২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেললেও প্লাস্টিক আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনী, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সব ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক মানব সভ্যতার চলমান ধারায় জায়গা করে নিয়েছে। পচনশীল এবং পরিবেশবান্ধব পাটকে টপকিয়ে প্লাস্টিকের সয়লাব সর্বত্র দৃশ্যমান। ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বে উৎপাদিত প্লাস্টিকের পরিমাণ ছিল ৬.৩ বিলিয়ন টন। এর মধ্যে ৯ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে। ১২ শতাংশকে পোড়ানো সম্ভব হয়েছে। বাকি সব সমুদ্রে, নদীতে, পুকুরে, খালে, ডোবায়-নালায় ও আবাদি জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইনসিনারেটর অল্টারনেটিভস-জিএআইএ’র ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রে প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য পতিত হচ্ছে। ফলে সমুদ্রের জলজ প্রাণীগুলো খুব সহজেই হারিয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের পরিচিত প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। ঘরের পাশে খাল, বিল, পুকুর ও নদী প্লাস্টিক বর্জ্যে মৃতপ্রায়। কয়েক বছর আগে বুড়িগঙ্গা খুঁড়তে গিয়ে দেখা গিয়েছিল প্লাস্টিকের সর্বনাশা রূপ। এ কথা নিশ্চয় কেউ ভুলে যাননি।

এক দিকে অপচনশীল প্লাস্টিক জমা হয়ে ভ‚মির রূপ বদলে যাওয়া; অপর দিকে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাবে সমগ্র ভ‚পরিবেশ বিপন্ন। সচরাচর প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যাদি থ্যালেক্স, ভারী খনিজ, বিস্তানল-এ, ননিফেনল, ডাইকোরো-ডাইফেনাইল-ডাইকোরো ইথেন, ফেনানথ্রিন, পলিকোরিন-ডাই-ফিনাইল-ইথার সব কিছুরই পরিবেশ মানুষ এবং পশুপাখির ওপর বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ইলেকট্র্রনিক বর্জ্যরে প্লাস্টিক এখন গোটা দুনিয়ার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত চিকিৎসাসামগ্রী, পানি এবং পানীয় বিভিন্ন ধরনের খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে প্লাস্টিক। রেফ্রিজারেটর, খেলনা ও পিভিসির পাইপ তৈরিতে প্লাস্টিক হচ্ছে মূল উপাদান। প্লাস্টিকের বোতলে অথবা অন্য কোনো পাত্রে বেশিদিন খাবার সংরক্ষিত রাখলে তা রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধিত করে।

মাইক্রো প্লাস্টিক যেটা পাঁচ মিলিমিটারের কম ঘনত্বসম্পন্ন তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ এটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আণুবীক্ষণিক বিষাক্ত পদার্থে পরিণত হয় এবং অতি সহজে মাটি ভেদ করে ভ‚পৃষ্ঠের নিচের পানির আধার বিষাক্ত করে তোলে; মৃত্যু ও ক্যান্সারের ঝুঁঁকি বাড়ায়। এ ছাড়াও প্লাস্টিকের বর্জ্য পোড়ানোর ফলে অদৃশ্য মাইক্রো প্লাস্টিকের কণা ভয়ঙ্করভাবে বায়ুদূষণ ঘটায়, যা নিঃশ্বাস ও প্রশ্বাসের সাথে আমাদের ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি করে। এ ছাড়াও প্লাস্টিকের মধ্যে মাইক্রোবিডস থাকে, যা পরিবেশ দূষণের সহায়ক। এসব মাইক্রোবিডস জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরিবেশদূষণ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ এবং ভ‚মিদূষণের প্রধান নিয়ামক প্লাস্টিক। আবার প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় মিথেন গ্যাসযুক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। গাছপালা, ফসলসহ সব প্রাণীর জন্যই প্লাস্টিক ক্ষতিকর। ক্যান্সার, চর্মরোগ ও শ্বাসনালীর অসুখের মতো অসুস্থতার কারণও এটি। এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে শহরের ড্রেন ও নর্দমাগুলো বন্ধ থাকায় সারা বছরই পানি জমে মশার প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হয়। সৃষ্টি হয় দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসের। মশার প্রজননক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার কারণে ম্যালেরিয়া এবং মশাবাহিত অন্যান্য অসুখের প্রাদুর্ভাব; কিন্তু আমরা সামলাতে পারছি না। অনেকসময় দেখা যায়, বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি অথবা মাছ ছোট ছোট প্লাস্টিকের টুকরা গিলে ফেলে। এগুলো তাদের পেটের ভেতরে জটপাকিয়ে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটায়।

প্লাস্টিক এক দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। অপর দিকে এর ভ‚-প্রাকৃতিক দূষণ আমাদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে। এর দূষণ থেকে বাঁচতে হলে প্লাস্টিক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। প্রয়োজন পরিবেশবিষয়ক ভ্রাম্যমাণ আদালত প্রতিষ্ঠা করা। জনগণকে পাট, কাপড় এবং কাগজের ব্যাগ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক-বিকল্প তৈরির জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। জাপানের শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের পর নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক-সামগ্রী রিসাইকেল করে ব্যবহার করা হয়। ইলেকট্র্রনিক বর্জ্যরে সর্বোত্তম ব্যবহার জাপান দেখিয়েছে গত অলিম্পিকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিক পলিথিন বর্জ্য প্রসেস করে রাস্তা ও ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। আমাদের দেশেও প্লাস্টিক বর্জ্যকে রিসাইক্লিং করে ব্যবহার উপযোগী করা যেতে পারে। ফলে প্লাস্টিক এক জায়গায় জমতে জমতে বিষাক্ত হয়ে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করতে পারে না। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক তৈরি করার উদ্যোগী হওয়া দরকার যেন বারবার এটা ব্যবহার করা যায়। নদী-নালা, খাল-বিল ও আবাদি জমিতে প্লাস্টিক বর্জ্য না ফেলার ব্যাপারে জরুরি আইন প্রয়োজন। প্রয়োজন জনসচেতনতা; ভরাট হওয়া নদী-নালা, খাল-বিল পুনর্খনন করা। স্কুল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ সম্পর্কিত পাঠ্যসূচি সংযোজন করা প্রয়োজন। জনসচেতনতার লক্ষ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত ভ‚মিকা দরকার। দরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ উদ্যোগ। সাথে সাথে স্কাউট, গার্লস গাইড, ফুলকুঁড়ি ও অন্যান্য শিশু-কিশোর সংগঠনকে প্লাস্টিকের ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজে লাগানো যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email- shah.b.islam@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement