ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের এক অগ্রসেনানী
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ১৩ মার্চ ২০২২, ২০:৪১
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাসসিরে কুরআন ডা: মাওলানা ইসরার আহমদ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন ১২ বছর হতে চলল। অসাধারণ এ পণ্ডিত ব্যক্তির চিরবিদায়ের ক্ষত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোয় ধর্মপ্রাণ জনগণের অন্তর থেকে এখনো মুছে যায়নি। তার মৃত্যুর খবর শুনে হায়দরাবাদ ও কাশ্মিরের শ্রীনগরসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গায়েবানা নামাজে জানাজার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তরুণ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের পথে আহ্বান করার ক্ষেত্রে তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ অভিভাষণ মানুষ দীর্ঘকাল মনে রাখবে। দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার অন্যতম উল্লেখযোগ্য ইসলামী স্কলার, ধর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ডা: ইসরার আহমদ।
ডা: মাওলানা ইসরার আহমদ ১৯৩২ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের হিসার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরকাল থেকে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৫৪ সালে লাহোরের কিং অ্যাডওয়ার্ড মেডিক্যাল কলেজ হতে এমবিবিএস এবং ১৯৬৫ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে চিকিৎসা পেশা পরিত্যাগ করে কুরআনের পূর্ণকালীন প্রচারক হিসেবে তিনি নিজকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় আঞ্জুমানে খোদ্দামুল কুরআন, ১৯৭৫ সালে তানজিমে ইসলামী ও ১৯৯১ সালে তাহরিকে খিলাফত পাকিস্তান নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে কুরআনের আলোকে সমাজ বিনির্মাণের প্রয়াস চালান। ইসলামের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে বিগত ৪০ বছর ধরে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পবিত্র কুরআনের দরস প্রদান করেছেন।
১৯৭৮ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘আল-কিতাব’, ‘আলিফ লাম মিম’, ‘রাসুলে কামিল’ ও ‘উম্মুল কিতাব’ নামে ইসলামী প্রোগ্রাম শুরু করেন ইসরার আহমদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত Qtv/Peace TV-তে তাঁর প্রদত্ত কুরআনের দরস বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কুরআনের খিদমতের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘সিতারায়ে ইমতিয়াজ’ খিতাবে ভূষিত করে। ডা: মাওলানা ইসরার আহমদের লিখিত গবেষণা গ্রন্থের সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে ১০টি গ্রন্থ বাংলাসহ পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ভাষায় অনূদিত হয়ে পাঠকনন্দিত হয়েছে। ‘বায়ানুল কুরআন’ নামক তার সাত খণ্ডের তাফসির ঐশী জ্ঞানভাষ্যের একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে বেশ সমাদৃত। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও তৎপরতা নিয়ে ১৯৯৪ সালে মিস সাগুফতা আহমদ ‘Dr. Israr Ahmad's Political Thoughts and Activities’ শিরোনামে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স থিসিস রচনা করেন। ড. ফওয়াদ আলী লাহোরি ইসলামী বিপ্লব সাধনে তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এমফিল থিসিস রচনা করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘A Critical Analysis of Dr. Israr Ahmad's Views on Islamic Revolution’.
তার লিখিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলির মধ্যে রয়েছে
1. Islamic Renaissance The real task
2. The objective and goal of Muhammad's prophethood.
3. Lessons from history: Reflections in the Past, Present and Future of Two Muslim Countries
4. Bayanul Quran 7 volume.
5. The obligations Muslims' Owes to the Quran
6. Judgement of Prophet Muhammad (SAW)
7. Calling people unto Allah
8. Khilafat in Pakistan: What, How and Why?
9. Obligations to God; a Comparative Islamic view
10. Quarane Hakim Aur Hamare Zindegi
11. Basic Essentials for Muslims
12. The Reality of Tasawwuf.
13. Manhaze Inqilabe Nabawi
14. The Tragedy of Karbala
15. Religious Obligations of Muslim Ummah
১৬. মুসলমানদের নিকট আল কুরআনের দাবি
১৭. দাওয়াত ও তাসাউফ
ডা: মাওলানা ইসরার আহমদের মন, মানস ও কর্মপ্রয়াসে শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি, মাওলানা হামিদুদ্দিন ফারাহি, মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী, ড. মুহাম্মদ ইকবাল, হাসান আল বান্না ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদের চিন্তা-চেতনার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তিনি শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি ও আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানীর গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘রূহানী ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র’ বর্তমানে আরব বিশ্ব থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এ উপমহাদেশ হতে ইসলামী রেনেসাঁর সূত্রপাত হবে। আরব বিশ্ব বর্তমানে ইহুদি আধিপত্যবাদের নিগড়ে আবদ্ধ। অন্য দেশের চেয়ে পাকিস্তানে খিলাফত ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন অধিকতর সহায়ক ও উপযোগী। জীবনের সর্বস্তরে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য খিলাফত ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন জরুরি। প্রচলিত গণতন্ত্র, সামরিক অভ্যুত্থান ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে খিলাফত কায়েম সম্ভব নয়।’ ডা: ইসরার আহমদ এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ইসলামী জমিয়ত-ই-তালাবার নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৫০ সালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীর নেতৃত্বাধীন জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। কিন্তু ১৯৫৭ সালে জামায়াত নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তিনি দল ত্যাগ করেন। আধুনিক গণতন্ত্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার একজন কট্টর সমালোচক ডা: ইসরার বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান একটি নির্বাচিত সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। তিনি মনে করতেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম কায়েম করা সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন ইসলামী খিলাফত পুনরুজ্জীবনের একজন নেতৃস্থানীয় প্রবক্তা। বাংলাদেশের বরেণ্য ইসলামিক স্কলার মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহিমও এই চেতনা লালন করতেন।
শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের একপর্যায়ে মাল্টা দ্বীপে সাড়ে তিন বছর বন্দিজীবন শেষে অন্দোলনের নিম্নোক্ত তিনটি রূপরেখা ঘোষণা করেন,
১. বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানদেরকে পারস্পরিক মতপার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে;
২. পবিত্র কুরআনের শিক্ষা ও চর্চাকে ব্যাপক করতে হবে, যাতে মুসলমানদের মধ্যে ঈমানি চেতনা শাণিত হয়, সেজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কুরআনের দরসের ব্যবস্থা করতে হবে;
৩. একজন আমির নির্বাচন করে তার অধীনে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। ডা: ইসরার আহমদ বিশ্বাস করতেন, শায়খুল হিন্দের এ রূপরেখা সঠিক ও যথার্থ ছিল। তিন দফা এ কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতে তিনি সারা জীবন মেহনত করেন।
Asia Times-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদন জানা যায় যে, ১৯৯৫ সালে উত্তর আমেরিকার ইসলামিক সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে ডা: ইসরার আহমদ বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ইসলামের পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়া একান্ত বাস্তব। অমুসলিম বিশ্বের সাথে ইসলামী দুনিয়ার চরম পরীক্ষা ও ইহুদিদের শক্তি প্রদর্শন অত্যাসন্ন। তিনি আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ায় বসবাসরত মুসলমানদের ইহুদি ষড়যন্ত্র মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানান। সতর্ক পর্যবেক্ষকদের কাছে এটি স্পষ্ট যে, বর্তমান শতাব্দীতে ইহুদিরা ঐশী শাস্তিতে বিপর্যস্ত হচ্ছে ও হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ এ ক্ষেত্রে একটি নজির। চূড়ান্ত সঙ্ঘাতে মুসলমানদের হাতে ইহুদিরা একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’
আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে এমন সাহসী বক্তব্য প্রদান চাট্টিখানি কথা নয়। গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের কাছে তার এ বক্তব্য প্রশংসিত হয়। সচেতন মানুষমাত্রই জানেন, ইহুদিরা তাদের প্রোটোকল অনুযায়ী মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবিরত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে দেশে রয়েছে বিভিন্ন সেক্টরে তাদের বৃত্তিভোগী এজেন্ট। ডা: ইসরার আহমদের মতে, “৯/১১ হামলার জন্য ইসরাইল দায়ী ছিল। পাকিস্তান ইসরাইলের ৯ মাস আগে জন্ম নেয়। তার মতে, এটি কাকতালীয় নয়। কারণ নবী সা:-এর একটি বক্তব্য অনুসারে - ‘আল্লাহ চিকিৎসা ছাড়া কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি। পাকিস্তান ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্য একটি ‘প্রতিষেধক’ এবং সত্য ও মিথ্যার চ‚ড়ান্ত সংঘর্ষে ইসরাইলের মুখোমুখি হবে পাকিস্তান।”
ডা: মাওলানা ইসরার আহমদ মনে করেন যে, ‘ইসলামী বিপ্লবী চিন্তাধারার সারমর্ম এ ধারণা নিয়ে গঠিত ব্যক্তিজীবনে ইসলামের অনুশীলন করাই যথেষ্ট নয়, বরং কুরআনের শিক্ষা ও সুন্নাহর শিক্ষাগুলোকেও সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সর্বাত্মকভাবে বাস্তবায়িত করতে হবে। ইসলামী বিপ্লবী চিন্তাধারার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো, পবিত্র কুরআন ও নবী মুহাম্মদ সা:-এর সুন্নাহর মর্মার্থ শর্তহীন উচ্চতায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এই সংগ্রামের লক্ষ্য হলো সত্য জীবন পদ্ধতির (দ্বীন আল-হক) আধিপত্য অর্জন করা, যাতে ইসলামী ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা; যা মানব স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার ও সাম্যের সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সংশ্লেষণকে মূর্ত করে।’
ডা: মাওলানা ইসরার আহমদ দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ২০১০ সালের ১৪ এপ্রিল ৭৮ বছর বয়সে লাহোরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। লাহোরের মডেল টাউন পার্কে নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের তৎকালীন আমির সাইয়েদ মনোয়ার হোসাইন, সাবেক আমির কাজী হোসাইন আহমদ, লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি খাজা মুহাম্মদ শরীফ, জামায়াতে আহলে হাদিসের প্রধান যুবায়ের আহমদ জহির, দারুল উলুম করাচির প্রধান পরিচালক মাওলানা রফি ওসমানীসহ প্রাদেশিক মন্ত্রীরা ও পার্লামেন্টের সদস্যরা নামাজে জানাজায় শরিক ছিলেন।
স্মর্তব্য, ১৯৮৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল কোর্সের গবেষণার উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমার পাকিস্তান সফরকালীন লাহোরে আয়োজিত ডা: মাওলানা ইসরার আহমদ রহ:-এর এক তাফসির সম্মেলনে যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যে হল লোকে-লোকারণ্য হয়ে যায়। তাফসির শোনার জন্য বিপুল মানুষের উপস্থিতি তার গ্রহণযোগ্যতার পরিচয় বহন করে। আমরা এ মনীষীর রূহের মাগফিরাত কামনা করি মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা