শাসন ব্যবস্থায় ভারসাম্যের বিধান অপরিহার্য
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১৪ মে ২০২২, ২০:৫৩
অ্যাবসুলেট বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা মানুষকে স্বেচ্ছাচারী, অহঙ্কারী, কর্তৃত্ববাদী ও ধরাকে সরাজ্ঞান করার মানসিকতার সৃষ্টি করে। তারা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল চাটুকারদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়ে। এমন ব্যক্তিরা শুধু সাধারণের প্রতি অবহেলা করেন না, সমাজের বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানী গুণী বোধ বিবেচনাসম্পন্ন মানুষকে পর্যন্ত মূল্যায়ন করতে দ্বিধাবোধ করেন। তাদের জ্ঞান অভিজ্ঞানজাত বক্তব্য বোধকে বাতুলতা বলে তুচ্ছজ্ঞান করেন। তৃতীয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের শাসকদের এমন মনমানসিকতা; আচার আচরণে এমনই দাম্ভিকতা লক্ষ করা যায়। এসব দেশে শাসনতন্ত্র অবশ্যই একটা থাকে যা শুধুই কেতাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। শাসকদের নিজস্ব অভিলাষ, স্বীয় বোধ বিবেচনা আর চাটুকারদের পরামর্শ খেয়ালখুশি সেখানে আইন-কানুনের ওপরই প্রাধান্য পায়। নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পরিধিকে দিগন্ত বিস্তৃত করা, তাদের গোছানো সাজানো বশংবদ পার্লামেন্টকে দিয়ে শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় ‘অল্টার’ পর্যন্ত করিয়ে নেয়া হয়। এমনই তাদের প্রশাসন পরিচালনার ‘শৈলী’। এমন সব দেশে সঙ্গত কারণেই একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী বা গোষ্ঠী তৈরি করা হয় যাদের কাজ কর্তার পছন্দের কীর্তন গাওয়া, আর বলা, আহা বেশ বেশ মারহাবা মারহাবা মারহাবা। সেখানে শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতার ভারসাম্য বলতে কিছু থাকে না।
তাদের ক্ষমতা নিরঙ্কুুশ করার সব ব্যবস্থাই করা হয়। এসব কারণেই সন্দেহ নেই, দেশে এমন একটা গুমোট পরিবেশ তৈরি করা হয়, যেখানে মানুষ স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে, ভার-অনুভ‚তি প্রকাশ করতে ভীতগ্রস্ত থাকছে। তাদের উচ্ছিষ্টভোগী গোষ্ঠী তাদের স্বার্থে এতটুকু ব্যত্যয় দেখতে পেলে বা অনুমান করলেই, যাদের দ্বারা এমনটা হতে পারে, ভাবলে তাদের ‘সমুচিত শায়েস্তা’র ব্যবস্থা করে থাকে। তাদের এমন ঔদ্ধত্য আচরণ মারদাঙ্গা কর্মকাণ্ডে নিজেদের মাস্টারদের কাছে প্রীতিভাজন ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তাদের কাছে আইনকানুন তখন সবই নস্যি। এভাবেই বিশ্বের বহু দেশ এমন গোষ্ঠীবিশেষের দেশ হিসেবে পরিচিত। সেখানে সাধারণ মানুষের ভোটের মূল্য তথা মতামতকে বাহুল্য জ্ঞান করা হয়। সীমাহীন দুঃখ কষ্টের মধ্যে থেকেও নানা আশার বাণী তাদের শোনানো হয়, যা বস্তুত আলো নয় আলেয়া, মরীচিকা সমতুল্য।
এসব দেশের নীতিনির্ধারকদের চিন্তা গবেষণা থাকে কত দীর্ঘ সময় তারা ক্ষমতার নরম গদিতে বসে এককভাবে ছড়ি ঘুরাতে পারেন। ‘বনসাঁই’ বানানোর ফর্মুলাটাও তাদের চমৎকারভাবে জানা। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেই তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘কেটে ছেঁটে’ রাখেন। প্রতিপক্ষকে একেবারে নির্মূল করতে চান না, কেননা তাতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে যদি পড়তে হয়; আন্তর্জাতিক বলয়ে তারা যাতে মিত্রশূন্য হয়ে না পড়ে। সেইসব বাছাই করা মিত্রদের ন্যায়-অন্যায় অমানবিক সব কর্মকাণ্ড চোখ বুজে তারা সমর্থন দিয়ে যান। এমন কৌশলী সরকারের একাধিক মুখপাত্র থাকে, যারা প্রতিপক্ষের প্রতি মুহুর্মুহু বাক্যবাণ ছড়াতে থাকে, এ ধার থেকে ও ধার মুভ করলেই অনবরত বাক্যে গোলা ছুড়তে থাকে। তাদের শরীর এতই স্পর্শকাতর যে, প্রতিপক্ষের যৌক্তিক আলোচনা-সমালোচনা পর্যন্ত দেহে ফোসকা ফেলে। এমন স্পর্শকাতরতার জন্য তারা মিডিয়াকে বাকরুদ্ধ করার নিত্যনতুন নিবর্তনমূলক বিধিবিধান জারি করে। আর তাতে ‘সুগার কোটিং’ দেয় যাতে আপাতত সেটা মিষ্টিই বোধ হয়।
জানি না, আমাদের জনপদের কেউকেটাগণ উপরি উক্ত বিষয়গুলো কতটা কিভাবে বিবেচনায় নেন। তবে আমাদের এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা চলে, আমাদের এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা রয়েছে। দেশের আইনকানুন তথা সংবিধানের ভারসাম্যের বিধানগুলো সঙ্কুচিত করে রাখা হয়েছে, তার চর্চা, অনুশীলন নেই। আমাদের দেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বহাল থাকলেও এই ব্যবস্থার পুরো সৌরভ সৌন্দর্য নেই। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার কারণে কখনোই ইতিবাচক কোনো ভ‚মিকা রাখার সুযোগ কারো একেবারেই নেই। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষমতাই নেই, পক্ষান্তরে দেশের প্রধান রাজনৈতিক নির্বাহীর অসীম ক্ষমতা, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতিবাচক হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বিগত ৫০ বছরের যে অভিজ্ঞতা সেটা থেকে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যে, নির্বাহীপ্রধানের ক্ষমতার পরিধি কখনো সেটা অপব্যবহারের জায়গায় পর্যন্ত যেতে পারে। সংবিধান এমন কোনো পবিত্র গ্রন্থ নয় যে, তাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না। এতকাল ক্ষমতার কোনো অপব্যবহার হয়নি যদি তা যুক্তি খাতিরেও ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ভবিষ্যতে হবে না, তার কি গ্যারান্টি আছে? সংবিধানে কোনো ফাঁকফোকর রাখা যেকোনো সময় বিপদ ডেকে আনতে পারে। তা ছাড়া সংবিধানের মূল চেতনা তো হতে হবে সমষ্টির স্বার্থ ও কল্যাণ। সম্মুখে সংবিধানে ভারসাম্যহীনতার বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপার নিয়ে। এটা আমরা সবাই বুঝি, দেশে গণতন্ত্র, জনগণের ভোটাধিকার, একটি জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের গঠন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন বা ইসির ভ‚মিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি মানসম্পন্ন, প্রশ্নমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন পেতে চাই তবে সংসদ গঠনে স্বচ্ছ প্রক্রিয়াটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এখন ইসি গঠনের ক্ষেত্রে নামকাওয়াস্তে ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। এ সম্পর্কে আমাদের সংবিধানে যা বর্ণিত রয়েছে- ‘অনুচ্ছেদ ৪৮(৩), সেখানে বলা হয়েছে, এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’ সংবিধানে এই বিধান অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দিতে হলে রাষ্ট্রপতির অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা অনিবার্য। এখানে ক্ষমতার ভারসাম্যটা পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর অনুক‚লে। তার পর আসা যাক, প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ বিষয় নিয়ে। সংসদীয় ব্যবস্থায় এটাই স্বতঃসিদ্ধ প্রথা যে, সাধারণ নির্বাচনের পর যে দল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হবে সেই সংসদীয় দলের প্রধানকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহŸান জানাতে রাষ্ট্রপতি এক প্রকার বাধ্য। তা ছাড়া দেশে অন্যান্য সাংবিধানিক পদের নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করা রাষ্ট্রপতির জন্য বাধ্যতামূলক।
এ কথা অস্বীকার করব না যে, সংসদীয় ব্যবস্থা অধিকতর জবাবদিহিমূলক। তবে সেটি আমাদের দেশে নয়, ইংল্যান্ডে ও ভারতে। সেখানে এই শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থার বিশুদ্ধতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন হতে পারে। সেসব প্রশ্নতে না হয় নাই গেলাম। তবে দু’টি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, প্রথমত- সংসদীয় ব্যবস্থা তখনই পরিস্ফুটিত হয়ে উঠবে, যখন একটি প্রশ্নহীন বিশুদ্ধ নির্বাচনের দ্বারা প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা সংসদের আসতে পারবেন, অর্থাৎ একটি ভালো নির্বাচন এ জন্য জরুরি। একটি ভালো নাটক তখনই মঞ্চস্থ হতে পারে যখন তার কলাকুশলীরা এই কলার ব্যাকরণটা ভালোভাবে রপ্ত করে থাকে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত বহু সংসদ গঠিত হয়েছে; কিন্তু সেসব সংসদের কোনোটিই কিন্তু প্রাণবন্তু ছিল না, প্রথমত এর কারণ কোনো সংসদ নির্বাচনই সুষ্ঠু প্রশ্নমুক্ত ছিল না, সে জন্য সংসদে এক দলের ব্রুট মেজরিটি থাকায় কোনো তর্ক-বিতর্ক তো হয়নি; কেবল ছিল সরকারের গুণকীর্তন। অথচ সংসদে পক্ষ-বিপক্ষে ‘হায়েস্ট ডিগ্রির ডিবেট’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আমরা দেখেছি শাহ আজিজুর রহমান, মওদুদ আহমেদ, বি. চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম, তোফায়েল আহমদ, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আসাদুজ্জামান খান, আবদুল মতিন খসরুর মতো তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ানদের যাদের ক্ষুরধার যুক্তি, অপূর্ব বাচনভঙ্গী। যাদের কথায়বার্তায় যেন সংসদ কার্যপ্রণালী প্রাণ পেত। তাদের বক্তব্য বক্তৃতার ছন্দে অপরূপ হয়ে উঠত সংসদ। সে বক্তব্যের ক্ষুরধার যুক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করা চেষ্টা থাকলেও তাতে কোনো শ্লেষ কটুবাক্য বা ব্যক্তিগত আক্রমণের লেশ মাত্র থাকত না।
যাই হোক, যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বহাল থাকা অবস্থায় সরকারি দলের সদস্যদের হাত-পা বাঁধা অবস্থায় থাকে। বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে যদি সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদটি তুলে ধরা হয়। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’ এই অনুচ্ছেদ মোতাবেক ‘সংসদে সংসদ নেতার ক্ষমতা কর্তৃত্ব এতটাই, যেকোনো সরকারি দলের সদস্যকে তার স্বাধীন চিন্তা ও মত দলের বেদিতে সমর্পণ করতে বাধ্য হতে হয়। এখানে পুরো ক্ষমতা যেকোনো সময় যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর অনুক‚লে থাকবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, সংসদীয় গণতন্ত্রের পীঠস্থান, ইংল্যান্ডের ‘মাদার পার্লামেন্টে’ এমন কর্তৃত্ববাদী বিধানের অস্তিত্ব নেই। মেম্বারগণ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেয়ার বা মত দেয়ার পুরো অধিকার সংরক্ষণ করেন। এটাই আসলে ব্যক্তি স্বাধীনতার ও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় এমন দ্রুটি নিয়ে চলার অর্থই হচ্ছে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিপদের মুখোমুখী করা। তাই যেকোনো শাসনব্যবস্থা পিউরিফিকেশনের জন্য তথা বিশুদ্ধতার জন্যই ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার বাইরে থাকা দলকে একসাথেই কাজ করতে হবে। যেমন আমাদের দেশে বিশুদ্ধ সংসদীয় শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা দরকার। কেননা এর সাথে একজন সংসদ সদস্যের স্বাধীনতা ও অধিকার জড়িত রয়েছে। যে ভয় থেকে সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে সেটা পরিষ্কার করতে চাই। প্রথমেই বলে রাখি, যদি কোনো সংসদীয় দল কোনো বিষয়ে নীতিগত বা কোনো স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। তাহলে এর যৌক্তিকতার দিকটি সংসদীয় দলে খোলামেলাভাবে আলোচনা করা, সে আলোকে সবার মতকে গুরুত্ব দেয়া হলে, সে বিষয়ে দলে সবাইকে নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হলে এর সুফলে গোটা জাতিই উপকার পাবে। সে ক্ষেত্রে সবার একমত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনো সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। আমরা কোনো বিষয়েই আজকের নিরিখে কথা বলছি না। মনে রাখতে হবে সব দিন সমান চিন্তা চেতনা বোধ বিবেচনা কোনো সময়ই এক রকম হতে পারে না। তাই সব ক্ষেত্রেই সেইফ সাইডে থাকার কথা ভাবতে হয়। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যক্তিকে প্রায়ই বিপথগামী করতেই পারে। তাহলে কোনো মানুষের বিপথগামী হওয়ার সুযোগটা রাখতে হবে। এমন বিধান রাখার পক্ষে গোঁ-ধরার ভ‚মিকার জন্য তাদের এখন হয়ত সময় এসেছে অনুতপ্ত হওয়ার।
আমরা লক্ষ্য করছি, বহু কিছু নিয়ে এখন পথেঘাটে সমালোচনা হচ্ছে। অথচ এসব বিষয় নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা পর্যালোচনা হওয়ার কোনো খবরই আমাদের কাছে নেই। অথচ সংসদ দাবি রাখে, সরকারের সব মৌলিক বিষয় নিয়ে সেই ফোরামে আলোচনা পর্যালোচনার প্রয়োজন; এমন আলোচনায় অংশ নেয়া প্রতিটি সংসদ সদস্যের অধিকার সব দেশে যেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর। সেখানে সদস্যগণ এই অধিকার পুরো মাত্রায় ‘এনজয়’ করেন। আমাদের এখানে এর মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটছে। এতকাল দেখা গেছে, যে দল সরকারের নির্বাচনী শরিক, তথাপি তাদের বসানো হয়েছে ‘অপজিশন বেঞ্চে’ যা মূলত সংসদে একটা বিরোধী দল আছে এমন নাটক সাজানো। সব সময়ই সেই অনুগত বিরোধী দলের আনুগত্যের পরীক্ষায় ‘ফার্স্ট ক্লাস’ পেয়ে এসেছে। কিন্তু কেন জানি না, তারা এখন সংসদের ভেতরে নয়, মিডিয়ার সম্মুখে সরকারে সমালোচনা করছেন। হয়তো এ-ও একটা কৌশল হতে পারে, পরবর্তী নির্বাচনে অন্যরা নির্বাচনে না এলে, তাদের দিয়ে আবার ‘প্রক্সি’ দেয়ার একটা ব্যবস্থা হতে পারে।
যাই হোক, এমন সব অনিয়ম তখন হওয়া সম্ভব হয়, যখন শাসন ব্যবস্থায় এমন একটা ‘জগাখিচুড়ির’ অবস্থা বিরাজ করলে, শাসন ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রভাব প্রতিপত্তি, কর্তৃত্বের সীমা অতিক্রম করে যায়। তবে কোনো দক্ষ, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, জনদরদী নির্বাহীর অধীনে প্রশাসন পরিচালিত হলেও সেখানেও ওপরে যে ‘সিচুয়েশনের’ কথা উল্লেখ করেছি, সেখানেও এমন ব্যত্যয় ঘটার সম্ভাবনার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই আর যে প্রধান নির্বাহীর কথা উল্লেখ করেছি, তেমন গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি যেখানে পাওয়া যাবে না, এমন ভাবাটা খুব বেশি বলে মনে রাখতে হবে। তাই যেখানে কেবলই ‘সম্ভাবনা, চান্সের’ প্রশ্ন। তবু এগিয়ে চলায় জাতির বৃহত্তর কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
শুধু সংসদ নয়, সব প্রতিষ্ঠানের একটা চলার পথ নির্দেশিকা, কিছু ঐতিহ্য ও নর্মস অবশ্যই থাকে। তবে যদি কর্মীরা শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করতে দ্বিধাবোধ ও অনীহা দেখায় তবে সেসব প্রতিষ্ঠান মসৃণভাবে চলতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের প্রতি যাদের আন্তরিকতা নিষ্ঠা ও কমিটমেন্ট থাকে, তারা এসব বিধি ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করে। তাতে সে প্রতিষ্ঠান যথানিয়মে চলতে সক্ষম হয়। ঠিক দেশের সর্বোচ্চ পরিষদেরও একটি কার্যপ্রণালী বিধি রয়েছে। সংবিধানের ৭৫(১)(ক) অনুচ্ছেদের আলোকে সেটা রচিত হয়ে থাকে বলে এর সাংবিধানিক গুরুত্ব রয়েছে। সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুসারেই সংসদ সদস্যদের সরকারের জবাবদিহি করা নানা বিধান রয়েছে। অতীতে আমরা দেখেছি, সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ও তার পূর্ব ডেপুটি স্পিকার ব্যারিস্টার সুলতান আহমদ চৌধুরী সংসদ পরিচালনায় ছিলেন অদ্বিতীয়। তারপর যারা সংসদ পরিচালনার দায়িত্বে এসেছেন স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার হিসেবে, তারা সেই দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারেননি। ফলে সংসদও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারেনি, আজও নয়। অথচ সংসদই সংসদীয় ব্যবস্থায় মূল ‘রোল প্লে’ করে। কেননা সংসদই সরকারের জবাবদিহি করার প্রধান এবং একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সংবিধানে ৫৫(৩) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রয়েছে, ‘মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন।’ এতদসত্তে¡ও সংসদ সদস্যরা যদি সংসদের ‘গাইড বুক’ তথা কার্যপ্রাণী বিধি রপ্ত করতে সক্ষম না হন, তবে সংসদে কথা বলা, সরকারের জবাবদিহি করা কঠিন বলে মনে হবে। মনে রাখতে হবে, সংসদ পল্টন ময়দান নয় যে যা ইচ্ছা তাই তিনি বলতে পারবেন। তার বক্তব্য বিধি মোতাবেক না হলে স্পিকার তার মাইক বন্ধ করে দেবেন। একমাত্র সংসদ নেতার এই প্রিভিলেজ রয়েছে যে, তিনি কথা বলতে দাঁড়ালেই মাইক পাবেন।
আমরা আবারও ফিরে যাই আমাদের এখানে ক্ষমতার ভারসাম্য কতটা কী রয়েছে। যেসব দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব আছে বটে, তবে তিনি বিধি বিধানের ঊর্ধ্বে নন, অবশ্যই তাকে তার দায়িত্ব কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে শতভাগ জবাবদিহি করতে হবে। আইনের একচুল পরিমাণ ব্যত্যয় ঘটানো তার পক্ষে একেবারে অসম্ভব। শুধু বিরোধী দলের কাজেই নয় প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের কাছেও অ্যাকাউন্টেবল। পত্রিকা সচেতন পাঠক মাত্রই ওয়াকিবহাল, ব্রিটিশ প্রধান বরিস জনসন ইদানীং কী পরিমাণ হেনস্ত হচ্ছেন সে দেশে। কোভিড চলাকালে তার দফতরে মাত্র ক’জন স্টাফ নিয়ে নিজের জন্মদিনে একটা কেক কেটেছিলেন। তাতে কোভিড আইনের ব্যত্যয় ঘটার কারণে পার্লামেন্টে এবং সে দেশের সংবাদ মাধ্যমে কী পরিমাণ নাস্তানাবুদই না তাকে হতে হয়েছে। এ জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পরও সমালোচনা তার পিছু ছাড়ছে না। এমন কি এতটুকু হয়েছে যে, তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার কথা শোনা গেছে। প্রকৃত পক্ষে এটাই গণতন্ত্র এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ‘এসেন্স’ যা এদেশে অনুপস্থিত।
আমাদের এখানে কি এসব কল্পনা করা যায়? অথচ ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে চিৎকার চেঁচামেচির কি কোন অংশে কম হয়? আসলে সব মেকি ও লোক দেখানোর যত সব নাটক। দেশে এখন দ্রব্যমূল্য, মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ, সড়কে মানুষের মৃত্যুর মিছিল, কালোবাজারি মজুদদারি- সমস্যা তো বেসুমার। কেউ কি শুনেছেন, এসব সমস্যা নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা? এসব কি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? এসব কি আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না? সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকের প্রধান খবরের শিরোনাম ছিল ‘কারসাজিতেই সয়াবিনে সঙ্কট’; সাব হেডিং ছিল ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করে ভুল করেছি- এটাই আমার ব্যর্থতা : বাণিজ্যমন্ত্রী। মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের জন্য করুণা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ দেশের নীতি বর্জিত ব্যবসায়ীরা কবে কথা রাখেন? ব্যক্তিগত লাভ লোকসান ভিন্ন কোনো কালে জনদুর্ভোগের কথা কি তারা ভেবেছেন? এমনটা বুঝতে না পারাটা অবশ্যই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। শুধু বাণিজ্যমন্ত্রী নন, এমন বহুমন্ত্রীই রয়েছেন যাদের মুখে ঘন ঘনই এমন মন্তব্য শুনি। এসব রাজনৈতিক নির্বাহীরা রাজপথে, মাঠে ময়দান গরম করতে পারদর্শী বটে; কিন্তু তাদের দিয়ে প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেছে নেয়া হয়েছে, কোন বিবেচনায় জানি না যার ফলাফল মানুষ মরমে মরমে বুঝতে পারছে।
আমরা কথা শেষ করতে চাই, এভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব একটি দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার মতোই কঠিন। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার ওপর সব কিছুই করা হয়। তা ভুলে গেলে চলবে না।
ndigantababor@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা