৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ৩০ রজব ১৪৪৬
`

নিজের দিকে তাকানোর এখনই সময়

নিজের দিকে তাকানোর এখনই সময় - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে অগ্রসর হতে চাইছে, এগোচ্ছে। তবে এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভীপ্সা শুধু অনিবার্য প্রত্যাশা উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তা অর্জনে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনার, ত্যাগ তিতিক্ষার, অর্জন-বর্জনের, সংস্কারের সাধনায় সাফল্য লাভ করতে হবে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সম্ভাব্য অবনতিশীল বিশ^ পরিস্থিতিতে প্রতিটি দেশের উচিত হবে নিজেদের আত্মশক্তি, অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, সম্ভাবনা ও সুযোগ এবং হুমকি বা চ্যালেঞ্জ যথাযথভাবে শনাক্ত করে নিজস্ব সব শক্তি ও সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার এবং চিহ্নিত দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠায় ও চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় মেধাবী ও কৌশলী পথ পন্থা বের করা এবং তা বাস্তবায়নে রীতিমতো ঐক্যবদ্ধ সাধনা বা সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া।

মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রয়াস প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনা শনাক্তকরণ যেমন জরুরি, তেমনি এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা, অসঙ্গতি ও অপারগতার দিকটিও আরো বেশি সচেতন-সতর্কতার সাথে বারবার পর্যালোচনাযোগ্য। কেননা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন তথা স্বয়ম্ভরতা অর্জন শুধু ভাব ভাবনার বিষয় হয়ে থাকলে এবং এ ব্যাপারে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও আবশ্যকতার উপলব্ধি যদি অবহেলা অমনোযোগিতার হাতে বন্দী থাকে তা হলে স্বপ্ন দেখাই শুধু সার হবে, ভাব ভাবনারা বাস্তবতার বাসর পাবে না।

বছর কয়েক আগে ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলনের মাধ্যমে একটি বিষয় সবার চিন্তা-চৈতন্যের চৌহদ্দিতে এসেছিল যে, অবলীলায় আইন অমান্য করে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে, আমাদের সম্ভাবনা ও সুযোগকে অপব্যয় অপচয় করে দিব্যি আমরা আমাদের প্রিয় নগর ও প্রান্তর সর্বত্র যাতায়াত ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে হলাহলপূর্ণ পরিবেশ নিজেরাই রচনা করে চলেছি। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে মূল্যবান ও কারুকার্যসংবলিত আধুনিক সিগন্যাল বাতি বসানো আছে। ডিজিটাল পদ্ধতির এসব সিগন্যাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বাস্তবে দেখা যায়, এগুলোর প্রকৃত ব্যবহার একেবারে নেই। বিপুলসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ তাদের মান্ধাতা আমলের উপস্থিতি দিয়ে, সম্পূর্ণ অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ‘নিজের ব্যক্তিগত খেয়াল খুশি ও বিচার’ মতো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে চলছেন। এক দিকে ডিজিটাল সিগন্যাল লাইটও জ্বলছে আবার বিপরীত বলয়ে ট্রাফিকের ম্যানুয়াল (ব্যক্তিগত) কসরতও চলছে। এ অব্যবস্থাপনায় শুধু ট্রাফিক পুলিশের নয়, সড়ক ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষের সহস্র শ্রমঘণ্টা বিনষ্ট হচ্ছে। মহার্ঘ মূল্যে ক্রয় করা এবং সংস্থাপিত সিগন্যালিং সিস্টেমের ব্যবহারিক কার্যকারিতা না থাকলেও সেগুলো নিয়মিত জ্বলছে, ইনডিকেশন দিয়ে চলছে এবং সেগুলোর সংস্থাপন ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিশ্চয়ই বহন করতে হচ্ছে। এই অপচয় ও অপব্যয় একটি মধ্যম আয়ের খায়েশধারী দেশের জন্য ব্যয়বহুল বালসুলভ ব্যবস্থা নয় কি? নিজেরা নিজেদের নিয়মশৃঙ্খলা অনুসরণের ক্ষেত্রে এতটা উদাসীনতা ও দায়িত্বহীন হয়ে পড়েছি যে আমাদের প্রিয় ঢাকা মহানগরীর ‘অবাসযোগ্য শহর’ তালিকায় সব শেষের আগের ক্রমিকে জায়গা মিলেছে।

দেশের টেলিভিশন চ্যানেলে দেশী পণ্যের প্রচারের ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থা নিয়ে ক্লিনফিড ব্যবস্থাপনার একটি কঠোর পদক্ষেপ বলতে গেলে আতুরঘরে মারা গেল। বিদেশী টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর ওপর হিসাব-কিতাব তদারকি বাবদ বাড়তি ব্যয়ও আছে, যা আলটিমেটলি ভোক্তার ওপর গিয়ে বর্তায়। অথচ অবাধে সম্প্রচারিত বিদেশী চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত হচ্ছে পণ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপন, যা আমাদের দর্শক শ্রোতারা শুধু দেখছেন না গিলছেনও। অথচ এই প্রচারের ওপর কোনো ট্যারিফ, শুল্ক বা ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থাপনা নেই। আপন ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতির সম্মান স্বীকৃতি ও অধিকার আদায়ে রক্তদানকারী এবং এমনকি নিজেদের ভাষার নামে যে দেশের নাম সেই দেশে এক দিকে খোলা জানালায় বিদেশী অনুষ্ঠান, ভাষা ও সংস্কৃতির অবাধ অনুপ্রবেশ এবং তার ওপর অন্য অর্থনীতির পণ্যের অবাধ প্রচার দেশীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও পণ্যের আত্মরক্ষা এবং বিকাশে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুুখীন হতে হচ্ছে। এক দিকে দেশীয় উদ্যোক্তারা ভ্যাট-ট্যাক্স দিচ্ছেন আর বিদেশী পণ্য প্রচারের ওপর ভ্যাট না থাকায় সেসব সামগ্রী প্রতিযোগিতার বাজারে বিশেষ সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে আরো উদ্বেগের বিষয় এই যে, এখানকার পণ্যের প্রচার বিজ্ঞাপন বিদেশে তৈরিতে এবং সেখানে থেকে এখানে প্রচার করানোর নামে মহার্ঘ বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের সুযোগ বাড়ছে। এটি ‘সামান্য ক্ষতির’ উদাহরণ মনে হতে পারে, তবে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক সার্বিক স্বার্থের দৃষ্টিতে অপঘাত।

মধ্যম আয়ের দেশ অভিলাষী একটি দেশে সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আর্থিক ‘অন্তর্ভুক্তি’র দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তা শুধু কথার কথায় কিংবা বিদেশে বিশেষ সেমিনারে স্বীকৃতি ও প্রশংসা প্রাপ্তির মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে বিকশিত হতে পারে না। অন্তর্র্ভুক্তির দর্শনকে সার্বিকভাবে টেকসই ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হয়। প্রশাসনিক আর্থসামাজিক পরিবেশে, সংস্থায়, প্রতিষ্ঠানে, দেশজ সংস্কৃতিতে সর্বত্র দল বা গোষ্ঠীভুক্তকরণের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিরোধীপক্ষকে বিচ্যুতকরণ ব্যবস্থাপনার বিবরে অর্থনৈতিক অন্তর্র্ভুক্তি উন্নয়ন দর্শন, যাতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়। রাষ্ট্রের সেবা ও সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে (ক্ষেত্র, অঞ্চল ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি) বিশেষ প্রাধান্য এবং অন্যায় অনিয়মে প্রতিকার প্রতিবিধানের বেলায় পক্ষপাতিত্ব কিংবা অপরাগতার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির দর্শন বিকশিত হতে পারে না। বিনা বিনিয়োগে ও শ্রমে অবৈধ আয় উপার্জনের অবারিত সুযোগে সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি হয়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটার কারণে দুই-তিনগুণ ব্যয় বৃদ্ধি পায় তা তো যেকোনো বিবেচনায় ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিস প্রডিউস না হয়েও অতিরিক্ত অর্থব্যয়’। নানান অস্থিরতায় উৎপাদন ব্যাহত, সরবরাহে বিঘœ, নানান দুর্ঘটনায়, দুর্নীতিতে অস্বচ্ছতায় যে বিপুল অর্থক্ষরণ ঘটে তাতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে যাওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা কঠিন হচ্ছে।

দেশে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর সংখ্যা কমছে, সার্বিক দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে কিন্তু এ অবস্থার বিপরীতে বিপুল ব্যয়ে (বিদেশীসহ) সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছাপানো নিম্নমানের (দায়িত্বশীলতার সাথে যথা সম্পাদিত না হওয়ায় তথ্য-উপাত্ত পাঠ্য ভুলভালে ভরা এবং নিম্নমানে মুদ্রিত) বই ধনী-দরিদ্র সব শিক্ষার্থীকে ‘বিনামূল্যে’ সরবরাহের যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয় না। শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় কার্যকর মনোযোগ দিতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ ব্যতিরেকে পাবলিক ফান্ড থেকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার সব শিক্ষকের পূর্ণ বেতন দিয়েও গুণগত শিক্ষাদানে জবাবদিহির আওতায় আনতে না পারাটা মূলত মানবসম্পদ উন্নয়নে অবহেলা ও অমনোযোগিতারই নামান্তর।

বাংলাদেশের মতো জনবহুল, স্বল্প কৃষিজমি, বেকারের ভারে ন্যুব্জ, অতি আমদানিনির্ভর অর্থনীতিতে শ্রমঘননির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নকারী ও প্রযুক্তিবাহী বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ দেশে বিগত পাঁচ দশকে আসা বৈদেশিক বিনিয়োগের স্থিতিপত্র কষলে দেখা যায়, সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ সূত্রে বৈদেশিক মুদ্রা ততটা আসেনি; যতটা দেশী মুদ্রায় অর্জিত মুনাফা বরং বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে (যেমন টেলিকম ও ধূমপান সেক্টরে) যাচ্ছে। লক্ষণীয় যে, এ দু’টি খাতই রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। দেশে আসেনি বা বিকাশমান হয়নি তেমন কোনো শ্রমঘন শিল্প। বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিকরা যখন অধিক অর্থ ব্যয় করে (বণিক বার্তায় প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন) স্বল্প মজুরিতে বিদেশ গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মানবেতর জীবনযাপন করছেন এবং দেশে শিক্ষিত বেকারের মিছিল যখন দ্রুত বাড়ছে, তখন এ দেশে স্টেট অব আর্টে চালিত কিছু বিদেশী শিল্প (যেমনÑ সিমেন্ট, সিগারেট, টেলিকম, প্রসাধন, আর্থিক ও শিপিং) গড়ে উঠছে আর গার্মেন্টসহ প্রায় সব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে মধ্য ও উচ্চপর্যায়ে বিদেশীদেরই মোটা বেতনে অধিক কর্মসংস্থান হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে বিদেশীরা বছরে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার (সাত বছর আগের হিসাব) বেতন, পারিশ্রমিক বাবদ নিয়ে যাচ্ছেন (ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২১ এপ্রিল-২০১৫)। দুর্ভাগ্যের বিষয় দেশে রেমিট্যান্স আসছে অধিক অর্থ ব্যয় করে বিদেশে যাওয়া অদক্ষ শ্রমিকদের কাছ থেকে। সেকেন্ড হোম কিংবা মেধা পাচার হয়ে যাওয়া শিক্ষিত, পেশাজীবীদের কাছ থেকে অর্থনীতি তেমন কোনো প্রত্যাবাসন পায় না। তারা দেশী পুঁজি বা মুদ্রা বরং বিদেশে নিয়ে যান। আবার অন্য দিকে দেশে প্রত্যাবাসিত অর্থের টাকা রিজার্ভে বিনিয়োগ ব্যতিরেকে অলস পড়ে থাকছে। অলস রিজার্ভের ‘প্রশান্তিবোধ’ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় সচেতনতায় শৈথিল্য আনে, ব্যাপক পরিমাণে কঠিন শর্তের বিদেশী ঋণ গ্রহণের আগ্রহ ও সুযোগ সৃষ্টি করে। এভাবে ঋণভারে জর্জরিত অনেক সম্ভাবনাময় অর্থনীতি পরবর্তীতে বিপাকে পড়েছে এ উদাহরণ আছে।

একটি বৃহৎ দেশ ও অর্থনীতির পেটের মধ্যে, ৯২ শতাংশ উন্মুুক্ত সীমান্ত পরিবেষ্টিত ছোট একটি দেশের সীমান্ত বাণিজ্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করতেই পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশেষ করে বহির্বাণিজ্য ইনফরমাল ট্রেড আর অসমর্থিত বাণিজ্য বিনিময়-বিনিয়োগ-তাড়িত, শাসিত, শোষিত। এটি বাস্তবতা । যেকোনো স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের উন্নয়ন অভিমুখী অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী হতে পদে পদে আত্মস্বার্থসচেতন ও চেষ্টিত হওয়ার বিকল্প নেই। উৎসবের অর্থনীতির এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবেশী দেশ থেকে বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের শুধু প্রাণিসম্পদ আমদানি হলেও তার বেশির ভাগ লেনদেন চলে হুন্ডি বা অসমর্থিত ব্যবস্থায়। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা হলো বাংলাদেশে আমদানিকৃত ওই সব পশুর কাঁচা চামড়া সীমান্ত বিনিময় বাণিজ্যে পাচার হয়ে যায়। নিজস্ব পরিবহনে হজযাত্রীদের পরিবহন করতে না পারায় বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় হাতছাড়া হয়ে যায়। এসব বিষয়ের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিকারমুখী সংস্কার ব্যবস্থাপনা অত্যাবশ্যক হবে মধ্যম আয়ের দেশের পথে হাঁটতে হলে।

গত ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষের প্রথম দিবস পয়লা বৈশাখ উদযাপিত হলো সাড়ম্বরে। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ধারক ও বাহক এই নববর্ষের উৎসব শুধু ১২ মাসের ১৩ পার্বণের অন্যতমটি নয়Ñ এর সাথে সমসাময়িক আর্থসামাজিক জীবনযাত্রার চালচিত্রের পরিচয় বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিনটির উদযাপনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। পয়লা বৈশাখ যেন নির্ভেজাল নির্ভার নিরাপদ আনন্দে শুরু হতে পারে, সে কারণে সংবছরের যাবতীয় লেনদেন বোঝাপড়ার সালতামামি, আগের বছরের শেষের হিসাব কিতাব মেলানোর মধ্যে নতুন বছরের যাত্রার বেগ ও মাত্রা নির্ভর করে। শুচি শুভ্র অবয়বে, মনের সব ক্ষোভ খেদ, বেদনা ও বিমর্ষভাব কাটিয়ে আনন্দ উৎসবে নতুন বছরকে নতুন দিনে বরণ করাই উদ্দেশ্য।

পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এবারের হালখাতা উৎসব তেমন জমেনি, বাড়েনি হালখাতা (হিসাব রাখার নতুন খাতা) ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণ। নববর্ষ উদযাপনে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে (অধিকাংশই অনুৎপাদনশীল খাতে) কর্মকাণ্ড বাড়ার কথা ছিল; যা দেখে সংবাদমাধ্যমের কাছে মনে হয়েছিল অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে। মনে হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মানুষের মধ্যে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আবহমান উৎসবে মানুষের অংশগ্রহণের মাত্রা বাজারে বৈকি, সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সে চাঞ্চল্যে নিতান্ত নানাবিধ ব্যয়ের উৎসবে কিছুটা মাতামাতি বেড়েছে বৈকি । কিন্তু পণ্য ও সেবা উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি চাহিদা অনুযায়ী না বাড়ায় সরবরাহে কিছু ক্ষেত্রে বড় বৈসাদৃশ্য ও বেমানান বাড়াবাড়িতে সমাজ ও অর্থনীতির দৈন্য ও দুর্দশা ফুটে উঠেছে।

প্রভূত পরিসংখ্যান, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটও পটভূমিতে আজ এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে দূরত্ব বাড়ছে অনেক ক্ষেত্রে-সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের ও নাগরিকের মধ্যে, করদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে, শিল্পমালিক ও শ্রমিকের মধ্যে, নীতিনির্ধারকের সাথে পোষণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, উপৎপাদনকারীর সাথে খুচরা ক্রেতার, ব্যাংকের আমানতকারীদের সাথে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার, সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাশার সাথে আর্থিক খরচে কর্মনৈপুণ্যের, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যয় ব্যবস্থাপনার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর সাথে সাধারণ মানুষের। সমাজে অনেক অপ-ক্ষেত্রে অপব্যয়ের জৌলুসের চাকচিক্যের ডামাডোলকে মনে হতেই পারে এটি পুঁজিবাদী মানসিকতা প্রস্তুত এবং বৈষম্যবিলাসী উদাসীন ঊর্ধ্বতনদের ইচ্ছা ও অভিলাষ উৎসারিত। এ অগ্রগতি গুণগতমান উন্নয়ন ব্যতিরেকে শিক্ষায় পাসের হার বৃদ্ধির মতো সাময়িক তৃপ্তিলাভের অগ্রগতি মনে হতে পারে- ভূত ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত করে নয়- সাময়িকভাবে, নিজেদের মতো করে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সীমিতভাবে সীমাবদ্ধকরণের প্রয়াস উৎসারিত। অর্থনৈতিক বৈষম্য বিভাজন থেকে মুক্তির সংগ্রামে জয়ী একটি স্বাধীন-সার্বভৌম অর্থনীতির প্রাণবায়ু যে জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও ন্যায়নীতি নির্ভরতা, নৈতিক মনোবল ও মূল্যবোধ তার সার্বিক অবস্থান ও উপস্থিতি আপাত প্রাণচাঞ্চল্যে ফিরে আসা অবয়বে উৎসাহিতবোধ করা চলে না। সেগুলো ক্রমেই নির্বাসনে পাঠিয়ে সাময়িক এ প্রগলভতায় সমাজ প্রকৃতপক্ষে এগোচ্ছে না পেছাচ্ছে তার একটা সালতামামি প্রয়োজন।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement