২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শোপেনহাওয়ারের দুঃখ ও ইচ্ছা বনাম ক্ষমতানেশা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

অস্বচ্ছ, ধূসর আর খসখসে মোজাইক করা ছবির সাথে আমাদের জীবনের ঘটনাগুলোর মিল রয়েছে। কিন্তু কাছে থেকে তা দেখা যায় না। ঘটনাগুলোকে ভালোভাবে দেখার জন্য অবশ্যই দূর থেকে দেখতে হবে। কথাটি আর্থার শোপেনহাওয়ারের। তিনি জীবনকে দেখেছিলেন দূর থেকে, কাছ থেকেও। শেকসপিয়রকে ধার করে তিনি বলতেন, নিজের চিন্তাটা নিজেই করার কথা। সমকালীনদের সমালোচনায় তার বক্তব্য হলোÑ ওরা অন্য দেশ দেখতে চেয়ে নিজের দেশটি আর দেখতে পারে না। কারণ অন্যদের মতো হতে গিয়ে আমরা আমাদের ৪ ভাগের ৩ ভাগই হারিয়ে ফেলি।

শুধু শেখা আর মুখস্থ করার মধ্যে তিনি দেখতেন মেধার অপচয়। বলতেন, অবিরাম শিখনপ্রক্রিয়া মস্তিষ্ককে হালকা করে ফেলে। ফলে নিজস্ব চিন্তা সৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, সেখানে স্থান করে নেয় কারো বই থেকে পাওয়া চিন্তা। অতএব জীবনভর পড়ে যাওয়াতে তার অমত ছিল। তিনি বলেছিলেন, জীবনের প্রথম ৪০ বছর আমাদেরকে সরবরাহ করে পাঠ, পরের ৩০ বছর আমাদেরকে সরবরাহ করে মতামত।

পাঠে ও মতামতে শোপেনহাওয়ার ছিলেন স্বতন্ত্র। জার্মান এই দার্শনিকের জন্ম ১৭৮৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বালকবেলা থেকেই আলাদা হবেন বলে বড় হচ্ছিলেন তিনি। প্রথাগত পড়াশোনায় মন ছিল না আদৌ। মেডিক্যালের ছাত্র হিসেবে ১৮১১ সালে ভর্তি হয়েছিলেন গোটিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এতে সায় এলো না ভেতর থেকে। ভাবলেন দর্শন পড়বেন। চলে গেলেন বার্লিনে। স্থির করেন একজন দার্শনিকের জন্য বিজ্ঞান জানা প্রয়োজনীয়। বার্লিনে তিনি দর্শনের চেয়ে বিজ্ঞানের লেকচারে অধিক অংশগ্রহণ করেন। দার্শনিক ইয়োহান গটলিব ফিকটের লেকচারে অংশ নিতেন যদিও, কিন্তু অচিরেই শিক্ষকের সাথে ভিন্নমত দেখা দেয় শোপেনহাওয়ারের। তার লেকচারগুলো মনে হতে থাকে বিরক্তিকর, দুর্বোধ্য। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, বাঁশি বাজানো ইত্যাদিই বরং মনে হতো উপাদেয়। প্রসিদ্ধ প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মতত্ত¡বিদ ফ্রিডরিশ শ্লেইয়ারমেখারের বক্তৃতাতেও তিনি অংশগ্রহণ করেন। তাকেও তিনি খুব দ্রæত অপছন্দ করতে শুরু করেন। শ্লেইয়ারমেখারের বক্তৃতার ওপর তার টীকা ও মন্তব্যে দেখা যায়Ñ শোপনহাওয়ার ধর্মের প্রশ্নে হয়ে ওঠেন খুবই সমালোচনামুখর। নাস্তিকতার দিকে ঝুঁঁকে পড়েন। তিনি নিজে নিজেই পড়ে শিখতে শুরু করেন। প্লেটো, কান্ট ও ফিকটের পাশাপাশি তিনি শেলিং, ফ্রিস, জ্যাকবি, বেকন, লক ও অন্যান্য সমকালীন বৈজ্ঞানিক সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি, ইতালি ইত্যাদিতে বিক্ষিপ্ত ছিল তার ভ্রমণ-অধ্যয়ন।

শোপেনহাওয়ারের পরিবারে ছিল জটিলতা। মা-বাবার সম্পর্ক ছিল ভঙ্গুর। পারিবারিক অশান্তি তার বাবাকে পরিবারে থাকতে দেয়নি। বদমেজাজি, উগ্র স্বাধীনতাপ্রিয় ও অবাধ প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন শোপেনহাওয়ারের মা। নিজের বাসভবনে তিনি বিভিন্ন পুরুষের সাথে থাকতেন। তবে এসবের মধ্যে তার একটিমাত্র ভালো গুণ ছিল, তা হলোÑ তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান একজন লেখিকা। শোপেনহাওয়ারের বাবার ছিল ডিপ্রেশন ও অ্যাংজাইটির মতো কিছু মানসিক সমস্যা। কিন্তু স্ত্রীর এরকম চরিত্রের কারণে তিনি বিধ্বস্ত ছিলেন সবচেয়ে বেশি। বোধহয় স্ত্রীর কারণেই শোপেনহাওয়ারের বাবা হাইনরিখ শোপেনহাওয়ার ১৮০৫ সাল জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন। তরুণ দার্শনিকের বোহেমিয়ান মন এসবের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তার মা সহ্য করতে পারতেন না তার প্রতিভা। মা-ছেলের বনিবনা হয়নি। ছেলেকে তিনি তাড়িয়ে দেন ঘর থেকে।

১৮১৮ সালে প্রকাশিত হয় শোপেনহাওয়ারের প্রধান বই ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড আইডিয়া’ মোটেও জনপ্রিয় হয়নি বইটি। প্রকাশক লোকসানের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৬ বছরেও তার প্রথম সংস্করণ শেষ না হওয়ায় তিনি শেষ পর্যন্ত তা সের দরে বিক্রি করা শুরু করলেন। কিন্তু শোপেনহাওয়ার তাতে বিচলিত ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, পাঠকরা এ বইয়ের যোগ্য নয়, তারা বুঝতে পারেনি বইটির ঔৎকর্ষ। ১৮৪৪ সালে তিনি প্রকাশককে গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য রাজি করান। এর কয়েক বছর পর তিনি বইটির জন্য দীর্ঘ প্রত্যাশিত স্বীকৃতি পেতে শুরু করেন।

১৮২০ সালে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে চাকরির অফার দিয়েছিল। তিনি রাজি হয়ে গেলেন এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাইভেটডোজেন্ট (চৎরাধঃফড়ুবহঃ) নিযুক্ত হলেন। কিন্তু দর্শনের অধ্যাপক হেগেল হলেন তার সহকর্মী। হেগেল সেখানে ছিলেন খ্যাতির শিখরে। শোপেনহাওয়ার হেগেলের সমালোচনা করতেন তুমুল। তার শ্রেণিকক্ষ হয়ে পড়ত ছাত্রশূন্য। কিন্তু সমালোচনার উদ্যম কমেনি তার। নিজেকে সেখানে অনাদর ও করুণার শিকার মনে করলেন তিনি, উপেক্ষিত হওয়া তার ধাতে সইবে কেন? তাই বার্লিন থেকে চলে যাওয়া ছিল অবধারিত। এরই মধ্যে ১৮৩১ সালে বার্লিনে মহামারী আকারে কলেরা দেখা দিলো। শোপেনহাওয়ার ও হেগেল উভয়েই বার্লিন ত্যাগ করেন। মহামারী শেষ না হতেই হেগেল বার্লিনে ফিরে এসে কলেরায় আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু শোপেনহাওয়ার ফিরে আসেননি। ১৮৩১ সাল থেকে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যামমেন নগরে নির্জনবাস শুরু করেন।

দুঃখ কিভাবে জড়িয়ে ছিল তার জীবনে, সেটি লক্ষণীয়। বার্লিন ছেড়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট অ্যামমেনে চলে গিয়ে খুব বন্ধুহীন, অত্যধিক বিষাদময় যে জীবন তিনি যাপন করেন, তা ছিল বিস্ময়কর। থাকতেন বিষণœতায়। যেন বিষণœতাই ছিল তার খাবার, পানীয়। বেশি কথাবার্তা অপছন্দ করতেন। মানুষকে এড়িয়ে চলতেন এবং তাদের বিশ্বাস করেননি। তার একমাত্র সঙ্গী ছিল এক কুকুর, যার নাম ছিল আত্মা বা বিশ্বাত্মা। দুষ্টু লোকেরা বিদ্রƒপ করে এর নাম দিয়েছিল তরুণ শোপেনহাওয়ার। তার নির্জনতার আরেক সঙ্গী ছিল বাঁশি, যা তিনি বাজাতেন সুন্দর করে, রাতে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি, লম্বা পাইপে ধূমপান আর লন্ডন টাইমস পত্রিকা পাঠ ছাড়া সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তার বিশেষ দিক। জীবনের শেষ দিকে একটি আবাসিক হোটেলের দু’টি রুম ভাড়া করে থাকতেন, খেতেন হোটেলে।

মানুষের মধ্যে তিনি দেখতেন একটি বন্যপ্রাণী, যে আবেগে পূর্ণ, সে একেবারে পশু, কিন্তু সভ্যতার লাগাম দ্বারা আটকে থাকে। সমাজ ও নারীকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। তার জীবনে এসেছিল এক নারী, সে শোপেনহাওয়ারের সংবেদনশীল মনকে করে তুলেছিল তিক্ত, রক্তাক্ত। সেই নারী অন্য এক যুবকের প্রেমে নিজেকে সঁপে দেন এবং দার্শনিককে ছেড়ে যান একা। তার পর থেকে শোপেনহাওয়ার একজন নারীর মধ্যে কেবল পাপ, পাপ ও পাপ দেখতে লাগলেন। সব নারীকেই তিনি শনাক্ত করেন বোকামি ও প্রবৃত্তির দ্বারা।

একান্ত নিজের আদলে জীবনকে তিনি দেখেন। চিন্তায় ছিলেন দুঃখবাদী। জগতকে দেখতেন অবিশ্বাসের চোখে, জীবন সম্পর্কে ছিল হতাশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। দার্শনিক হিসেবে তিনি ছিলেন নৈরাশ্যবাদী। মানবজীবন তার চোখে অর্থহীন আর বিদ্যমান জগৎ হলো সবচেয়ে খারাপ বিশ্ব। পৃথিবী মূলত কয়লা দিয়ে বিছিয়ে দেয়া একটি ক্ষেত্র, যার ওপর দিয়ে অতিক্রম করে মানুষের জীবন, যাকে মাড়িয়ে চলার নাম জীবনযাত্রা। আর্থার শোপেনহাওয়ার দেখেন সুখের অস্তিত্ব নেই। কেননা মানুষের অপূর্ণ ইচ্ছা মানুষকে নিরন্তর আঘাত করে। ফলে সে থাকে শূন্যতা, বেদনা, অপ্রাপ্তি ও অস্থিরতার দংশনে কাতর। তার মধ্যে জন্ম নেয় নব নব ইচ্ছা। ইচ্ছা প্রত্যহ জন্ম নেয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না প্রত্যহ। যদি ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়িত হতে থাকে, ঠিক তার ইচ্ছের মতো করে; তা হলেই মানুষ উপলব্ধি করে তৃপ্তি। কিন্তু তা খুব কমই আসে জীবনে কিংবা আসেই না। মানুষ তাড়া করে নিজ লক্ষ্যকে। কিন্তু লক্ষ্য জিনিসটাই অর্থহীন। তাকে তুলনা করা যায় সাবানের বুদবুদের সাথে। বড় আকারে স্ফীত হলে, লক্ষ্যটি কেবল ফেটে যায়।

শোপেনহাওয়ার সেই বিজ্ঞানীদের সাথে তর্ক করেছিলেন যারা মানুষের জীবনে বুদ্ধিকে প্রথম স্থানে রেখেছেন। ‘মানুষকে বুদ্ধিমান জীব’ আখ্যাদানকারী অ্যারিস্টটলীয় সংজ্ঞাকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেন। ঘোষণা করেন, যুক্তি বুদ্ধি নয়, ইচ্ছাই জীবনের চালিকাশক্তি। জীবনের বেশির ভাগ, এমনকি সব ঘটনাই ইচ্ছার গোলাম। ইচ্ছাই হচ্ছে মানুষের মৌলিক নীতি। এই চিরন্তন পদার্থটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, এটি অদৃশ্য হতে পারে না এবং পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ধারণ করে এই ইচ্ছাই। এমনকি জগতের মূলে রয়েছে এক অবশ্যম্ভাবী ও অকৃত্রিম ইচ্ছাÑ যে ইচ্ছা উদ্দেশ্যহীন, অন্ধ, অবৌদ্ধিক আর পরাক্রমশালী। ইচ্ছাই সব কিছুর সহজাত ভীত, ইচ্ছা অদম্য আর সব কর্মধারার কেন্দ্রবিন্দু।

তার মতে ইচ্ছাই (ডরষষ) আত্মা। সে হচ্ছে প্রকৃত পরমসত্তা, অন্ধ প্রেরণাদায়ক শক্তি। জীবনে সেই মূল গুরুত্বের দাবিদার। এ ইচ্ছার মাধ্যমেই আত্মার অন্যান্য মানসিক ক্রিয়াগুলো সমন্বিত ও পরিপুষ্ট হয়। আমরা বসবাস করি যে দৃশ্যমান বাস্তবতায়, তা আমাদের ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

জড়জগতের সব কিছুরও চালিকশক্তিকে তিনি ইচ্ছা বলে চিহ্নিত করেছেন। ইচ্ছা হচ্ছে সেই অন্ধশক্তি যা সব কিছুর মূল জীবনীশক্তি অথবা চালিকাশক্তি। মানুষের মধ্যে রয়েছে বেঁচে থাকার ইচ্ছা, অগ্রগতির ইচ্ছা এবং সর্বোপরি সুখী হওয়ার ইচ্ছা। এই ইচ্ছা একটি সহজাত প্রবৃত্তির মতো, অনেকটা আবশ্যিকভাবে আমাদের টেনে নিয়ে চলে জীবনের জটিলতার দিকে, সুখ চাওয়ার মতো বোকামির দিকে। এই সুখী জীবনের ইচ্ছাই আমাদের সবরকম শক্তি-সামর্থ্য ব্যয়ের মূলীভ‚ত কারণ।

তিনি কান্টের বিরোধিতা করে বলেন, আমাদের শরীর হচ্ছে একটা বস্তু, পৃথিবীর অন্যান্য বস্তুর মতোই। নিজেদের দেহকে আমরা দুই রকমভাবে দেখি। প্রথমত নিজেদের দেহকে ভাবি একটি বস্তু বা পদার্থ, যে পরিচালিত হয় প্রকৃতির অন্যান্য নিয়মের মতো। দ্বিতীয়ত, নিজেদের শরীরকে আমরা বুঝতে পারি নিজেদের ভেতরের সাক্ষাৎ চেতনার মাধ্যমে। চেতনা দিয়ে বুঝতে পারি; কারণ আমাদের দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসা, ব্যথা চেতনার সাহায্যেই অনুভ‚ত হয়।

ধরা যাক আমাদের হাতের কথা। অপারেশনের টেবিলে হাতটি রয়েছে। মনে হতে পারে সে এক দণ্ডমাত্র। কিন্তু সে তো লাঠি নয়, কাঠের টুকরো নয়, সে নয় মৃত। আমরা হাত ব্যবহার করি ইচ্ছানুযায়ী; ঘুরাই, কাজে লাগাই, লিখি অথবা প্রসারিত করে অন্যকে আলিঙ্গন করি। এর মানে হলো হাতকে দেখার দুই ভঙ্গি আছে। চেতনা দিয়ে তাকে না দেখা হলে হাতকে মনে হবে গোশত ও হাড়ের এক দণ্ডমাত্র। কিন্তু এতে আসল হাতের অর্থ ও গুরুত্ব গরহাজির থেকে যাবে। সত্যিকার অর্থে তাকে বুঝতে হলে চেতনা দিয়ে বুঝতে হবে।

মানুষ যে নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে, তা করে এই দ্বিমুখী (উড়ঁনষব-ধংঢ়বপঃ) প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে। ফলে শোপেনহাওয়ারের মতে, এই পৃথিবীর সব কিছু বুঝতে হবে এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং মনে রাখতে হবে এসব কিছুর মূলে আছে অন্তরালের দিক, যা হলো চেতনা বা ইচ্ছা।

এ অন্ধ ইচ্ছাশক্তিই ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তি চালিত হয় নানা রকমের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা। সব কিছুর চালিকাশক্তি হলো বেঁচে থাকার ইচ্ছা, যা থেকে জন্ম নেয় আকাক্সক্ষা। আকাক্সক্ষাকে সাময়িকভাবে সন্তুষ্ট করা যায়। কিন্তু একজন ব্যক্তি এতে সুখ অনুভব করতে সক্ষম হয় না। আকাক্সক্ষা তাকে ক্লান্ত ও বিরক্ত করে, একটির পরে আরেকটি নতুন আকাক্সক্ষা দেয় এবং যার শেষে আছে যন্ত্রণা।

কারণ ইচ্ছা যা চায়, তা পূরণ করতে না পারলে জীবনে নেমে আসে দুঃখ। জীবন হয়ে উঠে দুঃখে আচ্ছন্ন। ইচ্ছার প্রকৃতির মধ্যেই এমন কিছু নিহিত আছে, যার কারণে ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত জীবন সুখী হতে পারে না। আমাদের চাওয়া সমাপ্তি চায় না। একটি চাওয়া ডেকে আনে আরেকটি চাওয়াকে; আরো বহু চাওয়াকে। কেবল আরো চাই, আরো চাই। চাওয়ার এই বিরতিহীনতা দুঃখকে করে অবশ্যম্ভাবী। কারণ যে সুখের জন্য চাওয়া, সে নিজেই সুখকে বিতাড়িত করে দেয় নিজস্ব কারণে। মানুষ অসীম সত্তা নয়, কিন্তু তার চাওয়া সীমায়িত হতে রাজি নয়, সে সর্বদা পূর্ণতা চায়। অতএব এই জটিলতা ও বিপদ থেকে মুক্তি দরকার। কিন্তু মুক্তি কোথায়? শোপেনহাওয়ারের মতে, মুক্তির একমাত্র উপায় হলো ইচ্ছাকে দমন করা এবং লোভ-তৃষ্ণা, কামনা-বাসনার গ্রাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা। এখানে তিনি প্রবলভাবে গৌতম বুদ্ধের দর্শনে হন প্রভাবিত।

শোপেনহাওয়ার আমাদের দৃষ্টিকে নিয়ে যান ইচ্ছার সারসত্তায়। বাইরের প্রবণতা থেকে আমরা যেন ভেতরের অন্তর্গত কারণে প্রবেশ করি। তার মতে, সেটি হলো মূল চেতনা; ইচ্ছা। তিনি দেখান, একটি গরু, ছাগল বা বৃক্ষ। তার রয়েছে সহজাত প্রবৃত্তি। এর দ্বারাই সে পরিচালিত হয়। সে জানে না অন্তর্নিহিত মর্ম। সে বোঝে না কী ঘটছে এবং কেন ঘটছে। মানুষ কেবল বাহ্যিক প্রবণতার হাতে বন্দী নয়। তার আছে চেতনা, আছে আত্মসচেতন বুদ্ধি। ফলে সে বিচিত্রমুখী তাড়নায় আন্দোলিত হয়। লোভের শিকার হয়, মোহের কবলে পড়ে, লালসায় প্ররোচিত হয়। এগুলোর কবলে পড়ে সে সংশ্লিষ্ট ইচ্ছা পূরণ করতে চায়। শারীরিক পরিশ্রম করে, পরিকল্পনা সাজায়, উন্মাদের মতো চেষ্টা করে। নিজেকে উঁচু অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে বেশি আয় করতে হবে। সবচেয়ে সুন্দরী ও আকর্ষণীয় জীবনসঙ্গিনী পেতে হবে। সবচেয়ে উন্নত উপায়-উপকরণ হাতে থাকতে হবে। ভোগ করতে হবে সবচেয়ে বেশি। অর্জন করতে হবে ক্ষমতা। অন্যের ওপর তৈরি করতে হবে আধিপত্য। এসবের জন্য মানুষ সাধ্য-সাধনা করে নিজের ইচ্ছার আদেশে।

মানুষ যেহেতু ইচ্ছার দাস, তাই তার বুদ্ধিও ইচ্ছার দাস। নিজের ইচ্ছার অনুক‚লে সে যুক্তি সাজায়, বুদ্ধি প্রয়োগ করে। সে যা চায়, তার পক্ষে ব্যবহার করে যুক্তিকে। যা তার ইচ্ছা, সেখানেই তার স্বার্থ। স্বার্থের জন্য বা ইচ্ছার পক্ষে সে দার্শনিক পদ্ধতি অবলম্বন করে, আইনকে ব্যাখ্যা করে নিজের মতো, ধর্মকেও ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে চায়। সে এ জন্য খাড়া করে নানা তত্ত¡। তার তত্ত¡গুলো সবসময়ই তার ইচ্ছার পক্ষে কাজ করে। তার স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য লড়াই করে তার তত্ত¡, যুক্তি ও বুদ্ধি। অতএব যুক্তি বা বুদ্ধি হচ্ছে ইচ্ছার রাজত্বে নিয়োজিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যার কাজ হচ্ছে ইচ্ছার সপক্ষে ওকালতি করা, তার আনুক‚ল্যে মতামত তৈরি করা, তার প্রচার করা। নিজের স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য আপনাকে ব্যবহার করার জন্য যুক্তির ব্যবহার করে মানুষ। যখন যুক্তি দিয়ে হচ্ছে না, তখন আপনার ইচ্ছাকে প্রতারিত করতে চায়। আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকাকেও আপনি যুক্তি দিয়ে পটাতে ব্যর্থ হতে পারেন; কিন্তু তার ইচ্ছার সপক্ষে যখন কথা বলা শুরু করবেন, তখনই দেখবেন তার মন গলে গেছে। জনতার ওপর আধিপত্যকামী রাজনীতিক ও শাসকরা জনগণের সাথে বোধহয় সেটাই করে। তারা সবসময় পাবলিকের মনঃপূত কথাই বলতে চায়। পাবলিকের ইচ্ছাকে পটিয়ে মূলত নিশ্চিত করতে চায় তাদের ওপর নিজের আধিপত্যের ক্ষমতা। সে জন্য যুক্তি ও বুদ্ধিকে ব্যবহার করে কামলা হিসেবে। এ যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির লক্ষ্য সত্য নয়, গণস্বার্থ নয়, বরং আধিপত্যের ইচ্ছাপূরণ ও তার স্বার্থের পাহারাদারি নিশ্চিত করা।

কিন্তু এর ফল দুঃখের বৃদ্ধি ছাড়া আর কী হতে পারে? ক্ষমতা ও স্বার্থপূরণের নেশা এক শেষহীন লোভের চক্রে মানুষের ইচ্ছাকে করে দেয় বন্দী। ফলে এর লাগাম টানা জরুরি। হ
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement