২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ঈদ অভিজ্ঞতা : তেলের তেলেসমাতি আলু শসার দাম

- ছবি : সংগৃহীত

ঈদের লম্বা ছুটি। সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বাড়িতে বৃদ্ধা মা ও ভাইবোনেরা রয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই ঈদের আনন্দটা খুব জমজমাট ও প্রাণবন্ত হবে। এমন প্রত্যাশা নিয়েই বাড়িতে যাওয়া। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। ঈদের ঠিক আগে আগেই শুক্রবার রমজানের শেষ জুমাবার। রাতে সব প্রকৃতিকে তছনছ করে দিয়ে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় বহু শতবর্ষী গাছ রাস্তা,বিদ্যুৎলাইন ও ঘরবাড়ির ওপর উপড়ে পড়েছে। স্বাভাবিক পরিণতি, দু’দিনের জন্য বিদ্যুৎ নেই। চলাচল বন্ধ। গাছপালা পড়ে রাস্তাঘাট প্রায় বন্ধ। দমকল বাহিনীর কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে চলাচলের উপযোগী করেন। তাদের ধন্যবাদ জানাই। বিদ্যুতের আলোবিহীন দু’দিন ছিলাম। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ওপর গাছপালা পড়ে তার ছিঁড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে। এগুলোর কাজ এবং বিদ্যুৎলাইন পুনঃস্থাপিত করতে গিয়ে একজন বিদ্যুৎকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। আমি তার রূহের মাগফিরাত কামনা করছি।

ঝড়ে কৃষকদের বেশি ক্ষতি হয়েছে। সবেমাত্র ধান পাকার আভাস এবং ধানের শীষ বের হওয়ার মতো অবস্থার ধানগুলো ঝড়ের দাপটে লুটিয়ে পড়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল। এ ধরনের ঝড় বৃষ্টি গত ৫০-৬০ বছরে কখনো আমাদের এলাকায় হয়নি। ঝড়ে ভুট্টাচাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভুট্টাক্ষেত লুটিয়ে পড়েছে। এই ভুট্টাগুলো আর হবে না। বাদামক্ষেতও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এই হলো ঝড়কবলিত এলাকার অবস্থা। তার পরও মানুষের ভেতরে প্রচণ্ড রকমের প্রাণবন্ততা দেখা গেছে। চার বছর পর মানুষ আবার মসজিদ থেকে খোলা মাঠের ঈদগাহে একত্র হয়েছেন। ঈদের আনন্দে তারা সব দুঃখ কষ্ট ভুলে গেছেন। রমজানের শুরুতে বাজারে সয়াবিন তেলের অস্থিরভাব দেখা গিয়েছিল। ঈদের কয়েক দিন আগে কার্যত বাজার থেকে তেল উধাও। এই আছে, এই নেই। তেল নিয়ে লুকোচুরি সর্বত্র বিরাজমান। তেলের তেলেসমাতি কারবারে গ্রামের সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কারণ তেলেসমাতি কারবারের জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না।

রাজধানী ঢাকায় যে শসা ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় গ্রামে সে শসা এক টাকা কেজি। শসার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। যে আলু আমরা ঢাকায় ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে কিনি সে আলু তিন টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। কৃষক আলু গরুকে খাওয়াচ্ছেন। কারণ আলু বিক্রি করতে পারছেন না। আলু কোল্ডস্টোরে রাখতে পারছেন না। সেখানেও এক অদৃশ্য হস্তের কারসাজি। গেলেই বলে যে, রাখার জায়গা নেই। আবার পেছন দরজায় গিয়ে খানিকটা ‘লেন-দেন’ করলেই রাখার ব্যবস্থা হয়ে যায়। সব জায়গায় কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে এক লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারছেন না। কারণ এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ২০০ টাকা। একজন কৃষককে এক লিটার তেল কিনতে হলে ২০০ কেজি (৫ মণ) শসা, ৭০ কেজি আলু বিক্রি করতে হবে। আর গরুর গোশত কিনতে হলে ২২০ কেজি আলু ও ৬৫০ কেজি শসা বিক্রি করতে হবে। এই অবস্থা দূর করতে না পারলে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষক বাঁচবে না। বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। এসব বিষয় ঈদের আনন্দের ঢেউয়ে আমার বেমালুম ভুলেই গেছি। কেউ চিন্তা করছি না। কৃষকদের জীবনে ঈদ আসে কিন্তু ঈদের আনন্দ তারা উপভোগ করতে পারে না। তাদের বুকফাটা আর্তনাদ কান পাতলেই শোনা যায়। সন্ধ্যার প্রাক্কালেই গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। ফসলি জমি থেকে পটোল, শসা, চিচিঙ্গা কিনে ট্রাকবোঝাই করে কাওরানবাজারে নিয়ে আসে। যে শসা ক্ষেত থেকে এক টাকা কেজি দরে কিনছেন সেটা কাওরানবাজারে ৩০ থেকে ৪০ টাকা হয়ে যায়। আবার একই পণ্য ভোক্তাদের হাতে যখন পৌঁছে তখন সেটা ৫০ থেকে ৬০ টাকা হয়। কৃষকের কোনো লাভ হয় না। যে কৃষক শরীরে ঘাম ঝরিয়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ফসল উৎপাদন করল তার প্রাপ্তিটা কোথায়?

হঠাৎ করেই সয়াবিন তেল নেই বাজারে। সবাই এক দোকান থেকে অন্য দোকানের দিকে ছুটছেন। কিন্তু তেল পাচ্ছেন না। কিন্তু লুকিয়ে রাখা লক্ষাধিক লিটার তেল উদ্ধার হওয়ার খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হচ্ছে। মুরগি খাবেন। তাও নাগালের বাইরে। একটি মুরগির দাম ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা। গরুর গোশত ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কৃষকের গরুর গোশত খাওয়ার সাধ জাগলেও খেতে পারবেন না। শসা আর আলুর যে দাম তা দিয়ে এক কেজি গোশত কিনতে হলে কয়েক মণ আলু ও শসা বিক্রি করতে হবে। সে গোশত কিনবে, নাকি তেল কিনবে, নাকি ঈদের অন্যান্য আনুষঙ্গিক জোগাড় করবে? সবকিছুতে তার ক্ষেতের ফসলের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব কৃষকের মুখে আপনি হাসি ফোটাবেন কী করে? কে থামাবে কৃষকের কান্না? সবাই তো ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা। কৃষকের হাহাকার আর বোবা কান্নার আওয়াজ বাতাসে ভাসছে। তাদের কান্নায় আমি আমার ঈদ আনন্দকে হারিয়ে ফেলেছি। জানি না, আপনারা কে কতটুকু অনুধাবন করেছেন। আমি কৃষকের ঘরের ছেলে। কৃষিই আমার প্রধান অবলম্বন। তাদের এই দুরবস্থা দেখে কোনো কৃষক ঘরের ছেলে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। এটাই হলো এবারের ঈদ আনন্দের অভিজ্ঞতা।

তেল নেই, আলুর দাম নেই। গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে আলু। শসার কেজি এক টাকা যা আগেই উল্লেখ করেছি। বাজারে নিয়ে গেলে গাড়ি ভাড়া ওঠে না। একজন কৃষক দাঁড়াবে কোথায়? ডাল কেনার মতো পয়সা তারা জোগাড় করতে পারছে না। এটাকে আমরা কিভাবে ঈদ আনন্দ হিসেবে মেনে নেব? মেনে নেয়ার অবস্থানটা কোথায়? ঈদের মাঠে অধিকাংশ মানুষের গায়ে পুরনো কাপড় পরা দেখেছি। নতুন জামা কেনার সামর্থ্য তাদের হয়নি। তারা ফসলের ন্যায্য দাম পায়নি। এখানে কৃষকের প্রাপ্তি কোথায়? ২৫৯১ ডলারের মাথাপিছু আয়ের হিসাবে কৃষকের মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা কোথায়-জানতে ইচ্ছে করে।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বছরে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নের দাবি বাংলাদেশ অরবিসের সাথে কাজ করতে আগ্রহী : অধ্যাপক ইউনূস ঢাবি সিন্ডিকেটে এখনো বহাল আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরা হাসিনা বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে দিগন্ত টেলিভিশনসহ অসংখ্য গণমাধ্যম বন্ধ করেছে : ফখরুল শীত শুরু হচ্ছে তবু কমেনি ডেঙ্গুর প্রকোপ ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা নবনির্মিত ওয়ামি কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন যুদ্ধবিরতির মার্কিন চেষ্টার মধ্যে লেবাননে ইসরাইলি হামলায় চিকিৎসাকর্মী নিহত অস্বস্তিতে ক্রেতারা : কমিয়ে দিতে হচ্ছে কেনাকাটা গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৪৪ হাজার ছাড়াল আমরা মানুষের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে সম্মান করি

সকল