং আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ‘ইসলামি বিশ্বকোষ’ দ্বিতীয় সংস্করণে ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও ভ‚গোলবিষয়ক নিবন্ধগুলো স¤পাদনা করতাম। ‘ইসলামি বিশ্বকোষ’ ৩য় থেকে ৯ম খণ্ড পর্যন্ত আমরা স¤পাদনা করি, যা ছাপার অক্ষরে বেরিয়েছে। তিনি মাঝে মধ্যে ফোন করে আমার খোঁজখবর নিতেন এবং বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করতেন। এখন এসব কেবলই স্মৃতি।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সৎ, বিনয়ী, উদারমনা, পরহেজগার ও খোদাভীরু। জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য সময় তিনি ‘তাবলিগ জামাত’-এর সাথে স¤পৃক্ত ছিলেন। বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। প্রায় সময় বিকেল বেলা সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল-নোমানের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাকে দেখা যেত। বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। পরের উপকার করার মানসিকতা সব সময় তার মধ্যে সক্রিয় ছিল। হিংসা ও জিঘাংসা তার মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। তার জীবন ছিল ছকবাঁধা। পরিমিতিবোধ ও সময় সচেতনতা তার চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ, ব্যায়াম, গোসল, নিয়ন্ত্রিত আহার, ওষুধ সেবন, ইবাদত, জিকির আজকার, পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত, গবেষণা-গ্রন্থণা সব ক্ষেত্রে তিনি নিয়ম মেনে চলতেন এবং নির্ধারিত সময়ে করতেন। তিনি দীর্ঘ দিন বার্ধক্য ও লিভারজনিত রোগে ভুগছিলেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের গুপ্তখালি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তার বাবা বিশিষ্ট পীর শাহ সূফি প্রফেসর মাওলানা নূরুল আবছার রহ:-এর কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়। তিনি ইন্তেকাল করেন ঢাকার এক বিশেষায়িত হাসপাতালে। সীতাকুণ্ড থানা ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝপথে হওয়ায় তার লাশ দীর্ঘ দিনের কর্মস্থল চট্টগ্রামে আনা হয়নি। ফলে আমার মতো শত শত ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী ও গুণগ্রাহী জানাজায় শরিক হতে পারিনি। তার মাগফিরাত ও দারাজাত বুলন্দির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তায়ালার দরবারে বিশেষ দোয়া করার জন্য সব বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে বিনীত আবেদন জানাই। পরম দয়ালু আল্লাহ তায়ালা শ্রদ্ধেয় স্যারের ত্রæটি-বিচ্যুতি মার্জনা করে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমিন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement