বিশ্ববিধাতা ছাড় দেন, ছেড়ে দেন না
- ড. গাজী মো: আহসানুল কবীর
- ২২ মার্চ ২০২২, ২০:০১
কিছু দিন আগে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস অত্যন্ত মলিন বদনে বললেন এ গ্লোবটি দিন দিন বিশৃঙ্খলায় ভরে উঠছে। কী অসহায় উচ্চারণ! বলবেনইনা কেন? দুটি বিশ্বযুদ্ধেও আমাদের যে শিক্ষা হয়নি। ইদানীং তো আমাদের এ পৃথিবী যেন অসহিষ্ণুতা আর উন্মত্ততায় ছেয়ে গেছে। কখনো কখনো মনে হয়, চার দিকে শুধুই নির্বোধ ক্ষ্যাপা লোক আর অবুঝ শিশু-কিশোরের ছড়াছড়ি। এদের কারো মধ্যে যেন বিবেচনা বোধ নেই, নেই কোনো মাত্রাজ্ঞানও। দেখি আর ভাবি, এত অপ্রকৃতিস্থ লোক কি এক সঙ্গেই এ পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখল? তাদের হাতেই গেল পৃথিবীর সব কর্তৃত্ব? এসব লোক যেন ক্ষ্যাপাটে শিশুর মতো অল্পতেই অস্থির, বেসামাল হয়ে ওঠে। তাদের বেপরোয়াপনায় যে, পৃথিবীর শতকোটি মানুষ বিপদের ঝুঁকিতে পড়ে যান সেদিকে এদের কোনোই ভ্রুক্ষেপ নেই। তুচ্ছ ঘটনাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছেন এরা।
একজন রাষ্ট্রনায়ক বা এ পর্যায়ের লোক অবিবেচক ও ক্ষ্যাপা হলে পৃথিবীর বুকে কী অভাবনীয় ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসতে পারে তা আমি সবাইকে একবার একটু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। একশ’ বছর আগের কথা, অস্ট্রোহাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রানজ ফার্ডিনান্ড ১৯১৪ সনের জুন মাসে এক ব্যক্তিগত সফরে সার্বিয়া যান। ১৮ জুন বাইরে বেরিয়ে রাজপথে হাঁটছিলেন। হঠাৎ কোনো এক যুগো¯গ্লাভ নাগরিকের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সাথে সাথেই মারা যান। কে মারল, কী উদ্দেশ্যে কেন মারল, এসব খুব বেশি খতিয়ে দেখা হলো কিনা জানি না। তবে ঘাতকের উদ্দেশ্য আজ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তবে ততোধিক দুঃখজনক হলো, এর প্রতিশোধ হিসেবে এক মাসের মাথায় ২৮ জুলাই অস্ট্রোহাঙ্গেরি সরকার সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধই ঘোষণা করে বসল। এক এক করে, পৃথিবীর তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল পৃথিবীর ৫০০ কোটি বছরের ইতিহাসে ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’। চার বছর গড়াল এ যুদ্ধ। প্রাণ হারাল বা নিখোঁজ হলো অন্তত দুই কোটি মানুষ। জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে গেল আরো দুই কোটি মানবসন্তান। কী দোষ এদের ছিল? সবাই আমার সাথে একমত হবেন, কোনো দোষই এদের ছিল না। শুধু কি এ চার কোটি প্রাণ? না, তা হবে কেন? ধ্বংস হয়ে গেল হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ। বছরের পর বছর স্থবির হয়ে রইল পুরো পৃথিবীর অর্থনীতি। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল পৃথিবীর বৃহত্তম অটোমান সাম্রাজ্য। তুরস্কভিত্তিক বিশাল এ সাম্রাজ্য (মুসলিম খেলাফত) লুটের মালের মতো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিলো বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রশক্তি। ফলে সারা বিশে^ অভাবনীয় এক মানবিক বিপর্যয় নেমে এলো ১৯১৮ পরবর্তী সময়ে। ভাবা যায়, একটি মাত্র প্রাণহানির প্রতিশোধ কত ব্যাপক, কী সুবিশাল ক্ষতির বিনিময়ে শোধ করতে হলো বিশ্ববাসীকে! বিশ্ব মানবতার এত ক্ষতি সাধন করে অস্ট্রিয়ার কী লাভ হলো? শুধু একটু রাগ মেটানো ছাড়া?
একশ’ বছর আগের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এ প্রেক্ষাপটের সাথে ইউক্রেনে রাশিয়ার চলমান আগ্রাসনের ঘটনা সম্পূর্ণ মিলে যায়। কিন্তু প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ একেবারেই একতরফা ও ভারসাম্যহীন মগজের সিদ্ধান্ত। ক্ষ্যাপাটে পুতিন নিজের দেশ ও পৃথিবীর কথা বিবেচনা না করেই তাঁর ভাষায় শুধুমাত্র এক ব্যক্তিকে ‘উচিত’ শিক্ষা দিতে এমন ঘৃণিত এক কাজে নেমে যান। ব্যক্তিটি কে? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। দোষ কী তাঁর? দোষ, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন। তাতে তাঁর দোষটা কেন হবে? তিনি তো অভিজ্ঞতার আলোকেই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন। তিনি দেখলেন, আজ থেকে আট বছর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনেরই একটি বিরাট অঞ্চল ক্রিমিয়াকে এ ধরনেরই এক আগ্রাসনে রাশিয়া দখল করে নিলো এবং শুধু দখলই করল না, বরং এ অঞ্চলের তাতার মুসলমানদের সুন্দর সাইবেরিয়ায় তাড়িয়ে এটিকে রাশিয়ার ২২তম রিপাবলিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হলো। আবার মাত্র কিছু দিন আগেই ইউক্রেনের ভোনবাসের দু’টি স্বশাসিত অঞ্চল দোনেস্ক ও লুহানস্ককে রাশিয়া সৈন্য ঢুকিয়ে গায়ের জোরে দখল করল এবং তাদের দিয়ে লোকদেখানো-মানুষ হাসানো স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়ে অঞ্চল দু’টিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিও দিলো যাকে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশই স্বীকৃতি দেয়নি। শুধু তো ইউক্রেন নয়। এভাবে এর আগে একের পর এক চেচনিয়া, বাসকোরতোস্তান, দাগেস্তান, ইনগুশেটিয়া এমন আরো কয়েকটি স্বাধীন দেশকে রীতিমতো শক্তি প্রয়োগে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছিল। নব্বই এর দশকে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী জর্জিয়ার ভিতরে ঢুকে রাশিয়া বাহিনী দেশটির একটি অংশ দখল করে নেয়।
চেচনিয়ার কথাই ধরা যাক না। এ ছোট্ট মুসলিম দেশটি কতবার স্বাধীনতা পেল আর কতবার গলা টিপে এ যুদ্ধবাজ রাশিয়া তাকে গিলে খেল, তা হিসাব করার জন্য রীতিমতো কাগজ কলম নিয়ে বসতে হবে। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯২২ সালে ভ্লাদিমির লেনিন যে টঝঝজ (টহরড়হ ড়ভ ঝড়ারবঃ ঝড়পরধষরংঃ জবঢ়ঁনষরপং) গঠন করলেন তাকে টিকিয়ে রাখতে লেনিন, স্টালিন, ক্রুশ্চেভ, ব্রেজনেভ, গর্বাচেভ এবং সর্বশেষ বরিস ইয়েলৎসিনকে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি। এত ঘাম ঝরিয়েও শেষ পর্যন্ত টঝঝজকে আর একত্রে ধরে রাখা গেল না।
ভাঙন শুরু হলো আজকের এই ইউক্রেনের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়েই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন ঘটল। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি রাশিয়া আর ক্ষুদ্রতমটি মুসলিম অধ্যুষিত চেচনিয়া। কিন্তু না, রাশিয়া একে টিকতে দিলো না। দখল করে নিলো। তখনই স্বাধীনতার ¯স্লোগান নিয়ে গর্জে উঠলেন এক অসম সাহসী ব্যক্তি যিনি কর্মজীবনে ছিলেন একজন ছোট্ট অফিস সহকারী। সেই জোখায়ের দুদায়েভ (জওহর দুদায়েভ) কেরানিগিরির চাকরি ছেড়ে চেচনিয়ার গণমানুষের স্বপ্নের মহানায়ক বনে গেলেন। নিজে যুদ্ধ শিখলেন এবং এক প্রশিক্ষিত গণবাহিনী গড়ে তুলে রাশিয়ার বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে নিজ দেশ স্বাধীন করলেন। আবারও আগ্রাসন, আবারও স্বাধীনতার পালাবদল চলল (১৯৯২-৯৯)। ১৯৯৯ সালে যখন চেচনিয়ার মুক্তিকামী বাহিনীর কাছে ইয়েলৎসিনের রাশিয়া বাহিনী পরাজয়ের মুখে, এমনি সময় দিশেহারা ইয়েলৎসিন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। ক্ষমতা তুলে দিলেন গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির ছোটখাটো পদমর্যাদার (লে. কর্নেল), ততোধিক ছোটখাটো দেহাবয়বের অধিকারী এক তরুণ গোয়েন্দা ভ্লাদিমির পুতিনের হাতে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, ছয় মাস পর ২০২০ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট। সেই পুতিনই আজ ২২ বছর ধরে সারা পৃথিবীর মানুষকে নানা ভেল্কি দেখাচ্ছেন। পুতিনের হাতে ক্ষমতা আসার পর রক্ত ঝরা স্বাধীনতাকামী চেচনিয়া আর স্বাধীন থাকতে পারল না। পুতিন নৃশংস কায়দায় তাকে দমন করলেন। এমনকি তাদের স্বাধীনতার মহানায়ক চেচনিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জোখায়ের দুদায়েভও যুদ্ধ করতে করতেই প্রাণ হারালেন। অবশ্য এমনি নয়। পুতিন চেচনিয়ার মুসলিমদের মধ্যে এক ‘মীরজাফর’কে খুঁজে পেয়েছিলেন-রমজান কাদিরভ। তাকে দিয়ে ষড়যন্ত্র করেই ঘৃণ্য পন্থায় চেচনিয়ার লালিত স্বপ্নকে পায়ের নিচে পিষে শেষ করেন। যাই হোক, এমনি দানবসম পুতিনের হাতে থাকা বহু জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা হরণকারী বিশাল রাশিয়া যখন ঘাড়ের ওপর বারবার গরম নিঃশ্বাস ফেলছে, তখন পাশের নিরীহ ইউক্রেন তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেই। আর সে কারণেই ইউক্রেনের বিগত নির্বাচনে জনগণকে দেয়া কথা রাখতে গিয়েই সে দেশের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদ প্রার্থনা করলেন। এতে রাজনীতির ঘোর-প্যাঁচ না বোঝা, কৌতুক অভিনেতা থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া এ সহজ সরল মানুষটি দোষ করলেন কী? তিনি তো কারো মাথায় আঘাত করেননি, একটি গুলিও ছোড়েননি। এমনকি কাউকে কটাক্ষ করে কথাও বলেননি।
শুধু নিজ দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। এতে যদি তার দোষ হয়ে যায় তাহলে তো ভ্লাদিমির পুতিনকেও সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত করতে হয়। কারণ তিনি আজ থেকে ২০-২৫ দিন আগে যখন ইউক্রেনের ওপর বর্বর আক্রমণ শুরু করেন তখন ‘যুক্তি’ দেখান যে, রাশিয়ার পাশে থাকা দেশ ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্যভুক্ত হয় তবে ন্যাটো বাহিনী ইউক্রেনে আস্তানা গাড়বে। আর এতে রাশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।’ বাহ কী কথা! রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য পুতিন যে যুক্তি দেখাচ্ছেন সেই একই যুক্তি যখন ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষার ঝুঁকি ঠেকাতে জেলেনস্কি দিলেন তখন তার মহাদোষ হয়ে গেল? কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়ে তো জেলেনস্কির সেই সন্দেহটাই প্রতিষ্ঠিত করে দিলো। সারা পৃথিবী দেখল যে, হ্যাঁ সত্যিই দানবের আগ্রাসন থেকে রক্ষা পেতে হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। তাই তার ন্যাটোর সদস্য হওয়া খুবই জরুরি। প্রয়োজন হবে তার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হওয়াও। এটি কেমন কথা? একটি দেশের কি নিজের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে কোনো সিদ্ধান্ত স্বাধীনভাবে নেয়ার অধিকার নেই?
আধুনিক বিশ্বে এত মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের কথার ছড়াছড়ির মাঝে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ওপর খামখেয়ালিভাবে কেউ কি এমন হিংস্র থাবায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে? কোথায় জাতিসঙ্ঘ, কোথায় বিশ্ব আদালত (ওঈঔ), কোথায় লম্বা লম্বা কথা বলার গণতান্ত্রিক বিশ্ব? কেউ কি একটু এ অসহায় মানুষগুলোর ওপর এমন দানবীয় থাবাকে রুখে দিতে পারে না? আজ ২০-২৫ দিন যাবৎ সাড়ে চার কোটি মানুষের এ বিশাল ভূখণ্ডটি রীতিমতো এক পার্থিব নরকে পরিণত হয়েছে। ৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত, প্রায় ১২০০ বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা একটি চমৎকার সাজানো দেশ চার দিক থেকে পুতিনের হায়েনা বাহিনীর জঘন্য আক্রমণে একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। যখন এ পৃথিবীতে মস্কোর অস্তিত্বই ছিল না তার বহুশত বছর আগে ঐতিহাসিক কিয়েভ নগরী ‘রাস’ সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। অথচ হায়েনার হিংস্র থাবায় সেই অপরূপ কিয়েভ আজ এক বিধ্বস্ত জনপদ। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, হাতে অর্থ নেই, দোকানপাটে খাবার বা প্রয়োজনীয় জিনিস নেই, পেটে দানাপানি নেই। চার দিকে সব ‘নেই নেই’ এর মাঝে আছে শুধু গুলি খেয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা লাশের মিছিল। সে মিছিলে যোগ দিয়েছে এমনকি ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে খাদ্য বিতরণরত এক শহরের মেয়রের গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়া দেহখানিও। ব্যাপারটি যেন এমন যে, খাদ্য খাবার দরকার নেই, ‘নে গুলি খা’। কী বীভৎস! কল্পনা করা যায় যে, এ বীভৎস অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য একটি ১১ বছরের অসহায় ভয়ার্ত বালক ইউক্রেন থেকে গ্লোভাকিয়ায় ১২০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পথ হেঁটে পাড়ি দিয়েছে?
এত ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও ইউক্রেনের সাহসী মানুষগুলো কিন্তু ধৈর্য হারায়নি। সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ২৮ লাখ মানুষ প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিলেও বাকি সোয়া চার কোটি জনগণ কিন্তু পালিয়ে যায়নি। কারণ এরা তো বীরের জাতি। প্রতিষ্ঠার পর ১২০০ বছরে বার বার নানা শক্তি এদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে, আবার সে স্বাধীনতা তারা পুনরুদ্ধারও করেছে। এ দেশেই জন্ম নিয়েছেন রাশিয়ার বিখ্যাত সব ব্যক্তি ট্রটস্কি, ব্রেজনেভ, আলেক্সি কোসিগিন এবং বিশ্ব অলিম্পিকের নামকরা সব ক্রীড়াবিদ, হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং কবি-সাহিত্যিকরা। তাই হায়েনার হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে যে যেভাবে পারছে এগিয়ে আসছে। সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে গুলি বন্দুক হাতে নিজেরাই তৈরি করছে প্রতিরক্ষা ব্যূহ। শত্রু সৈন্যের অগ্রযাত্রা থামাতে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে, ট্রেঞ্চ খুঁড়ছে, পেট্রলবোমা বানাচ্ছে, শত্রুর সামরিক বিমান ভূপাতিত করছে- কী না করছে। আর তাদের নির্বাচিত অসহায় প্রেসিডেন্ট কী অসম সাহসে লড়ে যাচ্ছেন জনগণের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে। অথচ পুতিন যতই ক্ষমতাধর হোন, বড়ই একা। তার দেশের জনগণই রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে রাজপথ উত্তাল করে তুলেছে। তা সামলাতে পুতিনের পেটোয়া বাহিনী জনতাকে রাস্তাতে ফেলেই পিটাচ্ছে এবং এক দিনেই পাঁচ হাজার রাশিয়াবাসীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। কী অসম্ভব বৈপরীত্য! ইউক্রেনের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট যেখানে রাস্তাকেই অফিস বানিয়ে রাস্তাতেই জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ রক্ষায় যুদ্ধ করছেন, সেখানে জনবিচ্ছিন্ন পুতিন রাস্তায় নিজ দেশেরই যুদ্ধবিরোধী মানুষের প্রতিরোধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। শুধু কি নিজ দেশে? না, এমন অনাকাক্সিক্ষত অশান্তিময় অবস্থা সৃষ্টির জন্য এ মুহূর্তে পৃথিবীতে সম্ভবত সবচেয়ে নিন্দিত ও ঘৃণিত ব্যক্তি পুতিন। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণের ঘটনা ছাড়া এবারে পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসন হিটলারের পর গত ৭৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে নারকীয়, জঘন্য ও এক তরফা হামলা।
এমন অসম যুদ্ধে বিশাল রাশিয়া বাহিনীর হাতে ক্ষুদ্র ইউক্রেনের কী দশা হবে, জানি না। তবে একটু স্মরণ করতে চাই যে, সতের বছর যুদ্ধ করেও মহাপরাক্রমশালী আমেরিকা কিন্তু ক্ষুদ্র ভিয়েতনামের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। একই আমেরিকা বিশ বছর ধরে অনেক অর্থ, সমরাস্ত্র আর প্রাণ ঝরিয়ে আফগানিস্তানে কিন্তু জিততে পারেনি। ক্ষুদ্র শক্তির তালেবানদের তাড়া খেয়ে সব ছেড়ে রীতিমতো এক কাপড়ে পালাতে হয়েছে। এর আগে একই তালেবানদের কাছেই পরাজিত হয়ে রাশিয়াকেও রাতের আঁধারে নীরবে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছিল।
কথা হলো, পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের মনে এমন রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে এত নিন্দা আর ঘৃণা কুড়িয়ে পুতিনের কী লাভ? তার চেয়ে বরং ক্রোধ প্রশমন করে একটু উদারভাবে সমস্যার সমাধানের পথে হাঁটলেও পারতেন। অতিসম্প্রতি এমন এক চমৎকার নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ সালে কয়েক মাস সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে মিয়ানমারের জান্তা সরকার ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে ঠেলে দিয়ে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। দশ লক্ষ অভিবাসীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার মতো এমন একটি চরম উসকানিমূলক কাজের পরও বাংলাদেশ কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যা সমাধানের পথে যেভাবে এগিয়েছিল, প্রশংসা করতেই হয়। এতে জনবহুল এ দেশটি একটি অসহনীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু একটি বিরাট আঞ্চলিক সংঘর্ষ ও মানবিক বিপর্যয় তো ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অস্ট্রোহাঙ্গেরি সরকার যদি হুট করে যুদ্ধ ঘোষণা না করে, সার্বিয়ার সাথে আলাপ আলোচনার এমনই কোনো উদ্যোগ নিত তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পৃথিবীকে হয়তো কোটি কোটি নিরীহ প্রাণহানি এবং বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতির অপবাদ কাঁধে নেয়ার মতো বিপর্যয়কর বিশ্বযুদ্ধ দেখতে হতো না। ঠিক একইভাবে আজ যে হুঙ্কার আর ঝংকার শোনা যাচ্ছে তা যদি শেষ পর্যন্ত থামানো না যায় তবে নিউক্লিয়ার শক্তির এ যুগে পৃথিবীর ধ্বংসযজ্ঞের সীমা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা চিন্তা করতেও গা শিউরে ওঠে। কিন্তু কেন? এ ধ্বংস ঘটিয়ে কার কী লাভ? একটুখানি সংযত হয়ে যদি সবাই সামান্য করে উদারতা দেখাই তাহলে ক্ষতিটা কী? এ উপলক্ষে বাংলার এক কবির লেখাটাই মনে পড়ে গেল- ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাইরে।’ কেন, আকাশ কি আপনাদের মাথার উপর নেই? আছে তো। একটু তাকিয়ে দেখুন তো। দিগন্ত বিস্তৃত এই আকাশ কী উদারভাবে জাতি বর্ণ নির্বিশেষে সবার মাথার ওপর এক রক্ষাকবচ-ছাতা হয়ে আছে? আসুন, সেই উদারতা আমরা সবাই একটু দেখাই। আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীর ধ্বংসটি ঠেকাই।
তবে শেষ কথা হলো, মানুষ যতই শক্তিশালী হোক সে কিন্তু পরিণতি টানার ক্ষমতা রাখে না। এ অধিকার শুধু বিশ্ববিধাতার হাতেই। তিনি হয়তো কখনো কখনো কাউকে কাউকে কিছুটা ছাড় দেন, তবে ছেড়ে দেন না।
লেখক : প্রফেসর, রসায়ন এবং সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা