২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া

-

গোশত এবং মুরগি কেনার প্রয়োজনে বাজারে গেছি, দু-তিন মাস আগের হিসাব ধরেই বেগম সাহেবা বাজারের জন্য টাকা দিয়ে দিলেন। বাজারে গিয়ে চক্ষুচড়ক গাছ। ৫৫০ টাকার গরুর গোশত ৬৫০ টাকা, ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকার মুরগি ৪৫০ টাকা। সবজির বাজারের একই অবস্থা। যেটাতেই হাত দেই হাত যেন পুড়ে যায়। সেটার গায়েই আগুনের হল্কা। বাধ্য হয়ে বাজারের পরিমাণ সংক্ষিপ্ত করে ফিরতে হলো। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। ৫ টাকা মণ ধান বিক্রি করেছি নিজেই। এক টাকায় ১২টি মুরগির ডিম মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় কিনেছি। সকালের নাস্তা, দুবেলা খাওয়া, হোস্টেলের মেসে ৫০ টাকা দিতে হতো। সপ্তাহান্তে উন্নতমানের খাবার। মাসের শেষে ভোজন উৎসব ছিল ফাও। এগুলো এখন সোনার হরিণ। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ হাঁসফাঁস করছে। গরিব মানুষ সঙ্কটে, মধ্যবিত্ত পরিবারে কান্না, সংসার চালানোই দায়- এগুলো এখন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। সংসারের চাকা সচল রাখতে ও আয়-ব্যয়ের হিসাব কষতে কষতে দিন পার।

শুধু দ্রব্যমূল্য নয়; বেড়েছে বাসভাড়া। বেড়েছে রিকশা ভাড়া। ভাগ্যিস ট্রেনের ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু ট্রেনের টিকিট সে তো দুঃস্বপ্ন। কাপড়চোপড়ের দাম বেড়েছে। দাম বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীর। চাল ডালের দাম বলাই যায় না। কোনো অনাবৃষ্টি, বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। চালের বাম্পার ফলন। অথচ নাগাল পাওয়া যায় না। উপরের দিকে ছুটছে তো ছুটছেই। মরিচের ঝাল, পেঁয়াজের ঝাঁজ সাথে সাথে আদা-রসুন তাও ঊর্ধ্বমুখী। সীমিত আয়ের মানুষ যাবে কোথায়? অগত্যা টিসিবির লাইনে। টিসিবির গাড়ি দেখলেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু চাহিদামতো পণ্য পাচ্ছে না। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোট ১৩৪টি পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে চারটি পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। সাধারণ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রাকের নাগাল পেলেও দেখা পায়নি পণ্যের। সব দোষ নন্দ ঘোষের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটা দায়মুক্তির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘ইউরোপ আমেরিকার মতো মূল্যবৃদ্ধি হয় না’ বলে প্রায়ই জনতাকে নসিহত করা হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি ঠেকানোর দায়িত্ব যাদের তারা যখন অসহায়ভাবে পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করে তখন আমজনতার গন্তব্য কোথায়? তাদের কী অবস্থা? এটা উপরতলার বাসিন্দারা অনুধাবন করতে পারে না।

সামনে মাহে রমজান। রহমত, নাজাত আর মাগফিরাতের এই মাসে ভোগ্যপণ্য কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। তিন মাসে যা কেউ কেনেনি তা এক মাসে কেনে। আর এ সুযোগে একটি গোষ্ঠী মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করে। এই প্রবণতা বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনাকে নিরুৎসাহিত করা দরকার। ব্যবসায়ীরা রমজান এলেই এটা সেটা বলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। এমনিতেই মধ্যবিত্ত পরিবারের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে। তার পরে যদি রমজানকে সামনে রেখে দাম আরেক দফা লাফ দেয় তাহলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার কোথায় যাবে? কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)-এর ভাষ্যমতে, ২০২০ সালে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ৬.৮৮ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৯ সালে বেড়েছে ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে বেড়েছে ৬ শতাংশ। তবে এই সময়ে ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক বছরের ব্যবধানে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে; চাল ১০ শতাংশ, আটা-ময়দা ২৯ শতাংশ, সয়াবিন-পাম অয়েলের দাম ৫৪ শতাংশ, মসুর ডাল ১৭ শতাংশ, মুরগির দাম ২৪ শতাংশ, চিনির দাম ২৬ শতাংশ বেড়েছে।

সয়াবিন তেল নাগালের বাইরে। চমৎকার বুদ্ধি বের করা হয়েছে। খোলা তেল বিক্রি করা যাবে না। তার মানে, যে কটি কোম্পানি এ দেশের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করে তাদের হাতে খাড়া তুলে দেয়া হলো। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) নামে বাংলাদেশে একটি সংগঠন রয়েছে। তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিভিন্ন সরকারি কমিটিগুলোর সাড়া নেই। এই মুহূর্তে বাণিজ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজন কঠোর হাতে দ্রব্যমূল্যের ঘোড়াকে সামলানোর। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার হাত থেকে মুক্তি চায়।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement