২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চিকিৎসার সুযোগ পাওয়াটা কি সোনার হরিণ

-

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় নগরীগুলোর নাগরিকরা প্রধানত বায়ুদূষণ ও অন্যান্য দূষণজনিত কারণে এবং স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে পানাহার করা, টেনশনে থাকা, অখাদ্য-কুখাদ্য গ্রহণ আর দেশের অন্যত্র প্রায় অভিন্ন কারণেই বহুসংখ্যক মানুষ সাধারণ রোগ-শোকে ভোগাসহ মারাত্মক সব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছেন বা হতে চলেছেন। বিশেষ করে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, বহুমূত্রসহ অনেক সব মারাত্মক অসুখে ভুগছে বহু মানুষ। এ রোগীদের মধ্যে কেউ চিকিৎসা নিচ্ছে আবার অনেক রোগাক্রান্ত মানুষ আর্থিক অসামর্থ্যরে কারণে চিকিৎসা নিতে পারছে না। সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র তথা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ক্ষেত্রে সব কিছুর অপ্রতুলতার কারণে সেখানেও যথাযথভাবে চিকিৎসা নেয়া সম্ভব হয় না। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা নেয়া ব্যয়বহুল বিধায় সাধারণের পক্ষে সেখান থেকে চিকিৎসার সুযোগ নেয়া সম্ভব নয়। দেশের চিকিৎসা নেয়ার সুবিধা থাকার পর সামর্থ্যবান, তথা যাদের অর্থবিত্তের কোনো কমতি নেই, তারা আরো উন্নত চিকিৎসা পেতে দেশের বাইরে যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত এসব দেশে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। এটা ঠিক, উল্লিখিত দেশগুলোতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার কারণ অবশ্য আছে, সেসব দেশে সর্বাধুনিক চিকিৎসাসরঞ্জাম, সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, আর স্বনামখ্যাত বহু চিকিৎসকের সেবা নেয়া সম্ভব হয়। এসবের অভাব যে আমাদের রয়েছে তা স্বীকার করে নিতে হবে। আসলে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে।

তা ছাড়া দেশে যেমন চিকিৎসকের কমতি রয়েছে, তেমনি বিজ্ঞ অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অভাবও আছে; যাও আছে, তা সবই রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ। মরহুম জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার অধ্যাপক মালিকের মতো সর্বগুণে গুণান্বিত কতজন চিকিৎসক এখন রয়েছেন? আমাদের দেশে বেশ কিছু চিকিৎসকের রোগীর প্রতি আত্মনিবেদিত হওয়া, স্নেহপ্রবণ, সহৃদয় না হওয়ার মতো কিছু অনুযোগ আছে। যারা চিকিৎসা নিতে বাইরে যান রোগমুক্ত হয়ে ঘরে ফেরেন, তাদের প্রায় সবাই সেসব দেশের চিকিৎসকের আচার-আচরণে বিমুগ্ধ আর অভিভ‚ত হয়ে পড়েন। রোগীকে যতটা সম্ভব সেবা দেয়া, আরোগ্যের জন্য নিবেদিত প্রাণের যে পরিচয় দেন, তাতে তাদের রোগীদের কাছে তারা মহিমামণ্ডিত হয়ে ওঠেন। এমনটা বোধ অবশ্য চিকিৎসারই অংশ। এসব ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমরা এ নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করেছি দেশের বহু মানুষ আর্থিক দৈন্যের কারণে ন্যূনতম চিকিৎসা নিতে সমর্থ হচ্ছেন না। তারা রোগ শরীরে বহন করে চলেছেন, দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে একসময় প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। একটি দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষকে যদি রোগ-শোকে ভুগতে হয়, ন্যূনতম খাদের সংস্থান করতে না পারেন তবে দেহ পুষ্টিহীনতা ও রোগের শিকার হতে হয়। এমন রোগাক্রান্ত ও পুষ্টিহীন জনশক্তি নিয়ে কোনো জাতিই শক্ত মেরুদণ্ডের ওপর ভর করে দাঁড়াতে এবং এগিয়ে যেতে পারে না। এগিয়ে যেতে হলে জনগণের সুস্থ দেহমনের প্রয়োজনটা যথাযথভাবে বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন বলে শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ‘.... জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাহাতে নাগরিকদের নিম্ন লিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায় (ক) অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা;’ কিন্তু দেশবাসীর চরম পরিতাপের বিষয় গত ৫০ বছরে সেটি নিশ্চিত হয়নি; ৫ মৌলিক চাহিদার কোনোটির ওপরই যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় নেয়া হয়নি অতীত থেকে আজ পর্যন্ত, তাই সবই অপূর্ণ রয়ে গেছে। শাসনতন্ত্রে আরো বলা আছে ‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন।’ কিন্তু দেশের মানুষের দিকে তাকালে কি সেই সমতা দেখতে পাই! বরং দেখতে পাই যত অসঙ্গতি, বৈষম্য। এসব তো সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। আর চিকিৎসা পাওয়া এখন সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার মতো।

ফিরে আসা যাক, বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের মূল বিষয়ে। আমরা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম, সেটি এ নিবন্ধে প্রকৃত চেতনা। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায় সে দেশে ২০২০ সালের চিকিৎসা পর্যটন থেকে তার সম্ভাব্য আয় হবে ৯ বিলিয়ন ডলার। গত পাঁচ বছরে ভারতে চিকিৎসার জন্য আসা মানুষ বা ‘মেডিক্যাল ট্যুরিস্টদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ভারতে ২০০৯ সালে চিকিৎসা নিতে অন্য দেশ থেকে যত মানুষ সেখানে গেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশীদের হার ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সে সময় ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ চিকিৎসা পর্যটক নিয়ে তালিকা শীর্ষে ছিল মালদ্বীপ। এর পরের বছরগুলোতে ক্রমাগত বাংলাদেশীদের হার বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ছোট দ্বীপদেশ মালদ্বীপের। ১০ বছর পর ২০১৯ সালে ভারতে মেডিক্যাল ট্যুরিস্টদের মধ্যে বাংলাদেশীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বিপরীতে মালদ্বীপের হার নেমে আসে ৭ দশমিক ৩ শতাংশে মাত্র। দেশের উচ্চবিত্তের মানুষ প্রধানত চিকিৎসা নিতে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে যান। মধ্যবিত্তরা যাচ্ছে ভারতে। গত বছর আগস্ট থেকে তুরস্ক ও দুবাইয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা বেড়েছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়, বিদেশে পর্যটক হিসেবে বাংলাদেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি সাড়ে ২৯ শতাংশ চিকিৎসা বাবদ ব্যয় করেন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধির কারণ হিসাবে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন, বাইরে চিকিৎসা নিতে বিশেষ করে ভারতে ব্যয় কম এবং মানুষের আস্থা বেশি। পক্ষান্তরে আমাদের দেশে খরচ বেশি এবং আস্থা কম। এ অবস্থা পাল্টাতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় মালদ্বীপের মতো ক্ষুদ্র দেশের পরিসংখ্যান ও বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে এটাই পরিষ্কার হয়, মালদ্বীপের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটছে পক্ষান্তরে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। নিচে একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরছি, তাতে একটি কারণ পরিষ্কার হবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি দুই হাজার ৮৯৪ জনের জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছেন মাত্র একজন। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে এক হাজার ৬৯৮ জনের জন্য আছে মাত্র একটি বেড। বাংলাদেশে মোট হাসপাতালের সংখ্যা সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে তিন হাজার ৫৭৫টি। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতাল মাত্র ৫৯২টি। সরকারি হাসপাতালের মধ্যে উপজেলা এবং ইউনিয়নে হাসপাতাল আছে ৩৬৭। আর ১২৫টি হাসপাতাল বিশেষায়িত। এতে স্পষ্ট হয় যে, সরকারি স্বাস্থসেবার চেয়ে বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠমো বেশি। কিন্তু বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এমন অভিযোগ রয়েছে, সরকারি হাসপাতালের কিছু চিকিৎসক সেখানে ঠিকমতো সেবা না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের প্রতি বেশি মনোযোগী ও আগ্রহী। এ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানের ওপর সর্বশেষ যে র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে, আমাদের অবস্থান ৮৮তম স্থানে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে নানা অবস্থা তো আছেই। তারপর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে একটা সমস্যা; সেখানে চিকিৎসা নিতে বেড পাওয়া অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে।

চিকিৎসা না নেয়ার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা কথা বলেছি, তার পাশাপাশি ইদানীং অনেক জটিল রোগের চমৎকার এবং রোগীর আরোগ্য লাভের আশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া যায়।

তবে দেশের ওষুধ শিল্পের প্রশংনীয় ও ‘এনকারেজিং’ বিকাশ ঘটেছে। এমন উৎসাহব্যঞ্জক খবর এলেই সবার জন্য অত্যন্ত সুখপ্রদ। দেশে কোভিডকালেও ওষুধশিল্পের অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান বছরে ২৪ হাজার রকমের ১২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করেছে। ২০১৯ সালে ইবিএল সিকিউটিরিজের ওষুধশিল্প খাত নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধশিল্পের বাজার ২০ হাজার ৫১১ কোটি টাকার। বিগত পাঁচ বছরে এই শিল্পের প্রবৃদ্ধি গড়ে ১৫.৬ শতাংশ। ওষুধ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ওষুধের যে চাহিদা তার ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে ওষুধে রফতানি করছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, আফ্রিকাসহ শতাধিক দেশে এখন রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। ২০২০ সালে ওষুধ রফতানি করে দেশের আয় হয়েছিল ১৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দেশে এখন চিকিৎসাব্যবস্থা বলতে ‘অ্যালোপ্যাথিক’ বলে বুঝি। এই পদ্ধতির চিকিৎসা সর্বাধুনিক এ কথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু এককভাবে এই চিকিৎসাব্যবস্থার আওতায় দেশের প্রতিটি নাগরিককে নিয়ে আসা আমাদের মতো অনেক দেশেই এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। কাজেই সবার কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হলে অল্টারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে হবে। বাংলাদেশে এই চিকিৎসা ও ওষুধব্যবস্থাকে আইন স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু স্বীকৃতি পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের সব দায় যেন শেষ হয়ে গেছে। তার জন্য বাস্তবমুখী কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ আদৌ সংশ্লিষ্ট মহল করছেন কি না তা জানা নেই। আর একটা কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন মনে করছি, অ্যালেপ্যাথিক চিকিৎসাব্যবস্থার সাথে এটা প্রতিযোগিতার বিষয় নয়; বরং সহাবস্থান করা। অ্যালোপ্যাথির বাইরে হোমিও প্যাথি, ইউনানি এবং আয়ুর্বেদিক- এই তিন ধরনের চিকিৎসাব্যবসাকে অল্টারনেটিভ চিকিৎসা বলা হয়। এই চিকিৎসাব্যবস্থা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে এই চিকিৎসাব্যবস্থা প্রচলিত।

বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত হোমিওপ্যাথ। ১৭৯৬ সালে এর উদ্ভাবন করেন স্যামুয়েল হ্যানিমান। রোগীকে অল্প ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলেই হোমিওপ্যাথির মূলমন্ত্র তবে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান হোমিওপ্যাথিকে নিজেদের স্বার্থের পরিপন্থী বলে মনে করে হ্যানিমানের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেছিলেন। চাপ সহ্য করতে না পেরে তিনি জার্মানি ছেড়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে চলে যান। সে যাক, স্বাস্থ্যসেবায় এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থাকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ইউনানি, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথির ওপর আস্থা রয়েছে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিরাটসংখ্যক মানুষ তাদের স্বাস্থ্যসেবায় এসব পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকেন। বাংলাদেশে এই চিকিৎসাব্যবস্থার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্য দিন দিন বাড়ছে। অল্টারনেটিভ মেডিসিন সরাসরি প্রকৃতি থেকে নেয়া, ভেষজ চিকিৎসা। সরাসরি হার্ব থেকেই ওষুধ তৈরি হয়। এই তিন পদ্ধতির চিকিৎসকদের দাবি, এসব ওষুধে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে ৪৫০টি মতো ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠান আছে, আর হোমিওপ্যাথিক ওষুধের ল্যাবরেটরি আছে এক শ’র মতো। বিপরীতে, অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ তৈরির ছোট বড় ২৬৯টির বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো আধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সুসজ্জিত এবং উপযুক্তমানের।

দেশে বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা মজবুত ভিত্তির ওপর এখনো দাঁড়াতে পারেনি। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে বহুবার সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়, তার কিয়দাংশও বিকল্প চিকিৎসার জন্য তথা ইউনানি, আয়ুর্বেদ ও হোমিও চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ হয় না। এটা আসলে বৈমাতৃসুলভ আচরণ। এমন অভিমতও রয়েছে, ভেষজ, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় ভালো সুফল পাওয়া যায়। সামগ্রিক দিক চিন্তা করে এই বিকল্প চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে সরকারের বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তবে কথা হচ্ছে এসব ওষুধের মান যাতে বজায় থাকে তা ওষুধ প্রশাসনকে দেখতে হবে। কোনো মানহীন ওষুধ যাতে বাজার না পায় সেটি দেখা জরুরি।

বাংলাদেশে ইউনানি ওষুধ তৈরি, চিকিৎসা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে ‘হামদর্দ’। ব্যক্তি হিসেবে হামদর্দের প্রধান নির্বাহী ড. হাকীম মো: ইউসুফ হারুন দেশে ইউনানি ওষুধ প্রস্তুত, বাজারজাতকরণ, ইউনানি চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক তৈরির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন। হামদর্দের মিডিয়া উইংয়ের অন্যতম নির্বাহী আমিরুল মোমেনীন মানিকের লিখিত এক প্রবন্ধ থেকে অবহিত হওয়া গেছে, ‘ড. হাকীম ইউসুফ হারুন স্বাধীনতার পরপর মাত্র ৬০ হাজার টাকা পুঁজি, প্রায় তিন লাখ টাকা দেনা, ১১ কাঠা জমি, ৩১ জন কর্মচারী এবং ওষুধ তৈরির কিছুসংখ্যক হাঁড়িপাতিল নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হামদর্দকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছিলেন। ডাক্তার ভিজিট, আউটলেটে ওষুধ দেয়া এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করেন।’ এরপর ধীরে ধীরে নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করার ফলে আজ এই প্রতিষ্ঠান মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ইউনানি-আয়ুর্বেদিক ওষুধশিল্পে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কেবল হামদর্দের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, মাদরাসা, এতিমখানাসহ বহু প্রতিষ্ঠান।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে বিকল্প চিকিৎসার নামে প্রতারণারও অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যৌন চিকিৎসার নামে একশ্রেণীর তথাকথিত চিকিৎসক মানুষের সাথে প্রতারণা করছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে মঘা ইউনানি ও হারবাল চিকিৎসার অনেক তথাকথিত চিকিৎসাকেন্দ্র আছে। এমনকি ওই সব কেন্দ্রে ‘সর্বরোগের মহৌষধ’ দেয়ার কথা বলা হয়। বিভিন্ন প্রাণীর তেলসহ অদ্ভুত সব দাওয়াই দেয়া হয়। এইসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান ইউনানি চিকিৎসাব্যবস্থার সুনাম নষ্ট করছে। তা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।

আরোগ্য, রোগমুক্তি, নিরাময়, শুশ্রুষা শব্দগুলো কত মধুর আনন্দ ও প্রশান্তির। ঠিক ততটা বেদনা বিধুর বিমর্ষ হওয়ার আর দুশ্চিন্তার, রোগাক্রান্ত মানুষের বিবর্ণ আর ম্লান মুখ। চিকিৎসা নিতে অক্ষম মানুষের গ্লানিতে ভরা হতাশাগ্রস্ত মলিন চেহারা। এভাবে দিন কাটছে সমাজের বহুজনের। কিন্তু সমাজ সরকার তাদের কাছে কতটা এগিয়ে যাচ্ছে, দুস্থের পাশে থাকার চেষ্টা করছে, অভয়বাণী সাহস সহানুভ‚তি জানাচ্ছে? সুস্থ জীবনে ফিরে এসে, স্বজন সুহৃদ শুভাকাঙ্ক্ষীরা আনন্দের মিষ্টি হাসি হাসার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু তার উল্টো যদি হতো, তবে তা কতটা তৃপ্তির না হতো। কিন্তু বাস্তবে সেটি কেবলই স্বপ্ন। মানুষের বিধিবদ্ধ অধিকার, সুস্থ হওয়ার জন্য সুচিকিৎসা আর শুশ্রƒষা পাওয়া।
এখন কি সে অধিকার লাভের কোনো সুযোগ আছে? কেননা প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে যেখানে রাষ্ট্রের মাথা পিছু চিকিৎসা বাবদ ব্যয় হয় মাত্র ১৮০.০৫ টাকা। এই অর্থ দিয়ে কিভাবে মানুষের চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব? অথচ অপচয় অনিয়ম দুর্নীতি করে বহু রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। অপর দিকে দেশ থেকে গত ১০ বছরে পাচার হয়ে গেছে ছয় লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশের দু’টি বাজেটের সমপরিমাণ। তবে সুখ, স্বস্তি ও প্রশান্তির সন্ধানে মানুষ কোন গহিন অরণ্যে যাবে, না কোন ধূসর প্রান্তরে ছুটবে?

স্বাধীনতার ৫০ বছর এখনো যে দিকে তাকাই সব তো শূন্য ও ফাঁপা মনে হয়। অথচ স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য তো ছিল ‘... আমাদের রাষ্ট্রে অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসা লাভ করা তো সংবিধানসম্মত। এই নিবন্ধের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সবই জনগণের চিকিৎসা পাওয়ার নিমিত্তে রচিত।

কিন্তু সমাজের নেতাদের এ নিয়ে ভাবনা আর কতটুকু! রাজনীতি এবং কেবল রাজনীতিই মাত্র তাদের প্রিয় বিষয়বস্তু, যা কিনা ‘অমৃত সমান’। তবে সে রাজনীতির লক্ষ্য জনকল্যাণ নয়- ক্ষমতা আর নিজের আখের নিয়ে যত ভাবনা। আমাদের সংবিধান এবং দেশের স্থপতির দেশ নিয়ে যে ভাবনা ছিল, তার মৌল চেতনা এই জনপদকে একটি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’ হিসেবে গড়ে তোলার। ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণার মধ্যে মানুষের মৌলিক সব প্রয়োজনকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পূরণ করা। এই ‘চেতনা’য় জাগ্রত ছিলেন আমাদের এ পর্যন্ত যারা ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং আছেন? সে চিন্তাচেতনা তাদের মন-মানসে কত সঞ্চারিত ছিল বা আছে? এমন লক্ষ্যকে সম্মুখে রেখে কতটা কাজ হয়েছে, হচ্ছে? আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর সুধী সমাজের কাছে সেটি বড় জিজ্ঞাসা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের দেশ গড়ার কথায় অনেকটাকাল তো কাটল। এখন এসব নিয়ে জবাবদিহি করার সময় এসেছে।

ndigantababor@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement