বাবা-মার প্রতি উদাসীনতা
- আমীর হামযা
- ০৭ মার্চ ২০২২, ২০:১৮
সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি ছেলে-মেয়েদের নিষ্ঠুর আচরণ বেড়েই চলেছে। কী সচ্ছল, কী গরিব, কী সামর্থ্যবান কী বিত্তহীন, সব ধরনের পরিবারেই বয়স্ক বাবা-মা এখন অবহেলার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বাবা-মা নিজেদের যৌবনকালে সন্তানদের মানসিক ও বৈষয়িকভাবে সক্ষম করে গড়ে তুলতে কী করেন না! সেই তারাই বার্ধক্যে এসে পরিবারের কাছে হয়ে পড়ছেন অপাঙ্ক্তেয়। এসব আমাদের দেখতে হচ্ছে অসহায়ভাবে; যার কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়া সত্যিই দুরূহ। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন নিশ্চয়। আমরা যারা সাধারণ মানুষ যাদের কাঠামোগত জ্ঞান নেই; তারা খাবি খাচ্ছি প্রতি পদে, প্রতিক্ষণে, প্রতি কদমে।
কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধিতে আসতে পারে। প্রথম ঘটনাটি সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। সচ্ছল পরিবারের একাকিত্বে ভোগা অসহায় এক ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। ষাটের কাছাকাছি বয়সের আবু মহসিন খান গত ২ ফেব্রুয়ারি রাতে হৃদয়বিদারক এ ঘটনার অবতারণা করেন। জীবন দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের আত্মঘাতী পথ বেছে নেন তিনি। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন কি না বলা মুশকিল। বলা ভালো, পরিস্থিতি তাকে এ ভয়ঙ্কর পরিণিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। একাই থাকতেন নিজের ফ্ল্যাটে। বাসায় কোনো কাজের লোক ছিল না। বাইরে থেকে খাবার এনে খেতেন। একসময় পোশাক কারখানায় সুতা সরবরাহ করতেন। ঋণে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দেন। অনেকে তাকে করেছেন প্রতারিত। ২০১৭ সালে ক্যান্সার ধরা পড়ে তার। বিদেশে চিকিৎসাও করেছিলেন। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেছেন, তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নন। কত অসহায় হলে এমন কাজ করতে পাবেন একজন মানুষ। তিনি ছিলেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে মাকে নিয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আর মেয়ে ঢাকাই সিনেমার প্রতিষ্ঠিত এক চিত্রনায়কের স্ত্রী।
দ্বিতীয় যে ঘটনার উল্লেখ করছি সেটি একটি হতদরিদ্র পরিবারের করুণ কাহিনী। ‘সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি’- শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ‘৭০ বছর বয়সী মো: সাজেদুল। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল এক ঘোড়ার গাড়ি। সম্প্রতি বাসের ধাক্কায় ঘোড়াটির একটি পা কাটা পড়ে। আয়ের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে এখন দিশাহারা তিনি। বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। এ দম্পতির তিনটি ছেলেসন্তান রয়েছেন। কেউ তাদের খবর রাখেন না’ (৪ মার্চ, প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ)।
সাজেদুলের বাড়ি জামালপুর শহরের ছনকান্দায়। স্ত্রী মেহেরুন বেগম। সন্তানদের প্রতি তার আক্ষেপ অন্তহীন। এত কষ্ট করে তাদের লালন-পালন করে কী লাভ হয়েছে, দীর্ঘশ্বাসে এমন মন্তব্য তার। সরকারি কোনো ভাতাও পায় না এ দম্পতি। সাজেদুলের প্রশ্ন, মানুষ কষ্ট করে কেন সন্তানদের মানুষ করে? বৃদ্ধ বয়সে এসে তিনি দেখছেন কোনো লাভ হয়নি তার। এ বয়সেও দু’মুঠো ভাতের জন্য কতই না কষ্ট করতে হয়। এখন তো পুরো পথ বন্ধ। দিন-রাতে মিলে হয়তো কোনো দিন একবার, হয়তো কোনো দিন দু’বার খান। ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যার আগে ব্যবসায়ী আবু মহসিন খানও নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে পরিবারের প্রতি আক্ষেপ করেছেন।
শুধু দেশ নয়, প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বাংলায় ৫ মার্চ আনন্দ বাজার অনলাইন সংস্করণের খবর- ‘বোঝা হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধা মা, পুড়িয়ে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখলেন ছেলে, সঙ্গী স্ত্রী’। অভিযুক্ত পুত্র ও পুত্রবধূকে আটক করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশের অনুমান, মায়ের ভরণ-পোষণ না করতে হয়, তাই এ খুন। রাস্তায় বৃদ্ধার দগ্ধ দেহ উদ্ধার ঘিরে চাঞ্চল্য দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে। মৃতার নাম সুভদ্রা রায়। বয়স ৭৮। স্থানীয়দের বক্তব্য, দীর্ঘ দিন ধরেই মা সুভদ্রার ওপর অত্যাচার চালাত ছেলে গোপাল রায় ও তার স্ত্রী শিল্পী রায়। প্রতিবেশীরাও একাধিকবার তাদের এ বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এক প্রতিবেশীর ভাষ্য, ‘কয়েক দিন আগে পৌরসভা নির্বাচনের প্রচার চলাকালীন গোপালদের বাড়ি থেকে প্রবল চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাই। আমরা ছুটে এসে দেখি, মাকে ঘরে থাকতে দেবে না বলে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে গোপাল আর তার বউ। এক টোটো চালক বৃদ্ধাকে পাশের পাড়ায় তার মেয়ের বাড়ি রেখে আসেন। পরে শুনেছি, মেয়েও মাকে তার বাড়িতে রাখতে না চাওয়ায় আবার বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন বৃদ্ধা। তার পরেই এ ঘটনা ঘটল।’
বাবা-মার সাথে নিষ্ঠুর আচরণের এমন দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে ভূরি ভূরি। এর পরও বাবা-মার কাছে সন্তান যে কত প্রিয় সেটি উদাহরণ দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে বাবা-মা নিষ্ঠুর আচরণ পেলেও এখনো অনেক পিতা-মাতা সন্তানের জন্য চূড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারে পিছপা হন না। কোনো কার্পণ্য করেন না। একটি খবর দিই। খবরের শিরোনাম- ‘মায়ের কাছে সন্তানের জীবনই আগে : ছেলেকে কিডনিদাতা মা’। ‘৫৪ বছর বয়সী বুলি বেগম ২৪ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ হাসানকে তার একটি কিডনি দিয়েছেন। মায়ের দেয়া কিডনি ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই মা ও ছেলে এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতাসহ শারীরিক জটিলতা থাকলেও তারা হাসিমুখে নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটাচ্ছেন ( প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)।
রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির পর গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (সিকেডি) ভর্তি হন জাহিদ। কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি বিষয় সুরাহার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব প্রক্রিয়া শেষে গত ২২ জানুয়ারি রাতে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার হয়।
চরম ত্যাগ স্বীকারকারী বাবা-মায়ের প্রতি দিন দিন উদাসীন হয়ে পড়ছে অনেক সন্তান। ভোগবাদী জীবন তাদের প্রতি উদাসীন করে তুলছে আমাদের, এ কথা এখন পরীক্ষিত সত্য। পশ্চিমা দুনিয়ায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তানরা কাছে রাখতে চায় না। সেখানে এ সংস্কৃতি পুরনো; কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যবাদী সমাজেও এ বিষবৃক্ষ এখন শিকড় গেড়েছে। ফলে চার পাশে সন্তানের কাছে বাবা-মাকে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে।
এ কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে, দুনিয়ায় বাবা-মা দু’জনই সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের জন্য বাবা-মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। দুনিয়া দেখার উপলক্ষও তারা। সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার সার্বিক বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ ও যত্নশীল তারা। সন্তানের জন্য এতটাই নিঃস্বার্থ যে সবকিছুর ওপর কোনো কাজেই বাবা-মা কখনো কোনো বিনিময় চান না। এ জন্যই প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ বাবা-মার সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। পরিবারেও বাবা-মার মর্যাদা ও সম্মান সবার উপর।
আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তাঁকে (আল্লাহ) ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না এবং বাবা-মার প্রতি উত্তম আচরণ করো। তাদের একজন কিংবা উভয় যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের উফ্ বলো না এবং তাদের ভর্ৎসনা করো না; বরং তাদের সাথে সম্মানসূচক নম্র ভাষায় কথা বলো। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাকো। আর বলো- ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন’ (সূরা বনি ইসরাইল : আয়াত ২৩-২৪)।
সন্তানের কাছে বাবা-মার অধিকার একটি মহান দায়িত্ব। আল্লাহ কুরআনে বাবা-মার হকের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কোনো কিছু শরিক করো না এবং বাবা-মার সাথে সদ্ব্যবহার করো’ (সূরা আন-নিসা : আয়াত ৩৬)। যদিও একজন বিশ্বাসীর কাছে কুরআন সত্যের মানদণ্ড। তা সত্ত্বেও বাবা-মায়ের অধিকার বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন। অনেকেই জানেন না, মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, কর্মক্ষম সন্তানের কাছে তখন তাদের আইনত কিছু প্রাপ্য রয়েছে। প্রচলিত আইনে বৃদ্ধ মা-বাবা তার সাবালক ও কর্মক্ষম সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ও ভরণপোষণে আইনের আশ্রয় চাইতে পারেন। দেশে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ বলবৎ রয়েছে। এ আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে, এ বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে।
কোনো সন্তান তার মা কিংবা বাবা বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করতে হবে। এমন যদি হয়, মা এবং বাবা আলাদা থাকেন, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে উভয়ের সাথে আলাদা করে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতে হবে। মা-বাবা স্বেচ্ছায় অন্য কোনো জায়গায় বাস করলে তাদের মাসিক বা বার্ষিক আয়ের যুক্তিসঙ্গত অর্থ নিয়মিত দিতে হবে সন্তানকে। মা-বাবাকে ভরণপোষণ না করলে এবং আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন না করলে অভিযুক্ত সন্তানের জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
তবে সব থেকে বড় কথা হলো নৈতিকতা। নৈতিকতাই বলে প্রত্যেকের উচিত বাবা-মার যথাযথ অধিকার সংরক্ষণ করা। বাবা-মা যখন বার্ধক্যে পৌঁছেন, তখন তাদের প্রতি ধৈর্যশীল আচরণ করা। কারণ সন্তান শৈশবে যা দেখে সে সম্পর্কেই বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করে থাকে। সে সময় বাবা-মা সন্তানের জিজ্ঞাসায় বিরক্ত না হয়ে ধৈর্যের সাথে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করতেন। কিশোর বয়সে সন্তান যখন কোনো বিষয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত তখনো বাবা-মা সন্তানের ক্ষিপ্ততায় রেগে না গিয়ে ধৈর্য ধারণ করতেন। সুতরাং সন্তানের উচিত বাবা-মা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের সাথে ধৈর্যধারণ করা। এটি সন্তানের কাছে বাবা-মার প্রাপ্য। বাবা-মা যদি কাছে না থাকেন তাহলে তাদের খোঁজখবর নেয়া। এতে তারা প্রফুল্লবোধ করেন, সন্তানের সাথে কথা বলে তারা প্রশান্তি অনুভব করেন। সন্তানের উচিত তাদেরকে কাছে রাখা ও যথাযথ খোঁজখবর নেয়া। তাদের প্রতি গভীর মমতায় মনোযোগ দেয়া।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা