০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ওরে বাপরে, ডায়ালাইসিস?

-

কিডনি রোগের চিকিৎসার শেষপর্যায়ে ডায়ালাইসিস নিতে হয়। কিংবা কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। ডায়ালাইসিস রক্ত পরিশুদ্ধকরণের একটি পদ্ধতি। সাধারণত সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত বের করে তা একটি মেশিনে পরিশুদ্ধ করে ধারাবাহিকভাবে শরীরে ঢোকানো হয়। এই রোগ প্রধানত ডায়াবেটিস ও ব্লাডপ্রেসার থেকে সৃষ্ট। এই দু’টি রোগের প্রভাবে কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে দিতে থাকে। ক্রিয়েটিনিন এই রোগের পরিমাপক।

সাধারণত কিডনিতে ১.৪ মাত্রা ক্রিয়েটিনিন থাকলে তাকে স্বাভাবিক ধরা হয়। এটা বাড়তে থাকলে অবিলম্বে কিডনি বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ শতভাগ মেনে চললে কিডনির ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা দীর্ঘ দিন অপরিবর্তিত থাকতে পারে। অপরিবর্তিত থাকার মানে রোগ ভালো হয়ে যাওয়া নয়। সিকেডি (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ) হলে ক্রিয়েটিনিন খুব ধীরে বাড়তে পারে। যেমন ১.৭, ১.৮, ১.৯, ২.০ এভাবে। আবার কখনো কখনো বৃদ্ধি একেবারে থেমে যেতে পারে। তার মানে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া নয়। কিডনির ধর্ম হলো- ক্রিয়েটিনিন অবিরাম বাড়তে চাইবে, আর রোগীর কাজ হলো এর বৃদ্ধি আটকানো। এই আটকানোর কাজটি খুব সহজ নয়। ডাক্তারের পরামর্শ, খাদ্য নিয়ন্ত্রণ হলো ক্রিয়েটিনিন অগ্রগতি থামানোর একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতি অর্থাৎ খাদ্য-পানীয় নিয়ন্ত্রণ করেও যদি কিডনির ক্রিয়েটিনিনের গতি রোধ করা না যায়, তাহলে শেষ উপায় হলো সপ্তাহে দুইবার- তিনবার ডায়ালাইসিস করা। প্রতিবার ডালাইসিসের ব্যয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। সুতরাং কাউকে যদি সাত-আট বছরও ডায়ালাইসিস করতে হয়, সে ব্যয় বিপুল। যে কারণে যারা ডায়ালাইসিস নেন, তাদের বলা হয়, উনারা টাকার ওপর বেঁচে আছেন। এভাবে হিসাব করলে কাউকে যদি ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে ১০ বছর বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে তার প্রায় কোটি টাকা খরচ আছে। তবে আজকাল অতি দরিদ্র রোগীদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিছু কিছু আর্থিক বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেটিকে যথেষ্ট বলা সঙ্গত হয় না। ডায়ালাসিস না করতে পেরে বহু রোগী এই রোগে মারা যায়।

তবে এই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থা আছে। সেটি যত না ব্যয়সাপেক্ষ, তার চেয়ে বেশি প্রাপ্তিসাপেক্ষ। আর তা হলো কিডনি প্রতিস্থাপন। এই ব্যবস্থায় রোগীর কোনো নিকটাত্মীয়কে কিডনি দান করতে সম্মত থাকতে হবে। কিডনিদাতা রোগীর নিকটাত্মীয় কি না, তা ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হয়। অনেকে আবার একটি কিডনি বিক্রিতে আগ্রহী থাকেন। সে রকম কিন্তু কিনতেও ন্যূনতম ২০-৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। শুধু নিকটাত্মীয় হলেই হয় না, রক্তের গ্রুপেও ম্যাচ করতে হয়। দাতাকে কাউন্সেলিং করানোর জন্য বছরের পর বছর অনেকসময় হাসপাতালের আশপাশে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয়। এই ব্যবস্থা সাধারণত ভারতে চলে। আর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই নিকটাত্মীয় ছাড়া অন্য কারো কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় না।

এতে অসুবিধা প্রধানত দু’টি। একটি হলো- কিডনি সঠিকভাবে প্রতিস্থাপিত হলো কি না। অন্যটি প্রতিস্থাপন-পরবর্তী সম্ভাব্য অসুবিধাগুলোর সতর্ক নজর রাখা হলো কি না। এ ক্ষেত্রেও সাফল্যের শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। গত কয়েক বছরে ভারতের অন্তত দুইজন সিনিয়র মন্ত্রী কিডনি প্রতিস্থাপন করে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের একজন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। কিডনি প্রতিস্থাপন সহজ হলেও প্রতিস্থাপন পরবর্তীকালে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পানি, শ্বাস-প্রশ্বাস, ধুলাবালি প্রভৃতি বিষয়ে থাকতে হয় অত্যধিক সাবধান। তা না হলে করুণ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। অর্থাৎ কিডনি রোগের চিকিৎসা কোনোমতেই সহজ কোনো ব্যবস্থা নয়।

কিডনির মতো ব্যয়বহুল রোগের চিকিৎসা করতে না পেরে বহু রোগীর অকালে মৃত্যু হয়। তবে কিছুকাল ধরে বাংলাদেশে অনুদান-ভিত্তিক কিডনি চিকিৎসা শুরু হয়েছে। রোগী পুরো খরচের সামান্য অংশ বহন করেন বাকিটা বহন করে কিছু কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে আছে সেন্টার ফর জাকাত ম্যানেজমেন্ট। এর ব্যবস্থাপক সরকারি কিডনি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা: তৌহিদ হোসাইন। এরই মধ্যে ৭৫ জন রোগী তার ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি এ ব্যাপারে উৎসাহজনক খবর জানালেন। বললেন, এখন কিডনি রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিত্তবানরা এগিয়ে আসছেন। তিনি ওই ফান্ডের মাধ্যমে ৭৫ জন দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতাল এ ধরনের দরিদ্র রোগীদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে।
আমি কিডনি চিকিৎসক নই, রোগী। এখন থেকে ১৪ বছর আগে আমার ক্রিয়েটিনিন ছিল ১.৮। চিকিৎসকরা চিন্তিত হয়ে পড়লেন তখন। ডাক্তররা যে পরীক্ষা দেন, আমি তার আশপাশের সংশ্লিষ্ট সব অঙ্গ-প্রতঙ্গের পরীক্ষা করি। বিভিন্ন কিডনি বিশেষজ্ঞের কাছে ঢুঁ দিতে দিতে গিয়ে হাজির হলাম মিরপুরের কিডনি ফাউন্ডেশনের মাহবুবুর রহমানের কাছে। তিনি আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করে হতাশ মুখে বললেন, সন্দেহ নেই, রোগী অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন; কিন্তু অসুখের শেষপর্যায়ে আপনাকে ডায়ালাইসিসে যেতেই হবে। উনাকে আর জিজ্ঞেস করিনি ডায়ালাইসিস কী? নিজেই বইপত্র ঘেঁটে যা দেখতে পেলাম, ‘তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে উঠল। কিডনির আরো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখালাম। তারা বললেন, যদি সব কিছু মেনে চলেন, তবে ডায়ালাইসিসে যেতে ১০ বছরও লাগতে পারে। আর নিয়মকানুন না মানলে যখন তখন পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।

রীতিমতো রুটিন করে খাদ্য চার্ট তৈরি করলাম। অনেকেই পরামর্শ দিলেন, এখানকার ডাক্তারদের কোনো ভরসা নেই। আপনি বরং ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরের কোনো হাসপাতালে দেখিয়ে আসুন। গেলাম ব্যাংকক হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা রেজাল্ট প্রায় একই রকমের। তারাও খাদ্যতালিকা তৈরি করে দিলেন সেটিও বাংলাদেশী চিকিৎসকদের অনুরূপ। ভগ্ন মনোরথ নিয়ে ফিরে এলাম। তারপর চিকিৎসা চলতে থাকল।

এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগে আমি মাত্র কয়েকজন ডায়ালাইসিস রোগীকে চিনতাম। তার একজন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে তার বিরাট অবদানের কথা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু ডায়ালাইসিস করেও তিনি যেভাবে চলাফেরা করতেন, তাতে সাহস বাড়তে থাকে। ডা: জাফরুল্লাহ যদি ডায়ালাইসিস করেও এমন স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারেন, তাহলে আমি পারব না কেন। ডায়ালাইসিসের দিন আসুক।

আমি খাওয়াদাওয়া এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছিলাম ক্রিয়েটিনিন বাড়ছিল ধীর গতিতে। কখনো কখনো আবার ৮ মাত্রা থেকে সাড়ে পাঁচ মাত্রায় নেমে আসছিল। এই হতাশ, এই আশাবাদী এমনি একটা অবস্থায় চলছিলাম। ডাক্তাররা ডায়ালাইসিস নিতে তাগিদ দিচ্ছেলেন। এরপর প্রস্তুতি পর্ব। ইবনে সিনা, স্কয়ার, পিজি প্রভৃতি হাসপাতালে কত ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে করা হলো- তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এসব হাসপাতালে মাসখানেক ভর্তিও থাকলাম। তারপর হঠাৎ একদিন সাড়ে আট। যোগাযোগ করলাম জাকাত ম্যানেজমেন্টের তৌহিদ হোসাইনের সাথে। তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভর্তি হয়ে গেলাম ইবনে সিনায়। প্রথম দিন আড়াই ঘণ্টা। এরপর থেকে ৪ ঘণ্টা।

প্রথম দিন নার্স দক্ষ হাতে সুচ ফোটালেন। সে দিন ছিল ২৬ এপ্রিল। কেমন যেন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর দেখলাম ব্যাপারটা ইনজেকশনের সুচ ফোটানোর চেয়ে অধিকতর কষ্টকর কিছু নয়। দুটো সুচ ফোটায়। এ দুটো সুচের কোনটার কী কাজ বলতে পারি না। ক্ষুধা লাগে। ডাক্তার বললেন বেশি করে প্রোটিন খেতে হবে। যে প্রোটিন সীমিত ছিল, তা খানিকটা অবারিত হলো। এখনো সপ্তাহে দুই দিন করে ডায়ালাইসিস নিচ্ছি; বন্ধু-বান্ধবরা জিজ্ঞেস করে এখন কেমন আছ। কী যে জবাব দেবো। বলি, ভালো আছি। আগের চেয়ে বেশি না কম, বলতে পারি না। তবে চলে গেছে ডায়ালাইসিসের ভয়।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement