০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

১১৬ আলিমের বিরুদ্ধে শ্বেতপত্র!

শ্বেতপত্র! - ছবি : সংগৃহীত

দেশের ১১৬ শীর্ষস্থানীয় আলিম, ওয়ায়েজ ও পীর-মাশায়েখকে ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী তৎপরতায় যুক্ত হিসেবে অভিযোগ করে এক হাজার মাদরাসার নামের তালিকাসংবলিত ‘শ্বেতপত্র’ দুর্নীতি দমন কমিশন ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে জমা দিয়েছে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘুবিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত গণকমিশন’। ১১৬ জন আলিমের বিরুদ্ধে সারা দেশে মৌলবাদী তৎপরতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, জ্বালাও-পোড়াও, অনিয়ম-দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ করা হয়েছে এ শ্বেতপত্রে। গণকমিশনের চেয়ারপারসন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল গত ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ও মানবাধিকার কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের হাতে ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন’ শীর্ষক দুই হাজার ২০০ পৃষ্ঠার এ শ্বেতপত্র তুলে দেন। অপরাধ তদন্ত করে এই ‘ধর্মব্যবসায়ী’ ও মাদরাসাগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে গণকমিশনের শ্বেতপত্রে। উপস্থিত ছিলেন গণকমিশনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, কমিশন সচিবালয়ের সমন্বয়কারী কাজী মুকুল, সদস্য আসিফ মুনীর তন্ময় ও ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক জানান, তারা ৯ মাস তদন্ত করে দুই হাজার ২০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছেন। তাতে বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তদন্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গিবাদ ছড়াতে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করার তথ্যও মিলেছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে জমা দেয়া হয়েছে। তাদের আর বাড়তে দেয়া যায় না।’ দেশের বিভিন্ন স্থানের ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নামোল্লেখ করে এ শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, তারা মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছেন। গণকমিশন সূত্র জানায়, গত ১২ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আনুষ্ঠানিকভাবে শ্বেতপত্রের মোড়ক উন্মোচন করেন (সমকাল, ঢাকা ১২ মে, ২০২২)।

প্রকাশিত শ্বেতপত্র একতরফা। অভিযুক্ত কোনো আলিম বা মাদরাসার মুহতামিমের বক্তব্য নেয়া হয়নি। তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়নি। অভিযোগ ও প্রকাশিত তালিকা যে দায়সারা গোছের এবং একেবারে ঠুনকো তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এক হাজার মাদরাসার তালিকায় এমন অনেক মাদরাসার নাম আছে বাস্তবে যেগুলোর অস্তিত্ব নেই। চট্টগ্রামের দুটো মাদরাসার নামোল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলো দোকান (ক্রমিক ৯৪-৯৫, শ্বেতপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৮৯)। বহু মুহতামিমের নাম উল্লিখিত হয়েছে যারা তিন-চার বছর আগে মারা গেছেন। ফেনীর সোনাগাজীর ওলামাবাজার হোসাইনিয়া মাদরাসার নামোল্লেখ করা হয়েছে তিনবার। মুহতামিম ও ছাত্র সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন (ক্রমিক ৩৪৫, ৪৮০ ও ৭৬৭, শ্বেতপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৮৯, ১০০২, ১০১২)। ধর্মব্যবসার সংজ্ঞা কী? এ পরিভাষাটি কমিউনিস্ট ও নাস্তিকদের সৃষ্ট। ইসলাম ধর্মের প্রচারকরা যদি ‘ধর্মব্যবসায়ী’ হন, তা হলে অপরাপর ধর্মের প্রচারকরা কোন অভিধায় চিহ্নিত হবেন?

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বিশেষত পাঠদান, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করে নির্ধারিত বেতন ও পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন। এ কাজ মহৎ; তবে ব্যবসায় নয়। মাহফিলের আয়োজকরা ধর্মীয় বক্তাদের পথভাড়া বা হাদিয়া হিসেবে যে অর্থ দিয়ে থাকেন, তা সামান্য। এটি কোনোক্রমেই ব্যবসায় হতে পারে না। ধর্মপ্রচার শরিয়তের নির্দেশনা। ওয়াজের বিনিময়ে অর্থ নেয়া বা দেয়া বৈধ কি না তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব প্রাজ্ঞ ধর্মবেত্তাদের, ধর্ম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির নয়। এটি স্পষ্টত অনধিকারচর্চা। ইসলাম কেন একমাত্র টার্গেট? অন্য ধর্মে কি ব্যবসায়ী নেই? আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, দুবাই, ভারত, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে যারা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে এবং বিলাসবহুল অট্টালিকা তৈরি করেছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করার সাহস দেখায় না কেন গণকমিশন? তালিকায় ৩০ নম্বরে আছে মাওলানা মতিউর রহমান মাদানির নাম। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার বাসিন্দা। ৪১ নম্বরে যার নাম আছে তিনি ইন্তেকাল করেছেন আগে। ৭৬ ও ৯৪ নম্বরে মুফতি ওমর ফারুক যুক্তিবাদীর নাম আছে দু’বার। ৪১ ও ৮৩ নম্বরে আছে মাওলানা আবু নাঈম মুহাম্মদ তানভিরের নাম। একই ব্যক্তির নাম দু’বার। তালিকায় এমন ব্যক্তির নাম আছে যারা আদৌ ধর্মীয় বক্তা নন।

১১৬ জনের তালিকার পাশাপাশি ৩৫ জন ধর্মীয় বক্তা ও বিদগ্ধ আলিমের আরো একটি তালিকা শ্বেতপত্রে (পৃষ্ঠা : ৭৬১-৮০৮) সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে। তালিকা দুটো থেকে বাদ পড়েননি জননন্দিত ও বর্ষীয়ান আলেমে দ্বীন, চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম, শায়েখে চরমোনাই মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করিম, মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী, মাওলানা কামাল উদ্দিন জাফরী, মুফতি আবদুল হালিম বুখারী, মাওলানা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জি, মাওলানা হাবিবুর রহমান সিলেটি, মাওলানা হাসান জামিল, ড. আসাদুল্লাহ গালিব, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা সালাহ উদ্দিন নানুপুরী, মাওলানা খোরশেদ আলম কাছেমী, মাওলানা হাফিজুর রহমান কুয়াকাটা, মুফতি দিলাওয়ার হোসেন, মাওলানা আবদুল বাছেত খান, মাওলানা মোশতাকুন্নবী, মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী, মুফতি মাহমুদ হাসান ভুজপুরী, মুফতি হাবিবুর রহমান মেসবাহ, ড. আবুল কালাম আজাদ বশর, ড. মিজানুর রহমান আজহারী, মাওলানা তারেক মনোয়ার, মাওলানা মুহিব খান, মাওলানা আবদুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, মাওলানা মুজাফ্ফর বিন মহসিন, মুফতি নুর হোসাইন নূরানী ও মাওলানা আবুবকর মোহাম্মদ জাকারিয়ার মতো দেশের শীর্ষ আলেমরাও। তালিকায় আছেন বেশ কয়েকজন কারাবন্দী আলেম। গণকমিশনের এ তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের ধর্মপ্রিয় মানুষের মাঝে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কর্তৃক গঠিত গণকমিশনের এ তালিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং এ দেশের ইসলাম, ধর্মশিক্ষা ও ধর্মীয় গুরুজনদের বিরুদ্ধে এক গভীর চক্রান্ত। বোঝা যাচ্ছে, সুনির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা নিয়ে তারা মাঠে নেমেছেন। গণকমিশনের আইনগত কর্তৃত্ব নেই। দেশকে অস্থিতিশীল করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অশুভ মতলব নিয়ে তারা অগ্রসর হচ্ছেন। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আলিম-ওলামা ওয়াজ-নসিহত, তাজকিয়ায়ে নফস ও দরস তাদরিসের খিদমতে নিয়োজিত। জঙ্গি অর্থায়ন, মানি লন্ডারিং তো দূরের কথা, তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ আলিমের রাজধানী বা নিজ নিজ জেলা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। তারা সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবনধারায় অভ্যস্ত।

আরো একটি বিস্ময়ের ব্যাপার হলোÑ মাঠপর্যায়ে ডিসি, এসপি, ইউএনওসহ বেশ কয়েকজনের নামোল্লেখ করে শ্বেতপত্রে তাদের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততা’র অভিযোগ আনা হয়েছে। ক্যাডারভুক্ত সরকারি অফিসারদের তৎপরতা ও কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারের অ্যাজেন্সি ও মন্ত্রণালয় রয়েছে। গণকমিশন কোনোক্রমেই তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার অধিকার রাখে না। এটি এখতিয়ারবহিভর্‚ত। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল ঘাদানিক সমর্থিত একটি চিহ্নিত গ্রæপ হেফাজতে ইসলামকে ‘জঙ্গি সংগঠন’ ঘোষণা দেয়ার দাবি জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি বিøঙ্কেনের কাছে স্মারকলিপি দেয়। ঘাদানিক ও গণকমিশনের পেছনে কারা কলকাঠি নাড়ছেন এমন ব্যক্তিদের নাম ও পরিচিতি শ্বেতপত্রে রয়েছে। তারা কমিউনিস্ট ও ধর্মবিদ্বিষ্ট বুদ্ধিজীবী (শ্বেতপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩, ৪, ৯৫৮-৯৬২, ৯৭৮-৯৮২)।

স্বাধীনতার পর থেকে একটি মহল এ দেশের ইসলাম, মাদরাসা শিক্ষা ও ওলামা মাশায়েখকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে যাচ্ছে। অনেকে এটিকে প্রায় পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ দেশের ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে বিষোদগারের এক সুগভীর চক্রান্ত নতুনভাবে শুরু হয়েছে। এ চক্রান্তের নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত ও অত্যন্ত সুসংগঠিত। আন্তর্জাতিক অক্ষশক্তির বৃত্তিভোগী এজেন্টরা সুকৌশলে কুরআন ও হাদিসের শিক্ষার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। এসব অ্যাজেন্ট সরকারের অভ্যন্তরে, বিরোধী দলে, প্রশাসনে, বেসরকারি সেবাসংস্থা, সংবাদপত্রে ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সমানভাবে সক্রিয় থেকে এক ভাষায় কথা বলছেন এবং একই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নানা অজুহাত খাড়া করে। এনজিও সমর্থিত বেশ ক’টি সংবাদপত্র তিলকে তাল করে এবং তালগোল পাকিয়ে তথ্যসন্ত্রাস সৃষ্টি করছে, যাতে জনমত বিভ্রান্ত হয়। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট এনজিওরা কোনো সরকারের বন্ধু নয়; সরকারকে ব্যবহার করে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাই হচ্ছে তাদের কর্মকৌশল।

বেশ কিছু দিন আগে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক আলোচনা চক্রে রাশেদ খান মেনন, যিনি গণকমিশনের সদস্য, যে মন্তব্য করেন তা রীতিমতো আপত্তিকর। তিনি বলেন, ‘দেশে যেভাবে কওমি মাদরাসা গড়ে উঠেছে এবং সেখানে যে ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা আসলে কোনো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। যে মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হোক না কেন, সেখানে কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা অবশ্যই রাষ্ট্র ও সমাজকে জানতে হবে। ‘কওমি মাদরাসার ধারাকে কোনো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না’ এমন মন্তব্য বিদ্বিষ্ট মনের পরিচায়ক। সেখানে কী ধরনের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা তো সবার জন্য উন্মুক্ত। রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে কোনো তথ্য গোপন নেই। এখানে গোপনীয়তা বা রহস্য বলতে কিছু নেই। ‘দরসে নিজামি’ পাঠ্যক্রমের ভিত্তিতে দেড় শ’ বছর ধরে পুরো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রিটেন, আফ্রিকা, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত একটি সফল ইসলামী শিক্ষাধারার বাহক হচ্ছে কওমি মাদরাসা। কওমি মাদরাসা তো এ দেশের বাস্তবতা। সরকার স্বীকৃত শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশেই ছড়িয়ে আছে ৩০ হাজার কওমি মাদরাসা। বর্তমান সরকার ও কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি ও সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য তৃতীয় একটি শক্তি সক্রিয়। তৃতীয় শক্তিটি সরকারের বন্ধুবেশী শত্রæ। এ বিষয়টি মাথায় রাখার জন্য আমরা সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

ঘাদানিক ও গণকমিশন চাচ্ছে মাদরাসা শিক্ষা ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ যে দ্বীনে ইসলামের আলো পাচ্ছে সেটাকে বিনষ্ট করে দেয়া এবং মানবিক মূল্যবোধ যারা সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের দমিয়ে রাখা। ওয়াজ হাজার বছরের বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয় এমন কোনো কথা ওয়ায়েজরা মাহফিলে বলেন না বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আবহ তৈরির জন্য জনগণকে আহŸান করে থাকেন। ওলামায়ে কেরাম মাহফিলে মাদক, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, খুন-খারাবি, ব্যভিচারসহ নানা সামাজিক অপরাধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে জনগণকে সচেতন করে যাচ্ছেন। ইসলামের নির্দেশনা মেনে জীবন পরিচালনা করা, ইহজীবনে সমৃদ্ধি, পরকালে মুক্তি এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ওয়াজের মূল সুর। ওয়ায়েজ ও আলিমদের শেকড় মজবুত। তৃণমূল পর্যায়ে রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা। তারা সামাজিক শক্তির প্রতিভ‚। ধর্মচর্চা ও ধর্মীয় ভাবাবেগ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের গভীরে প্রোথিত। এটিকে উপড়ে ফেলার প্রয়াস কোনো দিন সফল হবে না।

যারা এ তালিকা দুদকের কাছে পেশ করেছেন তারা নিজেরাই বিতর্কিত। তাদের মূল লক্ষ্য হলো দেশের মানুষকে ধর্মবিমুখ করা এবং ওয়াজ-নসিহত বন্ধ করে দেয়া বা নিয়ন্ত্রণ করার পরিবেশ তৈরি করা। জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদের সভাপতি আল্লামা নুরুল হুদা ফয়েজী গত ১৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের কার্যক্রমের নাম তারা দিয়েছেন ‘তদন্ত’। কিন্তু তদন্তসংক্রান্ত কোড অব দ্য ক্রিমিনাল প্রসিডিউর-(১৮৯৮) এর ধারা ৪ এর ১ উপধারা অনুসারে তদন্ত করার জন্য কোনো অথরাইজড ব্যক্তি প্রয়োজন। এই বিবেচনায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও তুরিন আফরোজ গং যা করেছেন তা আমাদের সংবিধানের মৌলিক ধারণার স্পষ্ট লঙ্ঘন। একই সাথে তারা কোনো অথরাইজড পারসন বা সংস্থা না হয়েও ‘তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে কিছু প্রকাশ করার মাধ্যমে আইনগত অনধিকার চর্চা করেছেন; যা নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ এবং তারা জনমনে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। আদতে তাদের এই শ্বেতপত্র প্রকাশ সংবিধানবিরোধী; নাগরিকের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত মানবিক মর্যাদানীতির প্রতি অশ্রদ্ধা। এই কথিত কমিশনের তদন্ত ও শ্বেতপত্রের নৈতিক ও আইনত কোনো ভিত্তি নেই বরং এটি সংবিধান, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা মানবিক মর্যাদার বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত অপরাধ।’

বিশ্লেষকরা মনে করেন, শ্বেতপত্র প্রকাশের নেপথ্যে উদ্যোক্তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। ধাপে ধাপে তারা অগ্রসর হবে বাস্তবায়নে। গণকমিশন, গণ-আদালত, গণজাগরণ মঞ্চের সাথে গণসম্পৃক্ততা বা এগুলোর আইনগত ভিত্তি না থাকলেও ‘পাকা খেলোয়াড়’রা এর পেছনে সক্রিয়। শক্তিশালী থিংক ট্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ইসলামোফোবিয়া বিশেষত উপমহাদেশীয় ঘটনাপ্রবাহ ও বাস্তবতার সাথে শ্বেতপত্র প্রকাশের গভীর সংযোগ বিদ্যমান। মোটা দাগে নিম্নোক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রাখা হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত-
১. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে দেশে একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। ২. কওমি মাদরাসা শিক্ষার ঐতিহ্য ধ্বংস করা। ৩. ওয়াজ, নসিহত ও তাফসির মাহফিলকে নিয়ন্ত্রণ করা। ৪. আলিম-ওলামা মাঠে নামলে ‘জঙ্গিবাদের উত্থান’ হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রচার করা। ৫. সমাজে সম্মানিত ওলামা-মাশায়েখকে হেয় প্রতিপন্ন করা। ৬. মুসলিম বাঙালি সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের প্রাধান্য খর্ব করা এবং আমদানিকৃত সংস্কৃতির পথ সুগম করা। ৭. জাতীয় নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা। ৮. মুদ্রাস্ফীতি, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও শ্রীলঙ্কার ঘটনাপ্রবাহে জনগণের মধ্যে সৃষ্ট অস্থিরতা থেকে অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরানো। ৯. আলিম-ওলামা মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করলে দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে স্যাবোটেজ করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা। ফলে শীর্ষ আলিমদের বিরুদ্ধে ২০-৩০ টি মামলা দায়ের করা। নিকটাতীতে এর বহু নজির রয়েছে। ১০. বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপন করা এবং দেশের ভাবমর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। ১১. মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের ¯েøাগান তোলে বৈশ্বিক আগ্রাসী শক্তির দৃষ্টি আকর্ষণ করা। ১২. শ্রদ্ধাভাজন ওলামা-মাশায়েখদের সরকারের মুখোমুখি করে একটি সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতি সৃৃষ্টি করা এবং উভয়পক্ষকে বেকায়দায় ফেলা। ১৩. মুসলিম তরুণদের মধ্যে সৃষ্ট ইসলামী জাগরণকে দমিয়ে রাখা। ১৪. ‘মৌলবাদবিরোধী’ বড় কোনো অভিযানের কৃতিত্ব প্রদর্শন করা।

শ্বেতপত্র দেখলে বোঝা যায়, এ দেশের সব ঘরানার উলামায়ে কেরামকে এতে যুক্ত করা হয়েছে। মোটকথা, এ দেশে যারা ইসলামকে ফোকাস করেন তাদের সবাইকেই টার্গেট করা হয়েছে। দেওবন্দি, আলিয়া, চরমোনাই, জৈনপুরী, বেরলবি, আহলে হাদিসÑ কাউকেই বাদ দেয়া হয়নি। গণকমিশনের এই অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সব মাসলাকের আলেমদের ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এখন অস্তিত্বের প্রশ্ন। দলীয় বা গোষ্ঠীয় সঙ্কীর্ণতা পরিহার করতে হবে এবং হৃদয়কে করতে হবে বড় ও প্রসারিত। ‘ইত্তেফাক মাআল ইখতিলাফ’ এ নীতিমালাকে সামনে রেখে কাছে আসতে হবে। নিয়মতান্ত্রিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও আইনের পথে লড়াই করতে হবে। পাতানো ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। জোশকে নিয়ন্ত্রণ করে হুঁঁশকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে- ঐক্যই শক্তি, বিভেদে পতন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement