২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ফুটপাথ ফিরিয়ে দিন

ফুটপাথ ফিরিয়ে দিন - প্রতীকী ছবি

সকাল ১০টা। রাস্তার যানজটে আটকে পড়া একটি গাড়ি। ভেতরে দু’টি শিশু, সাথে একজন মা। শিশুরা বেরিয়েছে স্কুলের পথে। ক্লাস শুরু হবে সকাল সাড়ে ৯টায়। বাসা থেকে স্কুলে যেতে স্বাভাবিক সময় ১৫ থেকে ২০ মিনিট। কিন্তু যানজটের কথা ভেবে বেরিয়েছে সকাল ৮টায়। কখন স্কুলে পৌঁছবে, তার নেই ঠিক। ছোট শিশুদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন রয়েছে। কোথায় সারবে তার কোনো ব্যবস্থা নেই। চতুর্দিকে শুধু গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির হর্নের বিকট আওয়াজ, কালো ধোঁয়ায় শ^াসরুদ্ধকর অবস্থা। এটা হচ্ছে রাজধানী ঢাকাবাসীর জনজীবনের যানজটের চালচিত্র। একে তো রোজা। তার উপর প্রচণ্ড গরম। গাড়িতে আবদ্ধ শিশুর দুর্দশার কথা ভাবা কি যায়? যারা ভাববেন তারা তো নির্বিকার, নিশ্চুপ। তাদের যেন এ ব্যাপারে কোনো দায় নেই। এ যেন যারা রাস্তায় বেরিয়েছেন তাদেরই অপরাধ। ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ মোটরসাইকেল ও হকার। এদের দখলে ফুটপাথ। অগ্যতা সাধারণ পথচারী রাস্তায়। ফলাফল প্রায়ই গাড়ির চাকায় চাপাপড়া মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

মাঝে মাঝে রিকশা ও ভ্যান দেখা যায় ফুটপাথে। হকার শুধু ফুটপাথে নয়, ফুটপাথ ছাড়িয়ে মূল সড়কও দখল করে বসে আছে। এ যেন তাদের সম্পদ, তাদের অধিকার। মাঝে মাঝে দেখা যায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেককে কেনাকাটা করতে। দেখা যায় বাসচালকদের আড়াআড়ি ভাবে মাঝ রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করতে। রয়েছে বিভিন্ন রাস্তার এক অংশজুড়ে গাড়ি পার্কিং। ছোট রাস্তা আরো ছোট করে যানজট অসহনীয় করার আইনানুগ ব্যবস্থা। রয়েছে রাস্তার মোড়ে মোড়ে অবৈধ রিকশার স্ট্যান্ড। অপর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের প্রাণান্তকর চেষ্টা অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য। ভিক্ষুকের জায়গা দখল, গাড়ির কালো ধোঁয়া সব মিলিয়ে প্রাণান্তকর অসহনীয় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সব দেখে মনে হচ্ছে, ঢাকা মহানগর যেন ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে।

সাধারণ মানুষ এবং পথচারীদের আকুল আবেদন, আমাদের পথ চলার ব্যবস্থা করুন। ফুটপাথ ফিরিয়ে দিন। হকার ও ভিক্ষুকমুক্ত করে দিন ফুটপাথ। ঢাকা মহানগরকে সিঙ্গাপুর বানানোর চিন্তা ছেড়ে আমজনতাকে হেঁটে চলার ব্যবস্থা করে দিন। বিশে^র বিভিন্ন বড় বড় শহরে দেখেছি, সপ্তাহে একেক দিনে একেক সড়কে চার থেকে ছয় ঘণ্টার জন্য হকার মাকের্টের ব্যবস্থা। রয়েছে রাত্রিকালীন হকার মার্কেট। ওইসব দেশে শহর থেকে বেশ দূরে হকার মাকের্ট। মার্কেটে যাওয়ার জন্য সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধা রয়েছে। রয়েছে স্কুল এবং অফিসের বিভিন্ন সময়সূচি যেন একসাথে হুড়মুড় করে সব গাড়ি রাস্তায় না নামে। আছে সড়কের ধারণক্ষমতার বাইরে যেন গাড়ি না নামে তার জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। রয়েছে একমুখী চলাচলের চমৎকার ব্যবস্থা ও বাস্তবায়ন। দ্রুতগতি এবং ধীরগতি যানচলাচলের ভিন্ন ব্যবস্থা। সবই জনজীবনকে সহজ করার জন্য।

কলকাতা মহানগরীকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে হকার এবং রিকশামুক্ত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ঢাকা মহানগরী রিকশা ও হকারের নগরীতে পরিণত হয়েছে। যারা নিয়মিত সরকারি কর পরিশোধ করেন তাদের সুযোগ সুবিধার ওপর এটা একটা বাড়তি চাপ। পানি সঙ্কট, গ্যাস সঙ্কট, বিদ্যুৎ সঙ্কট ও পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ বাড়তি জনগোষ্ঠীর চাপ। রাজধানী ঢাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা কার্যত অচল। যানজটের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এ শহরে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের চলাচল। যেখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকার কথা প্রায় ১০ হাজার সেখানে আছে মাত্র তিন হাজার ৮০০ জন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে প্রতিদিন গড়ে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা যা সাশ্রয় করতে পারলে আমরা আরেকটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারতাম। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভাষ্য এটি।

এ ছাড়াও যানজটে গাড়ির বিষাক্ত কালো ধোঁয়া তিলে তিলে কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের গড় আয়ু। মোটাদাগে বলা যায়, যানজট পরিস্থিতি যেভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে তা প্রতিরোধ করতে না পারলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে ব্যবস্থাপনা রোজায় দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়াকে ঠিক করতে পারে তা ঢাকাবাসীকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে নিঃসন্দেহে মুক্তি দিতে পারে। প্রয়োজন দৃঢ় সঙ্কল্প, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। এ ক্ষেত্রে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন। প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। নগরবাসীর জন্য প্রয়োজন হাঁটার পথ। কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন, দয়া করে ফুটপাথ মুক্ত করে ফিরিয়ে দিন হাঁটার সুযোগ। ব্যবস্থা করুন বুক ভরে শ্বাস নেয়ার।

লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement