২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

আর্থসামাজিক-সংস্কৃতি বিবর্তনের ধারায় ভার্চুয়াল সংস্কৃতির স্বরূপ

আর্থসামাজিক-সংস্কৃতি বিবর্তনের ধারায় ভার্চুয়াল সংস্কৃতির স্বরূপ - আর্থসামাজিক-সংস্কৃতি বিবর্তনের ধারায় ভার্চুয়াল সংস্কৃতির স্বরূপ

করোনার নিজের নামসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে অনেক স্বনামধন্য শব্দ খতিয়ান পর্চায় যেভাবে তাদের পরিচয় ছিল তা কেমন যেন ভিন্নরূপে প্রকাশ পাচ্ছে। ভাইরাসকে ব্যাকটেরিয়ার সাথে প্যাঁচানো হচ্ছে। ভাইরাস সম্পর্কিত বিষয় প্রকাশই ‘ভাইরাল’ হওয়ার কথা থাকলেও আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু ছড়ানো বা রটানো ‘ভাইরাল’ হয়ে যাচ্ছে, অনলাইনে সভা সমিতি সেমিনার করাকে ‘ভার্চুয়াল’ এবং ওয়েবে সেমিনারকে কাটছাঁট করে ‘ওয়েবিনার’ বলার চল চালু হয়েছে। মেনু বলতে সবাই এখনো খাবার দাবার মনে করলেও এখন সেটিকে সফটওয়ার হার্ডওয়ারের ব্যঞ্জন ভাবা হচ্ছে। যেকোনো শব্দের আঞ্চলিক মর্মার্থ বৈশ্বিক পরিসরে গিয়ে জাতকুল মান খোয়াতে বসেছে। এই সমতটে ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘মৌলবাদ’, ‘গণতন্ত্র’, ‘আমলাতন্ত্র’, ‘চেতনা’, ‘রাজনীতি’, ‘মুক্তবাজার’ প্রভৃতি শব্দের মূল মর্মার্থ স্থান-কাল-পাত্রের ভেদাভেদে এমন রূপ পরিগ্রহ করছে যে এই সাতশব্দ নিজেরাই এখন মুক্তবুদ্ধি শুনানিতে অংশ নিতে আপিল আবদার জানাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মশহুর অক্সফোর্ড অভিধানে ‘ভার্চুয়াল’ শব্দের মর্মার্থ ‘সশরীরে উপস্থিত না থেকেও দূরাভাষে দূর থেকে দর্শন দিয়ে (দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানোর মতো হলেও চলত) কোনো কিছুতে অংশ নেয়া’ এমনই আছে; যদিও ‘গুণবাচক’, ‘মর্যাদা’ ও ‘মহত্বের’ প্রকাশক ‘ভার্চু’ ধাতুমূল থেকে এটির উৎপত্তি। করোনা আসার আগে এ ধরনের দূরাভাষ দূরালাপ দূরদর্শন কমবেশি চলতে শুরু করেছিল। কিন্তু করোনাকালে অনলাইনে ভার্চুয়াল আলাপ আলাপন দূর থেকে দেখা সাক্ষাৎ এখন যেন মৌরশী পাট্টায় পরিণত হয়েছে। ভার্চুয়াল মিটিং সিটিংকে (ইটিং বাদে) এখন বেশ সহজসাধ্য উপায় উপলক্ষ ভাবা হচ্ছে। সভা আয়োজনে যোগদানে সমাপনে ঝামেলা ঝক্কি কমে যাচ্ছে, সময় বেঁচে যাচ্ছে, নাশতা খরচ, মধ্যাহ্ন কিংবা নৈশ্যভোজের বিপুল ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। সামাজিক মেলামেশা খোশগল্প রাজা উজির মারার স্বভাবগুলো সামনাসামনি হওয়ার অভাবে, অবর্তমানে মাঠে মারা যাচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টির এমন মহৎ উপায় করোনার বদৌলতেই। তবে এর দোষগুণ খোঁজার আনজাম আয়োজন এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রনাথ তার আশিতম জন্মদিনের প্রাক্কালে (১৩৪৮ এর পয়লা বৈশাখে) ‘সভ্যতার সঙ্কট’ শীর্ষক বক্তৃতায় যখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সুবিধা-অসুবিধার জাবেদা বইয়ে চোখ রাখছিলেন তখন তার গলায় হতাশা ও ক্ষোভের সুরই শোনা গিয়েছিল। ঠাকুর বাড়ির বড় কর্তারা ভেবেছিলেন সাতসাগর তেরো নদীর পার থেকে ভেসে আসা সভ্যতা ও সংস্কৃতির সুরের মাধুর্যে ভারতবর্ষের জ্ঞানবিজ্ঞানর্”ায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির অলিন্দে ধরা খেল, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’... ‘এই দুর্গতির রূপ যে প্রত্যহই ক্রমশ উৎকট হয়ে উঠেছে, সে যদি ভারতশাসনযন্ত্রের ঊর্ধ্বস্তরে কোনো-এক গোপন কেন্দ্রের প্রশ্রয়র দ্বারা পোষিত না হতো তা হলে কখনোই ভারত-ইতিহাসের এতবড় অপমানকর অসভ্য পরিণাম ঘটতে পারত না।’... ‘এই বিদেশীর সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কী অপহরণ করেছে তা জানি; সে তার পরিবর্তে দণ্ড হাতে স্থাপন করেছে যাকে নাম দিয়েছে ল অ্যান্ড ওর্ডার,বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র। পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিমানের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি। মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা এসব ভারতীয়ের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছে।’

আশি বছর আগে রবীন্দ্রনাথ সমকালীন সভ্যতার যে সঙ্কট শনাক্ত করতে পেরেছিলেন আজ এই ইলেকট্রনিক সংস্কৃতি-সভ্যতার পাদপীঠে করোনায় সম্মোহিত পরিবেশেও দেখি একই পরিস্থিতি- ‘এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভেতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবাত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কলুষিত করে দিয়েছে।’

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আসার আগে করোনা মানুষের জীবনী শক্তি, তার সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি হরণের ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়-দায়িত্ব নিয়ে এসেছে কি না এ সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। দুই পরাশক্তির ঠাণ্ডা যুদ্ধের গরম কড়াইয়ে ঘি ঢালার উপকরণ যে কোভিড ১৯ ওরফে করোনা এখন তা আর বুঝতে কারো বাকি নেই। করোনার প্রভাবে প্রযুক্তির উদগ্র উন্নয়নের ইতি কিংবা নেতিবাচকতার দিকেও তাকানোর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, অতি দ্রুত গ্রাস করছে মানবতার মূল্যবোধকে, ম্যান অ্যান্ড মেশিনের শ্রেষ্ঠত্বের যে লড়াই সামনে শুরু হবে সেখানে সমাজ বিচ্ছিন্ন, পরিবারচ্যুত, ভাবলেশহীন আত্মকেন্দ্রিক মানুষ কিভাবে সে লড়াইয়ে টিকে থাকবে তার সংশয় জাগছেই।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির প্রসার মানুষের লোভ লাগামহীন করে তুলেছে। মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা উৎসারিত লোভ ও আগ্রাসনই মানুষের মন্দ কাজের মূল। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যেখানে পরস্পরের সহযোগিতা সহ-অবস্থান করার কথা, সেই প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ বানাচ্ছে মানুষ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পরিবর্তে প্রকৃতিকে ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠছে। ক্ষমতালাভের হাতিয়ার হিসেবে মানুষ বিজ্ঞানকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যে, আজ তার নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রবল হচ্ছে। মারণাস্ত্র তৈরি করে তার বিক্রি বাড়াবার জন্য মানুষই যুদ্ধ বাধাচ্ছে মানুষের বিরুদ্ধে। পারমাণবিক অস্ত্র সঞ্চয় করে নিজের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে চলেছে। সবাইকে বুঝতে হবে, করোনার আগমন হয়েছে যুগ যুগ ধরে মানবতার অবমাননা, বৈষম্য, লোভ-লালসা, মিথ্যাবাদিতা ও অহমিকার যে পাপাচার বিশ্বকে গ্রাস করছিল তার প্রতিকারে বিশ্বময় একটি প্রবল ঝাঁকুনি দিতেই।

করোনার কারণে এই পরিবর্তিত চিন্তা ও দর্শনের আবর্তে, সংক্রমণ ও মৃত্যুর নানা আঘাতের আবর্তে প্রত্যেক মানুষ নতুন করে খুঁজে নিতে চেষ্টা করে আপন সত্তা ও অনুভবের ভূমিকে। নতুন করে সে নির্মাণ করে আত্মপরিচয়। যে মূল্যবোধের কারণে গ্রামীণ নারীটি বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েটি নিটোল, নিস্তরঙ্গ পবিত্র জীবনে অভ্যস্ত ছিল সে-ই হয়ে ওঠে বেপরোয়া ও সাহসী। অবাধে চলে আসা প্রযুক্তির প্রাকারে বন্দী সবাই আপন ভুবনে যেন না হয়ে হয়ে ওঠে পরবাসী। অভ্যস্ত যেন না হয়ে ওঠে অনিকেত জীবনে।

করোনা-উত্তর পরিবেশে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোতে নতুন নতুন আকাঙ্ক্ষা ও অভাবের জীবনে অধিকাংশ মানুষ হয়ে উঠতে পারে এমন নুড়িপাথর, যার কাছে শ্যাওলা ও শেকড়ের গন্ধময় হারানো জীবনটি বর্জ্য বৈ কিছুই নয়। লোভ ও ভোগের আবর্তে মানুষ যদি হারিয়ে ফেলে তার অনুসন্ধানের স্পৃহা, নিজের অজান্তে সে হয়ে উঠতে পারে ক্ষমতাবানদের ক্রীড়নক ও ভোগবাদী সমাজের পণ্য। করোনাকালে যেসব মানুষ ইতিবাচক চিন্তা ও বিশ্বাসের মাঝে মুক্তি খুঁজেছিল, তাদের কেউ কেউ যেন বিকৃত ও অসুস্থ চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়ে। সর্বোপরি প্রাধান্য যেন না পায় স্বার্থচিন্তা ও ভোগবাদ।

অতি দ্রুত ধাবমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যদি নীতিবাধ, ন্যায়নীতি নির্ভরতার উপায় উপলক্ষকে গ্রাস করতে উদ্যত হয় তা হলে সভ্যতার সঙ্কট বাড়বে বই কমবে না। ভার্চুয়াল সংস্কৃতি বড্ড দ্রুত এর বুদ্ধিবৃত্তিক ধীমান গতিকে বিপথগামী করছে। অনলাইন ব্যবসা লেনদেন প্রথম প্রথম চটক ও চমৎকারিত্বের সৃষ্টি করছে বটে কিন্তু প্রতারণার ফাঁকফোকর দিয়ে একদিন এর ইতিবাচকতাকে নেতিবাচক করে না তোলে সে জন্য সময় থাকতে সাবধানতার প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন। করোনাভাইরাস যেমন মূল্যবান মানবজীবন যাপনকে বিশ্বব্যাপী মহা আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, তেমনি ‘আই লাভ ইউ’, ‘মেলিসা’, ‘মাইডম’ ম্যালোয়ার ভাইরাসরা খোদ হার্ড ডিস্ককে দাফন কাফন ছাড়া কবরে পাঠাতে পারে। সুতরাং ডাটার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, ভেদবুদ্ধির বিগ্রহ এড়িয়ে ডাটার যথার্থ ও যথাযথ ব্যবহার বিষয়ে চ্যালেঞ্জ আসতেই থাকবে, তাই ডিজিটাল ওরফে অনলাইন ওরফে ভার্চুয়াল ওরফে ই-খাওয়াদাওয়া, ই-ঘোরাফেরা, ই-চিন্তাভাবনা, ই-স্বপ্ন সবই যেন যতদূর সম্ভব বাস্তবতার পাটাতনে, সাশ্রয়ী ও শ্রেয়োবোধের বিবেচনার মধ্যে থাকে সেটি লক্ষ রাখতে হবে। ঔষধ সেবন বিধি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন জ্ঞান না থাকলে, পথ্য অনুসরণে সতর্কতা না থাকলে শুধু চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার বাহাদুরিতে উপযুক্ত উপশম মিলবে না। হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কায় সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তার চেতনাকে জাগ্রত না রাখলে রবীন্দ্রনাথের মতো আশাহত হতে হবে, বাড়বে সামনে সভ্যতার সঙ্কট।

লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরএর সাবেক চেয়ারম্যান


আরো সংবাদ



premium cement