১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২ মাঘ ১৪৩১, ১৫ রজব ১৪৪৬
`

দুর্নীতিলব্ধ অর্থের গতিপথ!

-

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদি বাবদ ব্যয়িত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে নির্বাহ করা হয়। রাষ্ট্রের কোষাগারের অর্থের মূল জোগানদাতা দেশের জনমানুষ। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির জীপনযাপন ব্যয় ও অর্থসম্পদ তার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হলে বিশ্বাস স্থাপনের যুক্তিসঙ্গত কারণের উদ্ভব ঘটে যে বাড়তি অর্থসম্পদ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্ম মানে অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যেকোনো কর্ম, চাকরি বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম হিসেবে ঘোষিত কোনো পদ। দেশের সংবিধানে প্রদত্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মের বর্ণিত সংজ্ঞাটি এত বিস্তৃত যে সর্বোচ্চ পদধারী রাষ্ট্রপতি এবং সর্বনিম্ন পদধারী অফিস সহায়ক এর মধ্যে স্থিত সব পদধারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মের অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বেতন, ভাতা ও সুযোগসুবিধাদির অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগার হতে প্রদান করার কারণে তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় ও জ্ঞাত সম্পদবহির্ভূত অর্থ বা সম্পদ অর্জনের উত্থাপিত অভিযোগ প্রজাতন্ত্রের অসামরিক বা সামরিক কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মতো দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর অধীন বিচার্য।

পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ প্রণীত হয়। পরবর্তী সময়ে এ আইনসহ দণ্ডবিধির অধীনে কৃত কতিপয় অপরাধ দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৫৭ এর অধীনে শাস্তিযোগ্য করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যুরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে না পারায় এবং কার্যকর ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সরকারের পূর্বানুমোদন বাধা হিসেবে দেখা দেয়ায় দীর্ঘ দিন যাবৎ দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমকে সার্থকভাবে প্রতিরোধের লক্ষ্যে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা অনুভূত হতে থাকে। এরই ফলেই দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর মাধ্যমে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ কমিশন তিনজন কমিশনার সমন্বয়ে গঠিত এবং কমিশনারদের মধ্য হতে যেকোনো একজনকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা পরবর্তী দেশের জনমানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে দুর্নীতির মাত্রায় হ্রাস ঘটে সহনীয় মাত্রায় চলে আসবে যা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য সহায়ক হবে। কিন্তু কমিশন প্রতিষ্ঠা পরবর্তী দেখা গেল দুর্নীতির মাত্রায় হ্রাস না ঘটে প্রতি বছরই তার পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি ঘটেছে।

বাংলাদেশ অভ্যুদয় পরবর্তী উন্নয়ন বাজেটের অর্থ বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক ঋণ হতে সংস্থান করা হতো। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির সাথে উন্নয়ন প্রকল্পে বৈদেশিক অনুদানের ওপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং বর্তমানে তার পরিমাণ নগণ্য। বর্তমানে দেশের উন্নয়ন বাজেট প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ উন্নয়ন বাজেটের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হলে পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশের অবয়বে আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয় হওয়ার কথা। জনমনে এমন বিরূপ ধারণা রয়েছে যে উন্নয়ন বাজেটের ৪০-৬০ শতাংশ অর্থ অনুমোদন, তত্ত্বাবধান ও বাস্তবায়ন পর্যায়ে লোপাট হয়। এ লোপাটের বড় অংশ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত সরকারি চাকরিজীবী এবং জাতীয় ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পকেটস্থ হয়। অতি সম্প্রতি ইতঃপূর্বে মন্ত্রিপদে আসীন ছিলেন এমন একজন জাতীয় জনপ্রতিনিধিকে বলতে শোনা গেল দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত প্রকৌশলী ও চিকিৎসকরা উন্নয়ন বাজেটের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লোপাটের সাথে জড়িত।

তিনি অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ সংশ্লিষ্ট দু’টি প্রধান সংস্থার প্রকৌশলীদের ঢালাওভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত উল্লেখে বলেন, প্রতি বছর উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ১৫ ভাগ অর্থ এদের করায়ত্ত হয় যার পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা। তিনি এমনও বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ পরবর্তী প্রথম মাসের বেতন প্রাপ্তির আগেই তাদের সাথে অবৈধ উপার্জিত অর্থের দেখা মেলে। এ কথাটি অনস্বীকার্য যে উন্নয়ন বাজেটের অর্থ লোপাটের কারণে আমাদের উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট কোনো কাজই টেকসই হয় না। এতে দেশের অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি জনমানুষের ভোগান্তি ও পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে। যে জাতীয় জনপ্রতিনিধির মুখে দুর্নীতিবিষয়ক বাক্যগুলো উচ্চারিত হয় তার বিষয়ে অভিযুক্তরা আক্ষেপ করে বলেন, নির্মাণ ঠিকাদারের অংশী ও সুবিধাভোগী হিসেবে অবৈধ উপার্জন ও লেনদেন এর সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই এ কথা কি তিনি অস্বীকার করতে পারবেন?

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদধারী এবং সরকারের শীর্ষ নির্বাহীকে সময়ে সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ লোপাটে আক্ষেপ করতে শোনা গেলেও তার প্রতিবিধানে কার্যকর উদ্যোগের অনুপস্থিতি সমস্যাটি সুরাহার পথে ফলদায়ক হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, দফতর ও সংস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি সবার একটি বড় অংশ সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ায় প্রত্যাশী সেবাগ্রহণকারীদের দক্ষিণা প্রদান ব্যতিরেকে কোনো কাজের সুরাহা হয় না।

প্রতি বছর উন্নয়ন বাজেট এবং কার্য সমাধার নামে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ অবৈধ অর্থ আহরণ করেন তা কোনো অংশে দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে কম নয়। এ অর্থের একটি বা সম্পূর্ণ অংশ অবৈধ উপার্জনকারীদের একাংশ দেশের অভ্যন্তরে নামে-বেনামে ভ‚মি, ফ্ল্যাট বাড়ি, ব্যবসায় ব্যয় করেন আর অপরাংশ অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দেশের বাইরে হুন্ডি বা মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে পাঠিয়ে তথায় চাকরি বা রাজনীতি হতে অবসর-পরবর্তী সুখের নীড়ে জৌলুশপূর্ণ জীবনযাপনের আশায় অর্থ সম্পদ পুঞ্জীভ‚ত করেন।

সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দেশে প্রভ‚ত অগ্রগতি হয়েছে যদিও বাস্তব চিত্র ভিন্নতর। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় নিজ খরচে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য উন্নত দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। দেশের প্রতিটি উপজেলা ও জেলা শহরে একাধিক সরকারি ও বেসরকারি মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণীর জনমানুষ যাদের উপার্জনের বড় অংশের জোগান আসে দুর্নীতিলব্ধ অর্থ থেকে, তারা মনে করেন তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ থেকে বিদেশ অধিক উত্তম। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য দেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যায় এ অর্থ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে ব্যয় করা গেলে এমন অর্থ পাচার রোধে কিছুটা হলেও ছেদ পড়ত।

আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবা উন্নত দেশের সমপর্যায়ের এ অজুহাতে সম্প্রতি দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দেয়া হয়নি অথচ এর কিছু দিন পর দেখা গেল ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা বলে পাশের দেশের রাজধানীতে আকস্মিক ছুটে গেলেন। তা ছাড়া প্রায়ই দেখা যায় দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত, সচরাচর যাদের মুখ থেকে এ কথাটি উচ্চারিত হয় তারা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল নন। শুধু জটিল রোগ নয়, নিয়মিত পরীক্ষার ক্ষেত্রেও দেখা যায় এরা বিদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিরা প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশে ব্যয় করেন এ অর্থ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যয় করা হলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা যেমন সমৃদ্ধ হতো এর পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনমানুষ দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি আস্থাশীল হতো। আমাদের নিকটবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার কিছু রাষ্ট্র যেমন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতির শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব আমাদের চেয়ে পিছিয়ে ছিল। দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এ দেশগুলোর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত আজ আমাদের চেয়ে উন্নততর।

আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ এবং অসামরিক-সামরিক পদস্থ ব্যক্তিরা ও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের অনেকেই তাদের দুর্নীতিলব্ধ আয়ের একটি বড় অংশ দেশের বাইরে পাচার করে সেখানে পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া ও স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য সম্পদ আহরণে সচেষ্ট। এরা প্রতি বছর কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করছেন এর সঠিক হিসাব আমাদের কাছে না থাকলেও অর্থপাচারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রেটির তথ্য মতে গত অর্ধ-দশকে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকার কম নয়।

আমাদের দেশে উন্নয়নের নামে যেসব প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে অথবা চলমান রয়েছে এগুলোর ব্যয়ের তুলনামূলক হিসাব অনুসন্ধানে জানা যায়, আমাদের প্রকল্পগুলো বিশ্বের অপর যেকোনো দেশের তুলনায় অধিক ব্যয়বহুল। এ অধিক ব্যয়ের অর্থের সুবিধাভোগী কারা তা দেশের সাধারণ জনমানুষের অজানা নয়; কিন্তু এরা ক্ষমতাসীন বা তাদের ছায়াতলের ব্যক্তিরা হওয়ায় দেশের আইন ও শাসনব্যবস্থা তাদের কাছে অসহায়।

প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিদের দুর্নীতি রোধে দুর্নীতি দমন কমিশন নামক যে সংস্থাটি বিগত দেড় যুগ ধরে তার কার্যক্রম চলমান রেখেছে তার দ্বারা দুর্নীতি দমন বা প্রতিরোধে তারা সফল নাকি বিফল তা দুর্নীতির ক্রমবৃদ্ধির চিত্র থেকে অনুধাবন করা গেলেও এ ব্যাপারে সংস্থাটির দায়িত্বশীল পদে আসীনরা দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরায় বা পাচাররোধে বা পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনায় দেশের সাধারণ জনমানুষের মধ্যে যে আশার সঞ্চার করেছেন সেটি লক্ষণীয় নয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
আন্দোলনরত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় ছাত্রদলের নিন্দা ফের ইউরোপের মাঠে ফিরতে যাচ্ছে মেসি! জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় সম্মেলন বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সাথে আপসের কোনো সুযোগ নেই : প্রেস সচিব গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল আমদানি খরচ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা খসড়া তালিকায় আল আমিন-জীবনরা এনআইডি সেবা হাতে রাখতে প্রধান উপদেষ্টা ও তিন মন্ত্রণালয়কে ইসির চিঠি বিশ্বকাপ খো খো : কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অগ্নি-প্রতিরোধ মহড়া ১৯ জানুয়ারি পাটগ্রামে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় মদের বোতল দিল বিএসএফ

সকল