২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সামাজিক জীবনে জাকাত

সামাজিক জীবনে জাকাত - প্রতীকী ছবি

ইসলাম একটি কল্যাণমুখী সুখী, সমৃদ্ধ ও ভারসাম্যমূলক সমাজের কথা বলে, সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা বলে, শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখে। হতদরিদ্র, অসচ্ছল ও ভিক্ষুকমুক্ত শিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণ করাই ইসলামের মুখ্য উদ্দেশ্য। জাকাত ইসলামের অন্যতম এক ভিত্তি। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে জাকাত অন্যতম।

দারিদ্র্যবিমোচনে সামাজিক ভারসাম্য তৈরিতে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আল্লাহ তায়ালা সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্যই জাকাতকে বাধ্যতামূলক করেছেন। এটা কোনো অনুদান নয়, এটা আল্লাহ প্রদত্ত অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর অধিকার। এ ছাড়াও ধনী এবং দরিদ্রের ভেতরকার সম্পর্ক যেন গভীরতর হয়, মানবিক মূল্যবোধ আরো উজ্জীবিত হয়, সমাজ যেন উৎপাদনমুখী অর্থনীতির ধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে- এ জন্যই জাকাতের ব্যবস্থা। অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুখী কিংবা সমৃদ্ধ সমাজ গঠনের প্রত্যয়ে নৈতিক মেলবন্ধন তৈরি করে। মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ ও গতিশীল সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আল্লাহর পথে ব্যয় করার জন্য যেমন উৎসাহ জোগায়, তেমনি ঈমানকে আরো প্রদীপ্ত করে থাকে। জাকাত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা রয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য জাকাত আদায় করো। অতঃপর তিনি তা দ্বিগুণ করে দেবেন।’ (সূরা আর-রুম,আয়াত-৩৯)

জাকাত আদায়ের ব্যাপারে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা: বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা জাকাত দেয়া ফরজ করেছেন যেন তোমাদের অবশিষ্ট সম্পদকে নির্দোষ বা নির্বিঘ্ন করে দিতে পারেন।’ (আবু দাউদ শরিফ)

ইসলামের সোনালি যুগের শাসনামলে জাকাত নেয়ার মতো লোক পাওয়া যেত না। শাসকরা জাকাতের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা রাখতেন। জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনা খোলাফায়ে রাশেদিনের শাসনামলে শোনা যায়নি। একটা শাড়ি কিংবা লুঙ্গির জন্য অসহায় মানুষকে বিত্তশালীর দরজার সামনে বসে থাকতে হতো না। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় যেখানে সুবিধা গ্রহণকারীকে নির্দিষ্ট হারে বিনিময় দিতে হয়, সেখানে জাকাতের অর্থনৈতিক ও কল্যাণমুখী সমাজে সুবিধা গ্রহণকারীকে কোনো বিনিময় দিতে হয় না। এটাই হলো পার্থক্য। জাকাতভিত্তিক অর্থনীতি সমাজের সুষম বণ্টনের নিশ্চয়তা দেয়। অভাবী জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলে। একটি ক্ষুধামুক্ত সমাজ গঠনের প্রয়াসে গৃহহীনদের গৃহের নিশ্চয়তা প্রদান করে। সামাজিক ভ্রাতৃত্ব বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। সরকার আশ্রয়হীনদের জন্য গৃহায়নের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। গৃহায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারকে বিশাল অর্থনীতির দায় বহন করতে হচ্ছে। অথচ জাকাত সংগ্রহ এবং ব্যবহারের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা দেশে থাকলে এর মাধ্যমেই কাজটা সম্পন্ন করা যেত। এ ব্যাপারে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নিয়ে কাজ করা যায় কি না সরকার চিন্তাভাবনা করতে পারে।

দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের দুস্থদের অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করা জাকাতের অন্যতম কাজ বা উদ্দেশ্য। সামাজিক কল্যাণের মৌলিক লক্ষ্যকে সামনে না রেখে ব্যক্তিগতভাবে সীমিত পরিসরে জাকাতের নামে কাপড় বা অন্যান্য দ্রব্য বিতরণে জাকাতের মৌলিক উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করা হচ্ছে। যারা জাকাত দেন এ ব্যাপারে তাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জাকাত দেয়ার পরও প্রতি বছরই দেশে দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ভাসমান গৃহহীন জনগোষ্ঠী। প্রতি বছর একই জায়গায় একই ব্যক্তিকে জাকাতের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত অবমাননাকর। এতে কিন্তু জাকাতের উদ্দেশ্য অর্জিত হয় না। পরিকল্পিতভাবে প্রতি বছর একজন বা দুইজন অসচ্ছল ব্যক্তিকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। জাকাতের সাহায্যে ব্যবহারিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। এর মাধ্যমে এতিম, ভাসমান ও পথশিশুদের জীবনকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। জাকাতের কল্যাণমুখিতা যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রে পরিস্ফুটিত হওয়ার কথা তার প্রতিফলন আমরা দেখছি না। এর কারণ হচ্ছে সামষ্টিকভাবে,পরিকল্পিতভাবে জাকাত আদায় এবং বিতরণের ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। জাকাতের সার্বিক কল্যাণ পেতে হলে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র্যবিমোচন এবং শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা সম্বলিত জাকাতের সদ্ব্যবহার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে যারা জাকাত দিচ্ছেন, আশা করি তারা ভেবে দেখবেন।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

Email- shah.b.islam@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement