২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও আমাদের দেশ

-

সব গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে পক্ষে-বিপক্ষের মধ্যে হামেশাই তর্কবিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা নিতান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ। এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের ভেতর দিয়ে জনগণ রাষ্ট্রযন্ত্রের চলমান বিভিন্ন ইস্যু, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে দেশের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। তবে সেখানে যে তর্কযুদ্ধ হয়, অবশ্যই সেটি প্রতিষ্ঠানভিত্তিকই হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যেহেতু রাজনৈতিক তথা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পাকাপোক্ত নয়, সে জন্য আমাদের সংস্কৃতিতে এমন তর্কবিতর্ক, মাঠে ময়দানে বক্তৃতা-বিবৃতিতে ও সংবাদপত্রের পাতায়ই তার প্রতিফলন ঘটে।

অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে আরো কিছু বিষয়ে, এখানে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমন অন্যান্য দেশে এমন তর্ক সাধারণত রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয় কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ থাকে; কিন্তু এখানে যে তর্কবিতর্ক সেটি সেই পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে একান্ত দলীয় বিষয়সহ কখনো কখনো সেসব আলোচনা-তর্কের বিষয় এতটা নিচে নেমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে, যা অরুচিকর। সে বক্তব্য-বিবৃতিতে বিভিন্ন সময় শালীনতা ভব্যতার অনুপস্থিতি পর্যন্ত প্রতিভাত হয়। এসব নেতিবাচক কথাবার্তা রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা উষ্ণতা সৃষ্টি করে থাকে। ফলে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সম্পর্কের অবনতি ও দূরত্ব সৃষ্টি করে। তার জের হিসেবে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে পরস্পর মারমুখো মানসিকতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে জন্য হরহামেশাই দেখা যায়, শোনা যায়, দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে হানাহানি, সঙ্ঘাত ও সংঘর্ষ। আর নেতৃবৃন্দ পর্যায়ে পরস্পরের ভেতর দেখি, কুশল বিনিময় পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। কখনো কোনো জাতীয় দুর্যোগকালে প্রয়োজন জরুরি হলে তাদের মধ্যে কোনো উইন্ডো ওপেন হবে কি না সন্দেহ। এটা কেবল হালের বিষয়, তা বলব না। গত ৫০ বছর ধরেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা সেটি পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন।

এই দুর্ভাগ্যজনক ধারা বিদ্যমান থাকার কারণে বহু ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে আসছে। এটা অবশ্যই আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা ছাড়া ভিন্ন কিছু বলা যাবে না যে, আমরা দেশে শুদ্ধ-সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আরো দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এমন দলান্ধতা আমাদের মনমগজে প্রোথিত হয়েছে, যার কারণে গুণী-জ্ঞানী, প্রখ্যাত চিন্তক, বিশিষ্ট বোদ্ধাজনদের মেধার বিচার ও সম্মান দেয়া হয় না। তাদের মনের গহিনে যদি ছিটেফোঁটা রাজনৈতিক রঙ ম্লান দীপশিখার মতো তির তির করে জ্বলন্ত রয়েছে বলে সন্দেহ হয়, তবে সেটিকে ডায়নোসরের মতো বিশাল ভেবে, তাদের বিচ্যুত এবং বর্জন করা হয়। যেখানে জ্ঞান পাণ্ডিত্যের মর্যাদা, স্বীকৃতি নেই; তার অবদানকে খাটো করে দেখা, স্বীকৃতি দান নিয়ে হীনম্মন্যতা খুব বেদনাদায়ক। আজকে এই জনপদে সর্বত্র এমন বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। রাজনৈতিক এমন বিভাজন বিভেদ বিদ্যমান থাকার ফলে আমরা কিছুই করতে পারিনি।

এমন প্রশ্ন কি আমাদের নেতৃবৃন্দের মনে জাগে না, গত ৫০ বছরে আমরা বা তারা জাতিকে তেমন কিছুই দিতে কি পেরেছি? এ আলোচনা অনেক দীর্ঘ হবে, সন্দেহ নেই। শুধু একটা কথাই বলি, আমরা তো এমন কোনো প্রতিষ্ঠান গড়তে পারিনি, যা জাতির বাতিঘর হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলি যে, এ উত্তম শাসনব্যবস্থা দেশে কায়েম রয়েছে, কিন্তু তা কি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে? ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় বিশ্বের ‘মাদার পার্লামেন্ট’ যে পার্লামেন্ট মানুষ গড়ে দিয়েছে, যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়ে বলা হয় এই পার্লামেন্ট ‘মহিলা পুরুষ আর পুরুষকে মহিলা’ করতে না পারা ব্যতীত আর সবই করতে সক্ষম। আমরা এতটা করতে হয়তো পারব না, কিন্তু একটি কার্যকর প্রাণবন্ত জনপ্রতিনিধিমূলক সংসদ গড়ার আজ অবধি চেষ্টা সাধনা করেছি কি? পারিনি, কারণ জনগণের মতের মূল্যে বিশ্বাসী হওয়া যায়নি। সংসদ সত্যিকারভাবে প্রাণ পেত যদি সেখানে সুষ্ঠু প্রশ্নহীন নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্ট সংগঠিত হতো, যার একটা ক্ষীণ প্রতিফলন ঘটেছিল দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে। সে ধারা আর বিকশিত হতে পারেনি; মরুপথে তা হারিয়েছে। সেই ধারাকে যদি বাঁচিয়ে রাখা যেত তবে হয়তো আশা করতে পারতাম, আমাদের অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এভাবে এগিয়ে যেতে পারলে সংসদীয় গণতন্ত্রের স্বরূপ সৌরভ ছড়াত। এখন সংসদ সত্যিকার সংসদীয় ব্যবস্থার ‘রোল’ তো ‘প্লে’ করতে পারছে না, এর কারণের মধ্যে রয়েছে, সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্বকারী বিরোধী দল না থাকা। দেশের প্রধান নির্বাহী সেটি বোঝেন, তার ‘ইগো’ তিনি করেছেন।

এখন কোনো পরিবর্তন কামনা করা হলে সেটি কারো একার পক্ষে কিছু করার মত পোষণ করা বা ভাবা হয়তো ঠিক হবে না। গত ১২-১৩ বছরে দেশের ভেতর একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি হয়েছে সরকারের আনুকূল্যে-আশীর্বাদে। তারা তাদের ভোগবিলাস হাত ছাড়া করবে, এমনটা নয়। তেমনি সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে হলে তাদের ভাবনাও তো রয়েছে। এ বুদ্ধিজীবী মহলেও সরকারের ঘোর সমর্থক রয়েছে। এমনকি শক্তির ভরকেন্দ্রগুলোয়ও প্রশাসনিক চেইনের বাইরেও সরকারের প্রতি ‘অতি কোমল’ একটা মানসিকতা সৃষ্টির বিষয় উড়িয়ে দেয়া যায় না। তা ছাড়া একটা কথা মনে রাখা, সরকারের প্রতি অত্যন্ত আনুগত্যশীল এক বিরাট কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক বিপর্যয় লক্ষ করলে, তারা কিন্তু বাঁধভাঙা স্রোতের মতো হয়ে উঠতে পারে। দলীয় আনুগত্যের পর তারাও তো, ঘি-মাখনের ভাগ পেয়েছে, ক্ষমতার দাপট উপভোগ করেছে। গণতন্ত্র, নির্বাচন, সব শ্রেণীর মানুষের মনোবাঞ্ছা, তাদের চেতনা ও উপলব্ধিতে এসব বিষয় অবশ্য মহামূল্যবান ও দেশের জন্য অপরিহার্য হলেও ক্ষমতাসীনদের দলান্ধ ও সুবিধাভোগী কর্মীদের কাছে এমন মূল্যবোধের এতটুকু মূল্য নেই। তবে এ কথা ঠিক, যেকোনো দলের কর্মী-সমর্থকদের স্রোত, দেশব্যাপী জনতার প্লাবনের মুখে সেসব স্রোত খুব একটা কার্যকর হবে না। সে স্রোত ভিন্ন পথ ধরে এগোবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ভালো নির্বাচন, নির্বাচন এবং নির্বাচনই একমাত্র সব কিছুর সমাধান করতে পারে।

সে যাই হোক, আগামী নির্বাচন কোন ধরনের প্রশাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে সে প্রশ্নের নিষ্পত্তি হওয়া অপরিহার্য; যদি দেশে একটা ভালো তথা মানসম্পন্ন, গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হয়। এ দিকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানে বিপুল গণতন্ত্রমনা মানুষের অভিপ্রায়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এমন মনোভাব যথেষ্ট শক্তিশালী যে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিকল্প নেই। সে জন্য যে ‘মেজার্স’ নেয়া প্রয়োজন তা নেয়া জরুরি। আজকে দেশের অবস্থাটা এমন যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তর্ক ও কাদা ছোড়াছুড়ি। এটা হয়তো ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত। সবার মনোজগতে নির্বাচন নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা এখন জেগেছে। নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং পরস্পরবিরোধী মতামতের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন হবে, সবার নির্বাচন সম্পর্কে মতপথের যে ভিন্নতা, তার সুরাহা কিভাবে হবে এবং কে করবেÑ সেটি একটা জটিল প্রশ্ন, কিন্তু তা হওয়া খুব জরুরি। বিষয়টি সিইসি উপলব্ধি করেছেন। তার পক্ষে রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে খুব বেশি কিছু একটা বলা সম্ভব নয়। তা খুব স্পর্শকাতর বিষয়, তারপরও তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা এবং মৌলিক বিষয়গুলোর বিষয়ে সমঝোতায় আসাটার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছেন। যথাসময়ে ঠিক কাজ করতে পারার মধ্যে সাফল্যে পৌঁছার পথটা পরিষ্কার ও সংক্ষিপ্ত হয়। এখন একটি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সেটি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রশ্নটি সুরাহা হওয়া। তবে এ ব্যাপারে সরকারের প্রতিপক্ষের ছোট-বড় দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যচিন্তা লক্ষ করা যাচ্ছে যে, আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করা যাবে না। আসলে ঐকমত্য দৃঢ়তর হওয়ার পেছনে আগে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পেছনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে যেমন অতীতে দলীয় সরকারের অধীনে যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার একটিও সুষ্ঠু, অবাধ, প্রশ্নহীন, অংশগ্রহণমূলক হয়নি। প্রায় ক্ষেত্রেই অনেক দল ভোট বর্জন করেছে, কোনোটিতে জনগণ ভোট দিতে নিরাপত্তার অভাবে ভোটকেন্দ্রে যায়নি, কখনো মধ্যরাতে ব্যালটে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে।

কখনো ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে ইচ্ছামতো সিল মারা হয়েছে। এসব কিছুই দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারীদের সম্মুখেই ঘটেছে। তাই দেশে-বিদেশে সরকারের বিপক্ষ দলগুলোর দাবির প্রতি জোরালো সমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে। অবশ্য ক্ষমতাসীনরা এখনো তাদের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। তবে ওই মত শুধু সরকারবিরোধীদের নয়; একটা মানসম্পন্ন গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকদেরও মত। তবে তারা কোন ধরনের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সে সম্পর্কে সরাসরি কথা না বলে এ ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বন করেছেন। তাদের তো অতীতের সব নির্বাচনের আদ্যোপান্ত ইতিহাস জানা। তার পরও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রতি লক্ষ রেখে, শুধু এ কথার ওপর বেশি জোর দিচ্ছেন, বাংলাদেশে তারা ‘পার্টিসিপেটরি ইলেকশন’ চান। বিরোধী দলগুলো তো এ প্রশ্নে অটল যে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। সে ক্ষেত্রে তো পার্টিসিপেটরি ইলেকশন হবে না। তাই তারাও তেমন নির্বাচন মেনে নেবে না। সেটা তাদের বক্তব্যের ভেতর কৌশলে বলে দিয়েছেন। এসব বিষয় এই মুহূর্তে পাশ কাটানো খুব কঠিন ব্যাপার বলে দেশের ওয়াকিবহাল মহল মনে করে। তারা পশ্চিমের বিশেষ করে হালে মার্কিন ‘নীরব কূটনীতি’ খুব মারাত্মক বলে তারা মনে করেন যার কালো ছায়া ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দিগন্ত স্পর্শ করেছে। ‘করোনাভাইরাস’ যেমন মুহূর্তে তার রূপ পরিবর্তন করে তেমনি এই ‘নীরব কূটনীতি’ রূপ পরিবর্তন করতে পারে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। রাশিয়ার কথাটাই ধরি, সেখানে ইউক্রেনের প্রশ্নে পশ্চিমের কৌশল রুশ অর্থনীতিসহ অন্য অনেক কিছুকে শুইয়ে দিয়েছে! রাশিয়া সুপার পাওয়ার বটে; তার অর্থনীতিও অনেক বড় এবং শক্তিশালী বটে। এসব আমাদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করে।

আগামীতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলের সরকারই আসুক, তা নিয়ে কারোই কোনো মাথাব্যথার কারণকে আমরা যৌক্তিক ও গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচায়ক বলে মনে করি না। দেশের প্রধান কোনো দলই ভুঁইফোঁড়, এমন ধারণা একেবারে অগ্রহণযোগ্য বিষয় নয়। দেশের বড় চারটি দল একাধিকবার ক্ষমতায় ছিল; আর একটি দল সক্ষমতার সাথে একটি বড় দলের সাথে মন্ত্রিসভায় ছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তন কখনোই অস্বাভাবিক নয়। তবে কোনো দলের জন্য এমন মনোভাব পোষণ করা সঠিক নয় বলে মনে করি যে, কোনো দল মনে করে যদি ‘আমরাই যোগ্য, আমরাই সক্ষম, আমাদের বিকল্প কেবল আমরাই, দেশকে আমরাই শুধু ভালোবাসি আর অন্যরা দেশের মঙ্গল চায় না; দেশকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারবে না, আমরাই শুধু দেশের উন্নতি করতে সক্ষম, অন্যরা সব ‘নাচিজ’-এমন ভাবা ‘অহমিকার’ প্রকাশ। আওয়ামী লীগ দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থেকেছে এবং এখন আছে, তারা দেশের জন্য কাজ করছে। বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, তারা দেশের জন্য করেছে। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় ছিল তারাও দেশের জন্য কাজ করেছে। মরহুম এরশাদের সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান গ্রামীণ জনপদের উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণ। সেখানে ছোট টাউনশিপের প্রতিষ্ঠা হয়েছে যা কিনা গ্রামীণ জীবনে বিরাট অবদান এখন রাখছে।

ক্ষমতাসীনদের নেতাকর্মীরা উচ্চকণ্ঠ, দেশের মেগা প্রকল্প নিয়ে সোচ্চার, আমরাও সেটিকে স্মরণ করি ঢাকা শহরে যানজট নিরসনের জন্য ফ্লাইওভার তৈরি করা হয়েছে তা তো ঠিকই; কিন্তু এখন তো উল্টো সে প্রকল্প যানজটের কারণ হয়ে পড়েছে। মেগা প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে বলে সরকারি মহল থেকেই বলা হচ্ছে, সেই সাথে এটাও প্রশ্ন, সব মেগা প্রকল্প কি সাধারণের জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে আসবে! গ্রামীণ জনপদের বৈষম্য হ্রাসের জন্য সংবিধানে যে তাগিদ দেয়া হয়েছে, তার কতটুকু কী হলো এটা তো মৌলিক বিষয়। সরকারি ব্যাংকগুলো এখন অর্থ লোপাটের যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কোনো জবাবদিহিতা নেই, এসবই জনগণের সম্পদ অথচ তারা কিছু জানছে না। দেশে দুর্নীতি সবসময়ই কিছু ছিল ঠিকই; কিন্তু এখন এর মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থ পাচার হচ্ছে বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো। কালো টাকার পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে ব্যক্তিবিশেষের কাছে, এসব কিছু যেন গা সহা হয়ে যাচ্ছে। এত অনিয়ম, অব্যবস্থার অবসান ঘটবে কিভাবে? এসব নিয়ন্ত্রণের যেসব সংস্থা প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের নিয়ে জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে। তারা থাকবে, দুর্নীতি অব্যবস্থা সমান্তরালভাবে চলবে। এটা কেমন করে হয়, গরিব দেশে এমন পরিস্থিতির পর যদি বলা হয়, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তবে ধাঁধায় পড়তে হবে। দেশে দুঃখ কষ্ট আর বৈষম্যে শিকার হয়ে দুঃসহ বেদনায় আত্মহত্যা করেছে দুই কৃষক এক ছাত্র। এটা কি দেশের ভাবমর্যাদা উচ্চকিত করবে? ভারতে কৃষকরা মাঝে মধ্যে দুঃখ বেদনায় লীন হয়ে আত্মহত্যা করে। সেটি নিয়ে সে দেশের এবং বাইরের মানবাধিকার কর্মীরা কর্তৃপক্ষের নিন্দায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। আমাদের কে ছেড়ে কথা কইবে? আমাদের এমন সব ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় ভেবে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না, তিলই একসময় তাল হয়ে ওঠে। তা ছাড়া দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বহু অভিযোগ রয়েছে। হালে আবার ইলিয়াস আলীকে নিয়ে কথা উঠেছে। সরকারের এক আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বলেছে যে, ইলিয়াস আলীকে খুঁজে বের করার জন্য তাদের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। তা ছাড়া বহুজনের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা নিয়ে তাদের স্বজন-সুহৃদ অভিযোগ করে আসছে। তারা কারো কাছ থেকে এ পর্যন্ত কোনো সদুত্তর পায়নি, তাতে তাদের আহাজারি ও ক্ষোভ প্রকাশ পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। আমেরিকার বাইডেন প্রশাসন ইদানীং বাংলাদেশের অনেক বিষয়ের সাথে, গুম হওয়া ও মানবাধিকার নিয়ে অনেক বেশি ‘কনসার্ন’। আগে লক্ষ করা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বার্ষিক মানবাধিকার ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে তারা সীমাবদ্ধ থাকত, এখন মনে হয়, তারা সেই অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে।

দেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো দেড় বছরের বেশি; কিন্তু এখনই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান সরগরম হয়ে উঠছে। অতীতের মতো আগামীতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল, আর বিএনপি নেতৃত্বে ২০ দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা সীমাবদ্ধ থাকতে পারে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে। ১৪ দলে কোনো নতুন দলের অন্ততর্ভুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হলেও ২০ দলের যোগ-বিয়োগের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের বিপক্ষে এখন যেসব ছোট দল সোচ্চার, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তারা সম্ভবত বড় প্লাটফর্ম থেকে নির্বাচন করার কথাই ভাববে। অপর দিকে বিএনপি মহল থেকে এমন ধারণা দেয়া হচ্ছে, আগামীতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ ঘটে, তবে তারা এককভাবে নয় সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এমন ধারণা ‘প্রোগমেটিক’, দেশের যে বিপুল সমস্যা, সে বিষয়ের কথা উল্লেখ করলে অত্যুক্তি হবে। গত ৫০ বছর এসব সমস্যা নিয়ে এ জনপদের মানুষ দিন যাপন করছে, তাই সেসব কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করার দরকার নেই। সে তালিকা এতই দীর্ঘ হবে, সেটি বরং কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হবে। সে যা-ই হোক, জাতির আজ অনেক কিছুর প্রয়োজনের মধ্যে সবাই মিলেমিশে কাজ করাটাকে অগ্রাধিকার দেয়াটা বেশি প্রয়োজন। এ যাবৎ যারাই ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে তারা একাই ক্ষমতার ‘ছড়ি’ ঘুরিয়েছে, কাউকে বৃহত্তর পরিসর গড়তে কাছে ডেকে নেয়নি। স্বাধীনতার পর জাতীয় সরকার গঠনের জন্য দাবি তুলেছিলেন তৎকালীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ; কিন্তু আওয়ামী লীগ সে দাবি অগ্রাহ্য করেছিল।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল