মনুষ্যত্ব রোধ ও নৈতিকতা
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০১ এপ্রিল ২০২২, ২০:২৪
দেশের বর্তমান বিচারব্যবস্থা সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল ও জটিল। নিত্যনতুন আইন সৃষ্টি হওয়ার কারণে জটিলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনার জন্য সরকার এক দিকে থানা ও পুলিশের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি করছে, অন্য দিকে কঠিন কঠিন আইন প্রণয়ন করছে অপরাধপ্রবণতাকে প্রতিরোধ করার জন্য। কিন্তু অপরাধ ক্রমেই বেড়ে চলছে। পরকীয়া, সাংসারিক অশান্তি, অভাব অনটনের জন্য মা-বাবার হাতে সন্তান খুন; অন্য দিকে নেশার টাকা বা কাক্সিক্ষত সম্পত্তি পেতে ব্যর্থ হয়ে সন্তান মা-বাবাকে খুন করছে। সম্পত্তি ও নেশার টাকার জন্য এর আগেও সন্তানের হাতে মা-বাবাকে খুনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু জন্মদাত্রী মা পরকীয়ার জন্য সন্তান খুনের ঘটনা কল্পনাতীত বিষয়।
প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্য নিচতলা থেকে উঁচুতলা পর্যন্ত অনেক ঘটনার ইতিহাস থাকলেও পরকীয়ার জন্য মা নিজে গলা টিপে বা বিষ দিয়ে সন্তান হত্যা করার বিষয়টি কতটুকু মর্মান্তিক হতে পারে তা একজন সুস্থ মানুষের চিন্তার পরিধি কভার করতে পারবে না। অপরাধপ্রবণতা, মাদকতা রোধ করার জন্য সরকার এক দিকে কঠিন আইন তৈরির জন্য জাতীয় সংসদকে নিত্যনতুন আইন প্রণয়নের একটি ফ্যাক্টরিতে পরিণত করেছে বটে, কিন্তু নৈতিকতা শিক্ষার সরকারি কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। বরং অশ্লীলতা শিক্ষাদানে প্রসার ঘটানোর সব দরজাই সরকার খুলে রেখেছে। সরকার এখন ব্যস্ত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষাসহ বংশানুক্রমিক গুণগানের পসরা সাজিয়ে তার মার্কেটিং করায়। চারদিক থেকে শুধু গুণগান ও প্রশংসাই শোনা বা শোনানোই যেন সরকারের এখন মুখ্য দায়িত্ব বলে মনে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য দিন দিন বেড়েই চলেছে, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে চক্রবৃদ্ধি আকারে। তার পরও সরকারপ্রধান শুধু আশায় থাকেন বংশানুক্রমে গুণগান প্রচারে কে কতটুকু এগিয়ে, তা পর্যবেক্ষণের প্রতিযোগিতা উপভোগ করার মানসে।
অপরাধপ্রবণতা রোধের প্রধান হাতিয়ার নৈতিকতা ও নৈতিকতা খুঁজে পাওয়া যায় একমাত্র ধর্মীয় চর্চা বা অনুশীলনে। কিন্তু ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে কোনো ভ‚মিকা রাখলেই শুরু হয় বকধর্মী এক শ্রেণীর নাস্তিক বুদ্ধিজীবীদের বকবকানি। মুক্ত চিন্তার নামে অশ্লীলতাকে প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে এবং অশ্লীলতাকে প্রতিরোধ করার জন্য যখন ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বলা হয় তখনই তথাকথিত প্রগতিশীলরা সাম্প্রদায়িকতাকে টেনে এনে ধর্মের বিরুদ্ধে চাপাবাজি করতে থাকে। ধর্মভীরুতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একশ্রেণীর নাস্তিক ফায়দা লুটে নিচ্ছে।
অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধি-২০২২ প্রণয়ন করে সরকার মাদককে উৎসাহিত করেছে। ওই আইনে মদপান করার জন্য পারমিটের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে আরো বলা হয়েছে, ২০০ জন মদদি একত্রিত হয়ে মদ খাওয়ার দোকান বা ক্লাব বা সংগঠন তৈরি করতে পারবে। অথচ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনের রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবে এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং .স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ মদ, মাদক বা মাদকসেবীদের রাষ্ট্র কোনো কারণেই সংবিধান পরিপন্থী কোনো প্রকার সুযোগ দিতে পারে না, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকার সংবিধানপরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তো বটেই, অন্য দিকে মাদকসেবীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। মাদক আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে দেয়। তার পরও এক দিকে মাদকের বিরুদ্ধে কঠিন আইন, অন্য দিকে মাদক সেবনের চতুর্মুখী রাস্তা সরকার খুলে দেয়ার কারণে সমাজহিতৈষী ও সঙ্ঘবদ্ধ নাগরিক সমাজ ব্যথিত হয়েছে, কিন্তু সরকার যখন মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে তখন সাধারণ জনগণের ব্যথিত হওয়া ছাড়া করণীয় আর কী থাকতে পারে? অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২-এর ১৫ ধারা মোতাবেক মদের বার স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে যা নিম্নরূপ-
‘(১) এই বিধিমালার উদ্দেশ্যপূরণকল্পে নিম্নবর্ণিত স্থানে বার স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান করা যাইবে, যথা : (ক) হোটেল; (খ) রেস্তোরাঁ, যে স্থানে সাধারণ খাবার পরিবেশন করা হইয়া থাকে; (গ) এইরূপ ক্লাব, যাহার সদস্যগণের মধ্যে অন্যুন ২০০ জন সদস্য অ্যালকোহল পানের জন্য পারমিটধারী : তবে শর্ত থাকে যে, ক্লাবের লাইসেন্স বা রেজিস্ট্রেশন প্রাপ্তির তিন বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বার লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাইবে না; এবং (ঘ) ইপিজেড, থিমপার্ক বা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের যে স্থানে বিদেশী নাগরিক রহিয়াছে বা থাকিবে।
(২) এই বিধিমালার অধীন হোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ডিউটি ফ্রি শপ ও প্রকল্প এলাকার জন্য নিম্নবর্ণিত সংখ্যক বার লাইসেন্স প্রদান করা যাইবে, যথা : (ক) দুই তারকা মানসম্পন্ন হোটেলের ক্ষেত্রে অনধিক ১ (এক)টি; (খ) তিন তারকা মানসম্পন্ন হোটেলের ক্ষেত্রে অনধিক ২ (দুই)টি; (গ) চার তারকা মানসম্পন্ন হোটেলের ক্ষেত্রে অনধিক ৩ (তিন)টি; (ঘ) পাঁচ অথবা অধিক তারকা মানসম্পন্ন হোটেলের ক্ষেত্রে অনধিক ৭ (সাত)টি; তবে শর্ত থাকে যে, ৭ (সাত)টি বারের অধিক বার প্রয়োজন হইলে, যৌক্তিকতাসাপেক্ষে ও সরকারের অনুমোদনক্রমে, বার সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাইবে; (ঙ) পর্যটন, ক‚টনৈতিক বা অভিজাত এলাকার রিসোর্টের জন্য ১ (এক)টি; (চ) রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রে ১ (এক)টি; (ছ) ক্লাবের ক্ষেত্রে ১ (এক)টি; (জ) বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরের, ক্ষেত্রতম, আগমন, বহির্গমন বা ট্রানজিট লাউঞ্জের ডিউটি ফ্রি শপে পৃথকভাবে ১ (এক)টি করিয়া; এবং (ঝ) সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োজিত বিদেশী নাগরিকদের মদপানের জন্য প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প মেয়াদকালের জন্য ১ (এক)টি।
(৩) বার, বিলাতি মদের অনশপ ও বিলাতি মদের অফশপকে আমদানীকৃত বিদেশী মদ, বিলাতি মদ ও মদজাতীয় পানীয়ের ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করিতে হইবে।
(৪) আমদানিকৃত বিদেশী মদ, বিলাতি মদ ও মদজাতীয় পানীয়ের ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গ্রহণ করিতে হইলে তফসিল-২ এর ফরম ২/৩০ অনুযায়ী আবেদন করিতে হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে তফসিল-৩ এর ফরম ৩/৩০ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ড রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা যাইবে।
(৫) উপ-বিধি (৪) অধীন প্রাপ্ত আবেদন যাচাই-বাছাই ও বিবেচনাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে বিধি ৪ এর বিধানাবলি প্রযোজ্য হইবে।’
অনেক উচ্চ শিক্ষিত মানুষকেও জঘন্য সামাজিক অপরাধে লিপ্ত হতে দেখা যায়, এর মূল কারণ নৈতিকতার অভাব। শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিকতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উচ্চ শিক্ষিত বা সমাজে প্রতিষ্ঠিত বা ক্ষমতাসম্পন্ন একজন উচ্চতরে ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি হয়তো লাভ করতে পারে, কিন্তু মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন মানুষ হতে পারে না, যার অভাব রয়েছে আমাদের সমাজে অবশ্যই, বহির্বিশ্বেও এর উদাহরণ রয়েছে প্রচুর পরিমাণ।
পৃথিবীতে যত যুদ্ধ হয়েছে, মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে তার অধিকাংশই ঘটেছে ইগো প্রবলেমের কারণে। যুদ্ধ অর্থই ধ্বংস, মানুষ হত্যা, যে হত্যার কারণে কোনো প্রকার খুনের মামলার আসামি হতে হয় না। যে বিষয়টি আলোচনার টেবিলে নীতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে মীমাংসা হতে পারে তা নিয়েও শুধু নিজের বাহুবল প্রর্দশনের জন্য যুদ্ধবিগ্রহ চলছে তো চলছেই। সাধারণ মানুষের জীবন এখন ক্ষমতাসীনদের হাতের মুঠোয় বন্দী। অবস্থাটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এজনকে খুন করলে হয় খুনি, অন্য দিকে হাজার হাজার খুন করলে হয় ‘বিজয়ী বীর’। এ ধ্যান ধারণা থেকেই বিশ্ব ইতিহাস এগিয়ে চলছে, যার প্রতিরোধে ‘বিশ্ব সভ্যতার বিবেক’ আজ বিকল হয়ে পড়েছে। অকাতরে মানুষ হত্যা হয় জাতীয় স্বার্থের ব্যানারে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কারণ ইগো প্রবলেমের কারণে সৃষ্টি যা ব্যক্তিগত স্বার্থ, ইচ্ছা, অনিচ্ছার প্রতিফলন মাত্র।
মানুষই একমাত্র প্রাণী যার নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, যার বিচার বিশ্লেষণ হয় ইতিহাসের পাতায়, যা তাৎক্ষণিক নয় বরং যুগের পর যুগের অবসান ঘটিয়ে, অর্থাৎ যিনি ‘সময়ের’ কারণে নির্যাতিত হন এবং যার দ্বারা নির্যাতিত হন, তিনি তা দেখে যেতে পারেন না, যা থেকে যায়। পরবর্তী প্রজন্মের কেউ শিক্ষা নিতে পারে না বরং মনুষ্যত্ববোধকে তলানিতে নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ ভ‚পেন হাজারিকার গাওয়া সেই গান কি গোটা মানবজাতির কর্ণকুহরে পৌঁছায় না? গানটির অনেক মর্মার্থ রয়েছে এবং এ ধরনের অনেক গান, কবিতা, নাটক, বাণী, কথামালা রয়েছে যা মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেকসম্পন্ন মহামানবদের সৃষ্টি। সে সৃষ্টি মানুষ উপভোগ করে সত্য, কিন্তু অনুশীলন করে না, যারা করে তারাও আজ সভ্যতার ভিকটিম।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা