রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি
- অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
- ০৮ মে ২০২২, ১৯:৪৭
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর পেরিয়ে গেল। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘রানা প্লাজা’র বহুতল ভবনটি ধসে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক আহত হন। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা। অথচ এই প্রাণহানির পেছনে যারা দায়ী তাদের বিচার দীর্ঘ ৯ বছরেও শেষ হয়নি। থমকে আছে। বারবার শুনানি হয়। ক্ষতিগ্রস্তরা আদালতের বারান্দায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে; কিন্তু বিচার পায়নি। কবে পাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বুকভাঙা হতাশা নিয়ে তারা ফিরে যায়।
শুধু রানা প্লাজা নয়। তাজরীন, স্পেকট্রামসহ কোনো গার্মেন্টের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বিচার শেষ হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা, ন্যায্য বিচারটুকু তাদের ভাগ্যে জোটেনি। এর বিহিত কবে হবে তা কেউ জানে না। এটা কেন হলো? এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। এ যেন ‘ঔঁংঃরপব ফবষবুবফ, লঁংঃরপব ফবহরবফ ’-এর এক নির্মম বাস্তবতা। দেশের জিডিপিতে অংশগ্রহণ করার স্বার্থেই সে দিন তারা কাজের সন্ধানে বেরিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল বিচারটা ত্বরান্বিত করার; যার যতটুকু প্রাপ্য তাকে ততটুকু বুঝিয়ে দেয়ার। অথচ এটা হয়নি। কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতির এটাই বহিঃপ্রকাশ। পুঁজিবাদী অর্থনীতি কারো জন্য কল্যাণকর নয়! এ ব্যবস্থা সারা পৃথিবীর লাখ লাখ শ্রমিকের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। চুরমার করে দিয়েছে সুন্দর স্বপ্ন। অপর দিকে ইসলাম সাম্য ভ্রাতৃত্ব ও মানবাধিকারের বাস্তবায়ন করে মৌলিক মানবিক সুযোগ-সুবিধা যেন সবাই ভোগ করতে পারে তার নিশ্চয়তা দেয়। এটাই হলো ইসলামের বিধান।
ইসলাম শ্রমকে সম্মানিত পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশেষ করে যারা শ্রমিক তাদের শ্রমকে আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত উচ্চতায় রেখেছেন। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের একটা ঘটনা : একবার এক ক্ষেতমজুর তার সাথে দেখা করার জন্য এসেছেন। তখন তিনি তার দু’হাতে চুমু খেয়েছেন, বলেছেন, এ হাত পবিত্র হাত। এ হাত শ্রমিকের হাত। এ হাত উৎপাদনের হাত। এ হাত জাতীয় জীবনের জিডিপি বৃদ্ধির হাত। এতটুকু সম্মান তিনি দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়! ইসলামের বিধানে কী রয়েছে? শ্রমিক এবং মালিক উভয়ই সমান। পার্থক্য শুধু তাদের ঈমানের গভীরতা এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। খলিফা হজরত উমর রা: মিসরে যাওয়ার সময় আমরা শ্রমিক-মালিকের সমতা লক্ষ করেছি। আমিরুল মোমেনিন তার উটের রক্ষককে উটের পিঠে উঠিয়ে নিজে রশি ধরে পথ পাড়ি দিচ্ছেন। আবার তিনি উটের পিঠে উঠেছেন। উটের রক্ষক রশি ধরে টানছেন। যেন পথ চলার কষ্টটা উভয়ে সমান ভাগে ভাগ করে নিতে পারেন। উভয়ে যেন কষ্টটা অনুভব করতে পারেন। এটাই হলো ইসলামের শ্রমের মর্যাদা। শ্রমিকের মজুরি তার গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগে পরিশোধ করে দিতে বলা হয়েছে। নবী কারিম সা: কর্মচারীদের নিজ ভাইয়ের সাথে তুলনা করেছেন। অধীনস্থদের সাথে ভালো আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। কর্মচারীর ওপর প্রভুত্ব বা মালিকানা নয়। বলা হয়েছে তারা তাদের দায়িত্বশীল। তাদের অভাব, অনটন, কষ্ট, অন্যায়, অবিচারের জবাবদিহিতা দায়িত্বশীল হিসেবে নিয়োগকর্তাকে বহন করার কথা বলেছেন। এটাই ইসলামের বিধান। নিজে যা খাবে অধীনস্থ শ্রমিক কিংবা কর্মচারীর ক্ষেত্রেও একই ধরনের খাবার এবং পোশাকের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে।
মানবিক মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, সম্মানবোধ ও সদাচরণ ইসলামের শ্রমনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি মৌলিক নীতিও বটে। শ্রমিকদের বঞ্চিত কিংবা শোষণ করলে কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। এটা ইসলামী শ্রমনীতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য। ইসলামে শ্রমিক অধিকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের অধিকার সংরক্ষণ। শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে মালিকপক্ষকে গড়িমসি করতে নিষেধ করা হয়েছে। এটাকে একটি জঘন্যতম অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। কর্মস্থলে মানবিক এবং সুস্থ স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। শিশুশ্রম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে তাদের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। মজুরির ব্যাপারে নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বৈষম্য যেন করা না হয় সে দিকে সতর্র্ক থাকতে বলা হয়েছে। নিয়োগকর্তাকে সততা এবং সুবিচারের সাথে উত্তম ব্যবহার করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নিয়োগের প্রস্তাবে পরিপূর্ণভাবে তাদের দায়িত্ব ও সুযোগ-সুবিধার সব কিছু বিস্তৃতভাবে চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা এবং ন্যূনতম মৌলিকা চাহিদা পূরণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বেতন-কাঠামো নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে। একজন শ্রমিককে মানুষ হিসেবে তার মৌলিক ও নাগরিক অধিকার সমুন্নত রেখে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। উপরিউক্ত নীতিমালা অনুসরণ করতে পারলে রানা প্লাজার ট্র্যাজেডির আর্তনাদ কান পাতলেই শোনা যেত না।
যারা শ্রমিক আন্দোলন করেন তাদের এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য অনুরোধ করছি। ইসলামের শ্রমনীতি সব শ্রমিকের অধিকার। সব শ্রমিকের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ করার জন্যই ইসলামে শ্রমনীতির কথা বলা হয়েছে। এটা রাজনীতি করার জন্য নয়। শ্রমিকের গায়ের ঘামের বিনিময়ে আরেকজনের উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্য নয়! শ্রমিকরা না খেয়ে মরবে, বেতন পাবে না, বেতনভাতার জন্য রাস্তায় নামতে হবে-আন্দোলন করতে হবে- এটা হতে পারে না। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। ঈদে প্রতিবারই আমরা দেখি, শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের দাবিতে রাস্তায় নামে। এটা নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বৃদ্ধি পাবে শিল্প কারখানার উৎপাদন। পরিণতিতে মোট দেশজ উৎপাদন বাড়বে- এগিয়ে যাবে অর্থনীতির চাকা।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা