২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আল্লামা ইকবালের চিন্তাশিখা

আল্লামা ইকবাল - ছবি - সংগৃহীত

আল্লামা ইকবাল উপমহাদেশের মুক্তিকামী মানুষের আত্মজাগরণের পথিকৃৎ এক মহান কবি দার্শনিক ও শিল্পী-প্রতিভা। তার সৃষ্টি, শিক্ষা, দৃষ্টি ও আদর্শের মধ্যে আমাদের জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের স্বভাব ও স্বরূপ অসামান্য উজ্জ্বলতায় উৎকীর্ণ। ফলে ইকবাল সত্তায় কেবল এক কবির বসবাস নয়, বরং রয়েছে এক মহান আদর্শের উত্তরাধিকার।

তার আবির্ভাব ছিল উপমহাদেশের ঘোরতর দুঃসময়ে ত্রাণকর্তার মতো। তার স্বতন্ত্র, দুঃসাহসী উচ্চারণ চুরমার করতে চেয়েছে পরাধীন মানুষের হীনম্মন্যতার দেয়াল। তাদের চেতনার ঠাণ্ডা আকাশ মুখর করে তুলেছে তার চিন্তার জ্যোতিষ্কের কোলাহল। ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম চেতনাসীমায় ইকবালের কবিতা ছিল স্বপ্নের পুনরুত্থানের মতো। তার চিন্তাধারা ছিল স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা নবজন্মের ইশতেহার। ক্ষুদ্রতার, সঙ্কীর্ণতার, সংস্কারের সব প্রাচীরের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তার কবিতা।

ফলে সেই কবিতার জগৎ ছিল গতির গমক, চিন্তার চমক ও দ্রোহী পদক্ষেপে প্রকম্পিত। ইকবালের কবিতায় কান পাতলেই মানবাত্মার কুচকাওয়াজের শব্দ শোনা যায়। শোনা যায় বসন্তের হাসির মতো ছলকে ওঠা শিল্পের স্রোতের স্বনন। চোখ মেললেই দেখা যায়, উদ্দাম কস্তুরিমৃগ বাতাসের অরণ্যে বিচরণ করছে, মহামানবিকতার চকচকে অঙ্গীকার সূর্যের আগুনে পতাকার মতো লাগছে, তার পতপত আন্দোলনে গুঁড়ো রোদের মতো ছিটকে পড়ছে ইতিহাস।

ইকবালের দর্শন নিয়ে কথার ওপর কথামালা হয়েছে প্রচুর। তার জীবনবোধ, আত্মোপলব্ধি, চিন্তা ও পয়গামের বিষয়টি এখন আর অগম্য নয়। ইকবাল কাব্যের অনুবাদের মাধ্যমে বাংলাভাষী পাঠক পরিচিত হয়েছেন তার ভাবনাবলয়ের সাথে। কিন্তু অনুবাদ থেকে যে জিনিসটি তারা পাননি, সেটা হলো ইকবাল-কাব্যের ঐন্দ্রজালিক শিল্প ও সৌন্দর্য। কারণ, বাংলা ভাষায় যারা ইকবাল-কাব্যের অনুবাদ করেছেন, তাদের অনেকেই সৃজনক্ষমতার অভাবে কিংবা আক্ষরিকভাবে মূলানুগ হওয়ার মূঢ় বাসনায় উদ্দীপিত হয়ে ইকবালের কবিতার বিপর্যয় ডেকে এনেছেন।

অমীয় চক্রবর্তী, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখের কয়েকটি অনুবাদ ছাড়া অন্যান্য অনুবাদে দার্শনিক ইকবালকে পাওয়া যায়, কিন্তু কবি ইকবালের দেখা মেলে না। অথচ দার্শনিক ইকবালের চেয়ে কবি ইকবালের মহিমা কোনো অংশেই কম নয়। কাব্য সৌন্দর্যে তিনি বিশ্বসাহিত্যে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তার কবিতার সেই সৌন্দর্যের স্বরূপ কী? বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি অমীয় চক্রবর্তীর ভাষায়, ‘তাহার কবিতায় শিল্পী ও স্রষ্টার সম্মিলন ঘটিয়াছে। ফারসি ও উর্দু উভয় ভাষারই চোস্ত ও সুমার্জিত কবিতায় ইকবাল মিনারেটসগুলোর সুদূরবর্তী ইশারা ও আরবীয় মরু বালুকার চাকচিক্যময় স্বপ্ন আমাদের চোখে জাগাইয়াছেন।

জীবনের বাস্তবতার পটভ‚মিকায় নীলিম নিঃসীমতা যেন এখানে গলিয়া পড়িতেছে। তাহার রহস্যবাদ জীবনের সম্মুখীন হইয়াছে, তবু ইহা যেন রহস্যের অতলতাকে স্পর্শের জন্য ব্যাকুল। তাহার ভাষায়ও প্রাঞ্জল শব্দাবলি যেন অগম্য অতলতাকে প্রকাশিত করিয়া দিতেছে। সুদক্ষ জহুরী যেভাবে স্বর্ণ ও মূল্যবান প্রস্তরাদি চয়ন করিয়া থাকে ইকবালও তেমনই সতর্কতাসহকারে শব্দ চয়ন করিতেন। তবুও তাহার শৈল্পিক নৈপুণ্য ও ভারসাম্য রক্ষার অন্তরালে স্রষ্টার বাস্তবতাবোধ প্রভমান।’ (ইকবাল, অমীয় চক্রবর্তী, মুহম্মদ হাবীবুল্লাহ বাহার সম্পাদিত কবি ইকবাল বুলবুল হাউস, কলকাতা)

তিনি আরও লেখেন, ‘কবি ইকবালের কাব্যকাননে বিচরণ করলে সৌরভিকুঞ্জ দেখতে পাব, খররৌদ্র ধূলিতে শ্যামল মেলে আছে, অগণ্য মনোহর বীথি আহ্বান করে নিয়ে যায় গভীর ভাবনার নির্দেশে। বাক্যের ভঙ্গির রসের উচ্ছল মাধুর্য এবং দিগন্ত দৃষ্টিময় ব্যঞ্জনা তার বহু কবিতায় ঔৎকর্ষের যে ভাষা পেয়েছে, তা উর্দু বা পারসিক ধ্বনিকে অতিক্রম করে সর্বমানবের চিত্তচারী।’ (সাম্প্রতিক; পৃষ্ঠা: ১২৯)

ইকবালের কাব্য সম্পর্কে প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ বলেছেন, ‘ইকবালের বাণীর প্রাণ ও শক্তির উৎস হচ্ছে তার কাব্য-সৌন্দর্য। ইকবালের মতো আর কোনো কবি উর্দু কবিতায় ব্যঞ্জন ও স্বরবর্ণের এতখানি ধ্বনিবৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পারেননি। এ পদ্ধতির তিনিই উদ্গাতা। উর্দুকাব্যে তিনি নতুন ছন্দ প্রবর্তন করেন, প্রথম সার্থকভাবে নামবাচক বিশেষ্য ব্যবহার করেন এবং অসংখ্য নতুন শব্দ আমদানি করেন। ইকবালের অন্বেষা হলো বিশ্বজগৎ ও মানুষ, বিশ্বজগতের মুখোমুখি মানুষ। তার কবিতার শেষ কথা হলো : মানুষের কথা, মানুষের বিশ্বের কথা, মানুষের একক মর্যাদার কথা। এই মূল্যবোধ ইকবালের কবিকৃতীকে একক মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।’ ইকবালের নির্বাচিত কবিতা, মুহম্মদ মাহফুজ উল্লাহ লিখিত ভূমিকা, পৃ. ৯)

ইকবাল তার এই অবিস্মরণীয় মূল্যবোধ গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম থেকে। ইসলামের সারসত্যকে ঋজু, চৈতন্য উদ্দীপক ও মর্মস্পর্শী আঙ্গিকে তিনি উপস্থাপন করেছিলেন।

সেই উপস্থাপনা ছিল যুগপৎ শৈলী ও বক্তব্যে সমানভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত। কবিতার ঐশ্বর্যসন্ধানে আদর্শকে গৌণ করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না আল্লামা ইকবাল। তিনি কবিতার প্রাণ হতে পারে, এ জন্য মানবকল্যাণের মহীয়ান আদর্শ তালাশ করেছেন। এ লক্ষ্যে হাত বাড়িয়েছিলেন পাশ্চাত্যের কাব্যদর্শনের দিকে। কিন্তু সেখানে খুঁজে পাননি কাম্য আদর্শ। ইকবালের ভাষায় সেই দর্শন--
‘নিজের ছোরায় নিজেই করিবে আত্মহত্যা
পলকা ডালে যে বাসা বাঁধা হয়, সে হয় না চিরস্থায়ী।’

ইকবাল সেখানে বাহারি চাকচিক্য ছাড়া মানবজীবনের কোনো মৌল আদর্শ খুঁজে পাননি। অতএব এর পেছনে সময়পাত করে ইকবালের আক্ষেপ- ‘ইউরোপের ঐ শরাবখানায় কাটিয়েছি দীর্ঘকাল/লাভ তো কিছু হয়নি তাতে শিরঃপীড়া বাড়লো ছাড়া।’

পশ্চিমা জীবনদর্শন পঠন-পর্যবেক্ষণের পর ইকবাল আত্মনিয়োগ করেন ইসলামের অন্তঃসমীক্ষায়। সেখানে তিনি আবিষ্কার করলেন মানবিক কাব্যাদর্শের আবেহায়াত। সেই আদর্শের প্রতি ইকবালের বিশ্বাস ছিল দৃঢ়। এ ক্ষেত্রে কারও ভ্রূকুটির তোয়াক্কা করতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। তার স্পষ্ট ঘোষণা--
‘ইউরোপ বিরক্ত হলে হোক শুনে ইসলামের নাম
সঙ্কটে স্বনির্ভরতা এই সেই রূহের পয়গাম।’

রুহের পয়গাম দ্বারা কবিতাকে কিভাবে সার্থক করে তুলতে হয়, ইকবাল তা দেখিয়েছেন কালোত্তীর্ণ সব কবিতার পটভূমিকায়। যারা কবিতাকে কোনো মৌল আদর্শের বুনিয়াদ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন, ইকবালের দৃষ্টিতে তাদের কবিতা হলো পুরোহিতের আত্মার মতো জীবনের অসুস্থতা।

যারা বলেন, কবিতা কেবল শিল্পের কাছে দায়বদ্ধ, আদর্শের কাছে নয়, তাদের কবিতাকে ইকবাল কুষ্ঠরোগাক্রান্ত মাংস বলে অভিহিত করেন। আদর্শের প্রশ্নে ইকবাল ছিলেন অনড়। ফলে তার কবিতার শিল্পসুষমা পাঠককে শুধু তাৎক্ষণিক আবেগে উদ্দীপিত করে না, এবং মহান এক জীবনীশক্তির পয়গামে তাকে উজ্জীবিত করে। ইকবাল চান কবিতা যেন প্রেম-বিরহ ও হৃদয়ভঙ্গজনিত করুণ অস্থায়ী সংবেদনসমূহে আবদ্ধ না থাকে। কবিতার লক্ষ্য হবে এমন অসাধারণ শিল্পসৃষ্টি, যা থেকে বিকীর্ণ হবে অনন্ত আলোর ফোয়ারা, প্রবাহিত হবে সৌরভের এমন ঘর ঝরনাধারা, যার সংস্পর্শে আসামাত্রই মনে হবে :
‘শিল্পীদের সৃষ্টিগুলো ফেরদৌসের সমতুল্য
উন্মুক্ত হলো অস্তিত্বের গোপন ভাণ্ডারের আবরণ’

কবিতা শিল্পসাফল্য পেলেই পুলকিত হন না; বরং স্বকীয় জীবনাদর্শের প্রবাহধারাকে জাতীয় জীবনে প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত তার কবিতা বিলাপ করতে থাকে। ইকবাল বলেন, ‘মাঁয় বুলবুলে নালা হো এক উজড়ে গুলিস্তাঁ কা’

আমি শূন্য পুষ্পকাননের এক বিলাপকারী বুলবুলি। কেন সেই বিলাপ? কারণ, ইকবাল দেখেছেন মুসলমানদের ‘কলব মে সোজ নেহি, রুহ মে ইহসাস নেহি।’ আত্মার মধ্যে আন্দোলিত প্রাণবান কোনো অনুভূতি নেই। দিলের মধ্যে নেই কোনো তীব্র দহন। এই প্রাণহীনদের মধ্যে ইকবাল খুঁজে পান না সত্যিকার মুসলমানের অবয়ব। তিনি বলেন--
‘শোর হায় হো গায়ে দুনইয়া সে মুসলমাঁ না বুদ
হাম ইহ কাহতে হায় কে থে ভী কহী মুসলমাঁ মৌজুদ?’

আওয়াজ উঠেছে ধ্বংস হয়ে গেছে মুসলমান। আমি বলি, পৃথিবীতে মুসলমান কোথায়? আত্মবিস্মৃত, পরানুকরণবাদী, নির্জীবদের ইকবাল ইসলামের প্রতিনিধি ভাবতে রাজি নন। তারা জীবনের কর্তব্য থেকে পলায়ন করে খোদার খেলাফতের যিম্মাকে অবজ্ঞা করেছে। ফলে খোদা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কারণ, ‘খোদা-ই জিন্দাহ, জিন্দাহ কা খোদা হায়।’ জীবিত খোদা জীবিতদেরই খোদা।

ইকবালের চিন্তার মুখচ্ছদে দার্শনিক নিৎশে এবং বার্গসৌঁ-এর ছায়া দেখতে চেয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু ইকবালের মুর্শিদ বা ভাবগুরু হচ্ছেন জালালুদ্দীন রুমী। আত্মায় ছিল ওহির প্রাণশক্তি। ওহির আলোয় বিধৃত কর্মবাদ এবং পাশ্চাত্য দর্শনের মধ্যে গভীর ঐক্য উপলব্ধি করেছেন তিনি। কিন্তু ওহির সত্যে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ, আধুনিক সভ্যতা সেই আলোকসম্পদ থেকে বঞ্চিত। সেখানে জীবনের গতি ও কর্মের কোলাহল তীব্র। কিন্তু হৃদয়সম্পদে রিক্ততা। মুসলিম জাহানে অধ্যাত্মবোধের ঐতিহ্য ও অনুশীলন রয়েছে। কিন্তু গতিহীনতা, সৃজনশূন্যতা ও কর্মের দুনিয়ায় রিক্ততা এখানে স্থিরচিত্র হয়ে আছে। উভয়টাই জীবাণুর মতো বিপজ্জনক। উভয়টাই পরিহারযোগ্য। একমাত্র পরজগৎ ইসলামের মুখ্য নয়। কিন্তু মুসলিম মন পার্থিবতা থেকে কেন পলায়ন করছে? এই পলায়ন, এই অপার্থিবতা ইহজগতে তাদের কদমকে করছে দুর্বল। ইহজগতে যারা আল্লাহর খলিফা হবে, তারা এখানে পলায়নের জীবন বেছে নিয়ে আত্মশক্তিকে করছে হত্যা, কর্মের পথে হচ্ছে না সক্রিয় ও উদ্দীপিত। ফলে আধ্যাত্মিক সম্ভাবনাগুলোও মুসলিম জীবন ও সমাজে আপন মহিমা নিয়ে কল্যাণের সুফল প্রদর্শন করতে পারছে না। এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন ইহকাল ও পরকালের মঙ্গলপ্রয়াস একই সাথে পরিচালিত হবে। এরই মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে মানুষের আত্মবিকাশ। তৈরি হবে এমন সমাজ, যেখানে মানুষের সব সামর্থ্য পেখম মেলবে উচ্চতা ও পূর্ণতায়। এমন এক সমাজ কখনো কেবল অতীত দিয়ে তৈরি হবে না। অতীত-বর্তমানের সুষম সমন্বয় হতে হবে ভবিষ্যতের প্রয়োজনে। এই সমন্বয় থাকলে বিকাশ ঘটবে খুদির, ব্যক্তিত্বের। তার এক ডানায় থাকবে মহান অতীতের ঐতিহ্যসম্পদ, আরেক ডানায় থাকবে ভবিষ্যতের সীমাহীন সম্ভাবনা। বস্তুত খুদির বসবাস বর্তমানে। তার কাছে অতীত ও ভবিষ্যৎ হচ্ছে এক জীবন্ত বর্তমান। তারা চোখ মেলে হাঁটাচলা করছে বর্তমানের ভেতর। নিঃশ্বাস নিচ্ছে, যাপন করছে জীবন। তাই বর্তমানকে পেতে হবে আগামীকালকে পেতে হলে। বর্তমানকে জাগাতে হবে, যদি অতীতকে শব্দ-বাক্যের কবর থেকে বাস্তবের দুনিয়ায় জাগিয়ে তুলতে হয়!

অন্ধ অনুকরণ এই পরম জাগৃতি ও সম্ভাবনার শত্রু। চিত্তের মুক্তি খুদির জন্য জরুরি। চিত্ত মুক্ত হবে, কিন্তু স্বেচ্ছাচারী হবে না। অতএব ইকবালের খুদির দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ইনসানে কামিল বা পরিপূর্ণ মানুষ। সেই মানুষকে আবার তিনি বলেছেন মর্দে মুমিন। যে বিশ্বের মধ্যে হারিয়ে যায় না, বরং বিশ্ব তার মধ্যে হারিয়ে যায়। বাস্তবতায় সে ভেসে যায় না, বরং সে নির্মাণ করে নতুন বাস্তবতা। সে গতিমান, ক্রমবর্ধমান, সাধনামগ্ন, সদাসক্রিয়। তার সক্রিয়তা মহোত্তম আদর্শের নির্দেশে মানুষ ও মানুষের পৃথিবীর সুদিন রচনা করে!

এর মানে স্পষ্ট। ইকবালের মর্দে মুমিন কেমন মানুষ, তা অবোধগম্য নয়। সে নিজে শুধু জীবন্ত নয়, জীবনের বিকাশ, বিস্তার ও সমৃদ্ধির নায়ক ও চালক। নিজেকে সে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেয় না, কর্মভাগ্যকে আপন সত্তার শক্তিতে চালিত করে সেই পথে, যে পথ এগিয়ে গেছে তার স্বপ্ন ও অভিপ্রায়ের দিকে। তাকদিরের স্রষ্টা খোদা তায়ালা তাঁর এই ইচ্ছাশক্তির উজ্জীবনকে দেন স্বাধীনতা ও ক্রমবিকাশ। অতএব বিকাশের ধারায় নিজের খুদিকে নিয়ে যাও পরম উচ্চতায়। ইকবালের ভাষায়--
খুদি কো বুলন্দ কর ইতনা কে হর তাকদির ছে পেহলে
খোদা বান্দেছে খোদ পুঁছে, বাতা তেরি রেযা কিয়া হ্যায়!

অর্থাৎ খুদিকে এতটাই সমুন্নত করো; যেন প্রতিবার ভাগ্য লেখার আগে খোদা তোমাকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বলো, কী তোমার অভিপ্রায়?’

খুদির দাবি মহিমার ধারায় অব্যাহত মুক্তি, অব্যাহত উন্নতি, অব্যাহত প্রসার। গতি, উন্নতি ও আত্মশক্তি থেকে রিক্ত যারা, তারা জীবন্মৃত। এমন মুসলমানদের জন্য ইকবালের প্রার্থনা--
‘ইয়া রব। দিলে মুসলিম কো ওহ জিন্দাহ তামান্না দে
জো কালব কো গরমা দে, জো রোহ কো তড়পা দে’

হে রব! মুসলমানদের অন্তরে তুমি জীবন্ত উদ্দীপনা জাগিয়ে দাও। কলবকে যা উত্তপ্ত করে, উজ্জীবিত করে নির্জীব আত্মাকে।

ইকবালের এই প্রার্থনা হলো চৈতন্যময় আত্মার এক পরম আলোর দিকে তন্ময় ও নিরন্তর ঊর্ধ্বারোহণের সবাক চিত্র। যেখানে কবি আত্মার উদ্ভাসনে মুসলিম জাতিগোষ্ঠী মহামানবতার সূর্যের জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাসী। সেটা নিশ্চিত করবে ইসলাম। কারণ, ইসলাম নামক--
‘আকাশের উপত্যকায় সূর্যদীপ্ত কতো জ্যোতিস্রোতের বৈভব
বিচ্ছিন্ন সূর্যের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এ যেন ঘনিষ্ঠ কোলাকুলি
পশ্চিম জানি কখনো পাবে না সেই আলোকের ছটা
যন্ত্রোত্থিত ফিরিঙ্গির ধূম্রজটাজালে
সেখানে আকাশজুড়ে অন্ধকার শুধু আচ্ছন্নতা।’

অন্ধকারের এই আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠে মুসলমানদের আত্মপরিচয় ও স্বকীয় শক্তি নিয়ে জেগে ওঠার আহ্বান তিনি শুনিয়েছেন :
‘তুমি এক তরবারি, নিজের খাপ থেকে বাইরে এসো
বাইরে এসো, বাইরে এসো, বাইরে এসো
সম্ভাবনাকে ঢেকে ফেলা সব পর্দা ফেলো ছিঁড়ে
চন্দ্রকে নাও, সূর্যকে ধরো, নক্ষত্রকে পুষো।’

ইকবাল বিশ্বাস করতেন তার বিস্ময়কর কাব্যমহিমায় মুসলিম চৈতন্যে গোলাপের শিখা জ্বলবে। বসন্তের ফুলের মতো তারা জেগে উঠবে। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন চতুর্দিকে এই সম্ভাবনা। ইকবাল নিজেকে সম্বোধন করে বলেন--
‘তোমার অগ্নিনিঃশ্বাসে গোলাপের শিখা জ্বলছে
হে বাগানের পাখি,
এটাই হলো তোমার গানের পুরস্কার!’
আরেকটি কবিতায় তিনি বলেন :
‘আমি বসন্তের সুরেলা নকীব
আমার মনের চারধারে প্রেমের শিখা জ্বলছে
আজ আমি একা বলে উপেক্ষা করো না
পেছনে আমার ফুলের কাফেলা আসছে’

মানবিকতার নিশানবরদার হিসেবে ইসলামের অনুসারীদের সম্বোধন করে কথা বললেও ইকবালের লক্ষ্য ছিল সব মানুষের কল্যাণ ও বিশ্বজনীন শুভেচ্ছা। তার এই আদর্শবাদিতা ছিল না কোনো সা¤প্রদায়িকতার বার্তাবাহী। মানবতার এই মহান কবিগুরু সর্বত্রই বরেণ্য; কী প্রাচ্যে, কী পাশ্চাত্যে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালতের বিচারপতি উইলিয়াম ডগলাস ইকবালের সমাধি দর্শনের অভিজ্ঞতাকে তীর্থযাত্রা বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, ‘ইকবাল ছিলেন সব জাতির, তার ভাবনার বিশ্বজনীন আবেদন রয়েছে। তিনি সব দেশের, সব ভাষার মানুষের শুভেচ্ছার মানসিকতাকে লক্ষ্য করে কথা বলেছেন। তিনি মানুষের নিত্য-নৈমিত্তিক জীবনাচার থেকে নিয়ে মানুষের স্রষ্টা মানুষের বিশ্বজগৎসহ অনেক কিছুর গান গেয়েছেন। তার সুরে রয়েছে দার্শনিকতার অনবদ্য ঝঙ্কার। নতুন পথে ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য তার ছিল সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব। সেই প্রস্তাব ইকবালের গদ্যে, অভিভাষণে, ছন্দসিক্ত কাব্যে শিখায়িত। যা আজকের দুনিয়ায় সাধারণভাবে মানবসত্তা ও মানবমূল্যের অবনমন ও অবক্ষয় এবং বিশেষভাবে মুসলিম জীবনভাবনা ও জীবন-অনুশীলনে ক্রমবর্ধমান বিনষ্টির প্রেক্ষাপটে আপন গুরুত্বের পতাকা উড়াচ্ছে পতপত করে!
আমরা খেয়াল করছি কি?

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement