নির্বাচন কমিশন বার্তাগুলো কি বিবেচনায় নেবেন?
- সালাহউদ্দিন বাবর
- ১০ এপ্রিল ২০২২, ১৯:১০
নির্বাচন কমিশনের সাথে সম্প্রতি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, সুধী ও সুশীলসমাজ এবং বিশিষ্টজনদের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে সংলাপে আমন্ত্রিতদের অনেকেই অবশ্য গরহাজির ছিলেন। ধরে নেয়া যায়, এই গরহাজিরার মধ্যে ইসির জন্য একটি মেসেজ রয়েছে, যদি তারা বিষয়টি নিয়ে উপলব্ধির চেষ্টা করেন। বিষয়টি হয়তো এ রকম যে, আমন্ত্রিতদের মধ্যে যারা অনুপস্থিত ছিলেন, তারা বোধ করি ইসির সংলাপের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি, নতুন ইসি নিয়েও তাদের মধ্যে ততটা আস্থা বিশ্বাস জন্মেনি। এই ইসির পক্ষে ভবিষ্যতে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নিয়েও তাদের মধ্যে দোদুল্যমানতা বিরাজ করছে। যাই হোক, ইংরেজিতে একটা কথা রয়েছে ‘লাইভ অ্যান্ড ক্লিয়ার’; সংলাপে যেসব বিজ্ঞজন যোগ দিয়েছিলেন, তাদের সবাই কিছু কথা সজোরে ও পরিষ্কারভাবে ইসিকে যে বার্তা দিয়ে গেছেন, তাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য আছে। তা কি বিবেচনায় নিয়ে ইসি তার দায়িত্ব পালনকালে সেসব বিষয় অনুসরণ করে তথা সে পথে চলার চেষ্টা করবেন? তবে হয়তো দেশের মানুষ একটা কাক্সিক্ষত মানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ভাবা যায়। আর তাতে যে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে সেখানে দীর্ঘ দিন পর সত্যিকার জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে একটা কার্যকর প্রাণবন্ত পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু সাধারণের মনে এখন এমন একটা প্রশ্নের উদয় হয়েছে, সংলাপ দুই পক্ষের মধ্যে হয়, দুই পক্ষের মধ্যে কথা চালাচালি হয়। ইসি আহূত সব বৈঠকেই বলতে গেলে, আমন্ত্রিতরা কেবল কথা বলছেন, ইসি শুনছেন, এমনটাকে তো সংলাপ বলা চলে না। যেসব প্রশ্ন বৈঠকে উঠেছে তা নিয়ে কোনো জবাবই ইসির পক্ষ থেকে আসছে না। অথচ মানুষ তো ইসির কাছ থেকে জবাব, অঙ্গীকার ও অভয়ের বাণী শুনতে চায়। নির্বাচনের সময় ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না, ইভিএমের চাতুরীর অবসান ঘটবে কি না, ‘মধ্য রাতের ভোট’ আর আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কেবল নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন, ভোটের সময় ক্ষমতাধরদের কর্মী-সমর্থকদের প্রলয়নৃত্য থামবে কি না। ইসিকে কর্তৃত্ব করার যে অধিকার এবং ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার সেভাবে কাজ করা যে অধিকার সংবিধান বলে দিয়েছে, তার চর্চা, অনুশীলন করার মতো ‘কারেজ’ তারা দেখাবেন কি না। সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে, দায়িত্বে থেকে তাদের সরে আসা, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার পথে যত বাধার দুয়ারে আঘাত আনতে তারা সক্ষম হবেন কি না, এমন সব নজিরবিহীন ঘটনা আমরা অবলোকন করতে পারব বলে আশা করতে পারি কি না!
ইসি গঠন করা নিয়ে যে আইন প্রণীত হয়েছে, তাতে কোনো নতুনত্ব নেই। ইতঃপূর্বে ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় যে পন্থা অনুসৃৃত হয়েছে, তাকেই মূলত একটি আইনি কাঠামোয় রূপ দেয়া হয়েছে। আইনের আওতায় ইসি গঠন নিয়ে সেই আগের মতোই কিছু দুর্বলতা সঙ্গত কারণেই বিদ্যমান রয়েছে। তার একটি মাত্র উদাহরণ পেশ করে ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলব। নির্বাচন কমিশন-ইসি গঠন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে নামের তালিকা চাওয়ার বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। সোজা কথা, সার্চ কমিটি ইসি গঠনের জন্য নামের তালিকা প্রণয়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নামের তালিকা চাইতে পারবে। এখানেই বোদ্ধা সমাজের প্রশ্ন, রাজনৈতিক দলগুলো কি তাদের সমমনা লোকদের বাইরে থেকে কাউকে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে? বিগত দুই ইসি (রকিব-হুদা) গঠন করার সময়, ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী জোটের অন্যতম শরিক তরিকত ফেডারেশন যে তালিকা সার্চ কমিটির কাছে জমা দিয়েছিল, অবাক হওয়ার ব্যাপার- বিগত সময়ে দু’বারই তরিকতের দেয়া তালিকা থেকে চিফ ইলেকশন কমিশনার বেছে নেয়া হয়েছিল। এবার নয়া কমিশন গঠনের পর একটি বৃহৎ জাতীয় দৈনিকে এমন খবর ছিল, ‘বর্তমান কমিশনের প্রধান তথা সিইসিও তরিকতের জমা দেয়া তালিকা থেকে বেছে নেয়া হয়েছে।’ তরিকতের ভাগ্য বলতে হবে, এই নিয়ে তৃতীয়বার তারাই সিইসি বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করল। ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী জোটে ক্ষুদ্র এক শরিক তরিকত, তাই এটা খুব সহজেই বোধগম্য, জোটের প্রধান শরিকের জ্ঞাতসারেই তারা সার্চ কমিটির কাছে নামের তালিকা পেশ করেছে। সে ক্ষেত্রে এমন সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেয়া যায়, অতীতের দুই কমিশনের মতোই নতুন কমিশনের কাছ থেকে স্বাধীন ও ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা করা যেতে পারে কি?
এখন নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে মানুষের মৌলিক কিছু বিষয় জানার ও প্রতিশ্রুতি পাওয়ার বিষয় আছে। সেসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত কমিশন কোনো কথাই বলেনি।
এটি ঠিক, যারা কর্মে বিশ্বাসী তারা কম বলেন। এ কথা মেনে নেয়ার পরও এমনটা ভুলে গেলে চলবে না, বিগত দুই কমিশনের অধীনে যত নির্বাচন হয়েছে সেসবের ভোটের সময় দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ভবিষ্যতে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে কি? নির্বাচন কমিশন স্বপদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে সংবিধানের আলোকে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন। এখন সাধারণ মানুষ ও সুধী মহলের প্রশ্ন, সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে কমিশন তাদের ‘দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা কি তারা উচ্চকিত করে তুলতে পারবেন? তা ছাড়া দেশে-বিদেশের কমিশনের ভাবমর্যাদা যে তলানিতে পৌঁছেছে, তাকে কি তারা টেনে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেন যে, কোনো কিছু করতে পারুক আর না পারুক যেখানে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য হস্তক্ষেপ করতে এতটুকু দ্বিধা করে না। তাতে প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, জনগণের আকাক্সক্ষা ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার বড় ধরনের ব্যত্যয় ঘটলেও তাদের কিছু আসে যায় না। তাদের বিবেচনা, নিজেদের ষোলআনা রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় থাকলেই হলো। এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের বিবেচনা তারা কার আনুগত্য করবেন? যদি শেষোক্তকে বেছে নেন, তাতে অতীতের দুই কমিশনের (রকিব-হুদা) মতোই তাদের ভিন্নতা খুঁজে পাওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে যে নেতিবাচক অধ্যায় সূচিত হয়ে আছে, সেখানে ভিন্ন ধারার কোনো কিছু সংযোজিত হওয়ার আর কোনো অবকাশ থাকবে না। অথচ এটা স্মরণ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ নামক প্রজাতন্ত্রটি, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত। সেই সাথে এটাও যথার্থ, এই প্রজাতন্ত্রের শাসনতন্ত্র আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক চেতনায় সঞ্জীবিত।
তবে এ কথাও সত্য যে, ইংরেজিতে একটা কথা রয়েছে- ‘মিস হ্যান্ডলিং’ তথা ভুলভাবে ব্যবহৃত হওয়া। সংবিধানে যতই ইতিবাচক বিধিব্যবস্থা সন্নিবেশিত থাকুক না কেন, তার যদি যথাযথ অনুশীলন অনুসরণ করা না হয়, তবে সব কিছু ম্লান বিবর্ণ হয়ে পড়বে, এবং তা থেকে উত্তম কিছু পাওয়ার বিষয়টি সুদূরপরাহত হয়ে পড়বে? দেশে সুশাসনের পরিবর্তে অপশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে কল্যাণ পাওয়াটা আর সম্ভব হবে না। শুধু একটি উদাহরণ এখানে পেশ করছি। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে যত ত্রুটি বিচ্যুতি যা ঘটে আসছে তা আমাদের কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলবে। গ্রামগঞ্জে একটা কথা, কথায় কথায় ব্যবহৃত হয় সরিষার ভূত থাকলে সে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়ানো যায় না। গত ৫০ বছর যখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের কেউই সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সুচারুভাবে তাদের দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি যার পরিণতি আজকের যত অব্যবস্থা। সুষ্ঠু পদ্ধতির, নীতিনৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং সরকার রাষ্ট্রব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য যে জনকল্যাণ সেটি অনুসরণের জন্য তাগিদে গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই তেমন আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের এজেন্ডা ছিল ক্ষমতা পাওয়ার অহর্নিশ চেষ্টা। সে জন্য নীতিনৈতিক রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ কারো ধার ধারা হয়নি। সব চেষ্টা, কৌশল ছিল ক্ষমতা কব্জার যত স্বপ্ন।
কারো কারো প্রশ্ন হতে পারে, ৫০ বছরে কিছুই কি হয়নি? হ্যাঁ হয়েছে, শরীরের সব রক্ত শুষে মুখ মণ্ডলে নিয়ে আসা হয়েছে। তাতে শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সেটি তো সুস্বাস্থ্য বলা যাবে না। রাষ্ট্রীয় অন্যতম নীতি হিসেবে বর্ণিত হয় সুষম উন্নয়ন। সেটি কোথায়? হয়তো শহরের বাইরে ১০-২০টি রাস্তা হয়েছে, সে সড়ক ধুয়ে পানি খেলে তো পেট ভরবে না। এ রাস্তাগুলো হওয়ায় ফড়িয়াদের বরং বেশি উপকার হয়েছে, তারা দ্রুত ও কম খরচে গ্রামে উৎপাদিত পণ্য দ্রুত শহর নিয়ে আসতে পারছে। তাতে লাভ কার? ঢাকায় সব সময়ই শাকসবজির অগ্নিমূল্য; কিন্তু গ্রাম থেকে পানির দামে সবজি কিনে এনে সব সবজি ব্যবসায়ীরা রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে চার পাঁচ গুণ বেশি দরে সেসব পণ্য বিক্রি করে। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাই এসব অবস্থার কারণ। বলে এসেছি গ্রামাঞ্চলের কিছু সড়ক জনপদের কথা। সেই সাথে রাজধানীর কিছু অংশ উন্নয়নে কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করছি, এ জন্য যে, পরিকল্পনামন্ত্রী সম্প্রতি এক বৈঠকে বলেছেন, উন্নয়নের সাথে দুর্নীতির সম্পর্ক রয়েছে।
এসব নিয়ে এই মুহূর্তে কথা আর বাড়াব না। কেননা আমাদের নিবন্ধের লক্ষ্য হচ্ছে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে। আর কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে দেশের মানুষের কৌতূহল এখন যথেষ্ট। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা জানতে চান। গণতন্ত্র সম্পর্কে জনগণের অতীতের স্মৃতি খুবই বেদনাবিধুর, তা রোমন্থনে গেলে তাদের কষ্টের শেষ নেই- আজকের দুনিয়ায় যেখানে গণতন্ত্র চর্চা প্রায় চূড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে তা ব্যর্থ হওয়ার পথে। অথচ এই দেশের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, মানুষের মতামতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা।
বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে উপরে বলেছি, ইসি আহূত বৈঠকগুলোতে যোগদানকারী বিজ্ঞ সুধীজন, বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ও জাতীয় দৈনিকগুলোর সম্পাদকরা স্পষ্ট করে অনেক কথা বলেছেন। আমরা বলেছি, যদি নতুন ইসির কাছ থেকে যা মানুষ আশা করে, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনের ওপর সংবিধান দিয়ে রেখেছে, অর্পিত সে কর্তব্য তারা যদি নিষ্ঠার সাথে পালন করতে ব্রতী হন এসব বৈঠকের আদৌ কি প্রয়োজন, যৌক্তিকতা থাকে? তবে বাস্তবতা হলো, বিগত দুই কমিশন তাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সততা ন্যায়নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের উত্তরসূরি বর্তমান ইসির স্বয়ং প্রধানও অকপটে স্বীকার করেছেন সে কথা। তিনি প্রথম বৈঠকেই বলেছিলেন, এটা সত্য, নির্বাচন কমিশনকে আরো আস্থা অর্জন করতে হবে। তাহলে আমরা এটা কী আশা করব। নতুন কমিশন দায়িত্ব-কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন তথা জন-আকাক্সক্ষা পুরোপুরি বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে? তাদের দৃঢ়তার সাথে এই লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে যে, কমিশনের ভাবমর্যাদা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, এখন তার ওপর নয়া প্রাসাদ গড়তে হবে। সাহস ধৈর্য ধরে তাদের অগ্রসর হতে হবে, কারণ কাজটা সহজ নয়, ১০ বছর যে ‘ফ্রি স্টাইল’ভাবে চলেছে, সে পথটা বন্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ১০ বছর ফ্রি স্টাইলভাবে চলে যে আরাম-আয়েশ ভোগ করেছে, সে স্বর্গ থেকে তাদের বিদায় করার কার্যক্রমকে সহজে মেনে নেবে না; সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত এবং পদাঘাত করার চেষ্টা করবে।
দেশের মানুষ এখনো প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে ওঠেনি, তাই এই ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভোট দেয়া তাদের পক্ষে কঠিন। কারো সাহায্য নিতে হবে দেয়ার সময়, প্রথমত। এতে ভোটে গোপনীয় আর থাকবে না, দ্বিতীয়ত যারা ভোট দিতে সহায়তা করবেন, তারা দলবাজ হলে তবে তো সবই শেষ, কোথাকার ভোট কোথায় যাবে তা আর ভোট দানকারী কিছুই বুঝতে পারবেন না। তা ছাড়া আপাতত দেখা গেল ভোট গ্রহণ স্বাভাবিকই হলো; কিন্তু পূর্বাহ্নেই যদি প্রোগ্রাম করা থাকে তবে ক্লোজ বাটন চেপে কোনো একটি প্রতীকে অতিরিক্ত তিন-চার শত ভোট যোগ করা খুবই সম্ভব। তা ছাড়া ভোটকেন্দ্র দখল করা এ দেশে নতুন কিছুই নয়; তখন তো ঘটবে ‘হরিলুট’ অবস্থা, জনগণের জন্য বিপদের ব্যাপার, আর যারা রাজনীতির মতলববাজ, এতকাল ‘ফ্রি স্টাইল’ এ চলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাদের কাজে ‘ইভিএম’ জাদুবাক্স। তারা কি এই জাদুর বাক্স ‘হাতছাড়া’ করতে চাইবে? এমন অবস্থায় ইসি কি জনগণের পক্ষে থাকবেন, না যারা ইভিএমকে জাদুবাক্স ভাবেন তাদের পক্ষে যাবেন? মনে রাখতে হবে, ঘোড়ার আগে গাড়ি জোড়া ঠিক হবে না। একটু অপেক্ষা করুন, প্রযুক্তি নিয়ে মানুষের সক্ষমতা বাড়–ক, আর বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলও এই মুহূর্তে ইভিএমের বিপক্ষে। এখানে ইসিকে অবশ্যই গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। আর একটা বিষয় তাদের বিবেচনায় থাকতে হবে : ইভিএম নিয়ে যেসব প্রযুক্তিবিদ গবেষণা করেছেন, তাদের মতামত হচ্ছে, যেসব দেশে ইভিএম চালু হয়েছে, সেসব রাষ্ট্রের ৮৭ শতাংশ এর যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আগামীতে ইভিএম চালু রাখা সমীচীন হবে কি না।
আর একটা ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দল এখন সোচ্চার, আর সেটি হলো নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে ঈপ্সিত মানের নির্বাচন সম্ভব নয়। তার প্রমাণ বিগত দু’টি সংসদ নির্বাচন। পক্ষান্তরে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ এই চারটি সংসদ নির্বাচন হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, এর মধ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দু’টি করে নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। নির্বাচনে হেরে যাওয়া দল কিছু অনিয়মের অভিযোগ আনলেও সেসব নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে তেমন কোনো বিতর্ক ছিল না। ভোটাররা ভোট দানের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন ছিল দলীয় সরকার তথা আওয়ামী লীগের অধীনে। ওই দুই নির্বাচন নিয়ে জনগণ ছিল ক্ষুব্ধ। সর্বত্র সেই দুই নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল চরম বিতর্ক। তাই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। কোনো কোনো মহল ভারতের উদাহরণ টেনে বলে থাকে, ভারতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়ে থাকে এবং ঠিকঠাক মতো তথা সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে। এতে কিন্তু প্রকৃত সত্যটি এখানে আড়াল করা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওপর সরকারের কোনো ধরনের প্রভাব থাকে না। আর সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠাবান। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের নির্বাচন কমিশনের ওপর ক্ষমতাসীনরা সব ধরনের প্রভাব বিস্তার করে, আর রাজনৈতিক দলগুলো ভোটের কারচুপিতে পটু। কিন্তু সমস্যা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে ইসির কিছু করার নেই। প্রশ্নটি যেহেতু রাজনৈতিক, তাই তার নিষ্পত্তি রাজনৈতিক দলকেই করতে হবে। এ জন্য সব দলকে তা সে ক্ষমতাসীন হোক বা ক্ষমতার বাইরে থাকুক গণতন্ত্রের স্বার্থে, সুষ্ঠু ভোটের জন্য এবং জন-আকাক্সক্ষা পূরণ করার জন্য সবাইকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে গণতন্ত্রের বিজয় তোরণ নির্মাণের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে। দেশে একটা সুন্দর পরিবেশে নির্বাচন হোক সবার এমন সদিচ্ছা, জনগণ কামনা করে। সব কিছুকে নেতিবাচক ভাবা কারো জন্য সঠিক নয়। সবাই গণতন্ত্রের পথকে মসৃণ করার ক্ষেত্রে উদার চিত্তের পরিচয় দিতে হবে।
গণতন্ত্রের চর্চা যদি সঠিক পথে চলতে শুরু করে তাহলে ব্যক্তি, সমাজ সংগঠন ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতিশীলতা আসবে। একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ গঠিত হলে, সেখানে বুদ্ধিভিত্তিক ও প্রাণবন্ত বিতর্কের চর্চা হবে। সে ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজতর হবে। তাতে দেশ ও দশের কল্যাণ হওয়াটা অবধারিত, যার অভাব এখন প্রবল ও প্রকট। আমরা ৫০টি বছর পার করে এসেছি, এ সময়ে তেমন একটা কিছু হয়নি। একটি সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন ও সুশাসন কায়েম করা সম্ভব হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অনিয়ম, অনাচার, খেদ, ক্ষোভ, হতাশা জমা হয়েছে প্রচুর। সর্বোপরি দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। এসব বিদ্যমান রেখে যতই মিষ্টি মধুর কথা বলা হোক না কেন, আমরা রাষ্ট্রতরীকে উল্লিখিত অবস্থার সাথে বেঁধে রেখে যতই দাঁড় বাইনা কেন, তরী এতটুকু অগ্রসর হবে না। এসব যদি ধুয়ে মুছে ফেলা ও তরীর বাঁধন যদি ছিন্ন করা যায়, তবে পালে বাতাস দোল খেতে শুরু করবেই। আর রাষ্ট্রতরীর মাঝি মাল্লাদের বাছাইয়ের দায়িত্বটা জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। জনগণকে ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করাটা সঠিক নয়, আর এ-ও সঠিক নয় যদি কেউ ভাবে ‘আমরাই আমাদের বিকল্প।’ এই বোধ ও অনুভূতি সুবোধও নয়, এ অনুভূতি হৃদয়ের দৈন্যকে আরো প্রতিভাত করে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা