সভ্যতা-সংস্কৃতির বিচারদৃষ্টি : ইসলাম বনাম পাশ্চাত্য
- মুসা আল হাফিজ
- ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৯:৫১
সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংজ্ঞার্থে বিভিন্নতা আছে; বিশেষত, এই বিভিন্নতা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি ও সভ্যতা-সংস্কৃতির মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিভিন্নতার কারণে। উভয়ের বিচারের জায়গাটা আসলেই জটিল। সংস্কৃতি (culture) এবং সভ্যতা (civilization) নিয়ে পশ্চিমে বিগত কয়েক শতকের বিতর্কে এমন দু’জন পণ্ডিতকে পাবেন না, যারা ঠিক ঐকমত্যে পৌঁছতে পেরেছেন। মন্টেস্কু সভ্যতাকে প্রাকৃতিক আশীর্বাদের ফসল হিসেবে ভৌগোলিকতার সৃষ্টি মনে করেন, মর্গান তাকে বিবর্তনের শেষ ধাপ বলে চিত্রিত করেন, যেখানে লেখ্য ভাষা ও এর ব্যবহারের নমুনা রয়েছে, প্যাসকুলার জিসবার্ট নগর ও নাগরিকতাকে দেখান সভ্যতার পরিণত স্তর হিসেবে।
টেলর বা আর্নল্ড টয়েনবি থেকে আমরা শুনি, অভাব ও প্রয়োজনের নির্দেশে সভ্যতার গড়ে ওঠার বয়ান, ম্যাকাইভার মানুষের জীবন ধারণের যান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংগঠনের রূপকল্পকে দেখেন সভ্যতা হিসেবে; যেখানে কাজ করে চলছে দৃশ্যমান যন্ত্রপাতি, কৃৎকৌশল এবং বলেন, আমরা যা আছি, তা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের যা আছে, তা আমাদের সভ্যতা।
প্রত্যয়গুলো আসলে নানামুখী। এর বিশ্লেষণও কথার উপর কথামালার ব্যাপ্তি কামনা করে। আমরা বরং তার চরিত্র ও ভাবাবেগকে বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে বোঝাপড়া এগিয়ে নিতে পারি।
দ্বিতীয়ত, ইবনে খালদুন মানুষের সঙ্ঘবদ্ধতার জরুরত থেকে সমাজের উৎস নির্মাণ করেছেন। বিচ্ছিন্নতা সমাজ জীবনে কি ধরনের সঙ্কট ও সমস্যার সৃষ্টি করে এবং মানুষের জান-মালকে কিভাবে ঝুঁকিতে ফেলে, সেটা দেখিয়েছেন। সেখান থেকে রাষ্ট্র, নেতা এবং সুসংহত নিয়মাবদ্ধতার জরুরত তুলে ধরেন তিনি, যা পারস্পরিক শত্রুতা, উশৃঙ্খলা, নৈরাজ্যকে দমন করে স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। যা প্রাথমিকভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের শর্ত। কিন্তু একটি স্থিতিস্থাপক সভ্যতা নির্মাণের পেছনে নিছক সঙ্ঘবদ্ধতাই যথেষ্ট নয়। বরং সঙ্ঘবদ্ধতার স্থায়িত্ব লাগবে; কেননা অস্থায়ী এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর সভ্যতা গড়ে ওঠেনি ইতিহাসে, তারা সবসময়ই স্থানিক পরিবর্তনশীলতার জন্য সভ্যতার নির্দিষ্ট ও শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করতে অক্ষম ছিল। ইবনে খলদুনের মরুবাসী যাযাবররা যে শক্তিশালী সমাজকাঠামো তৈরি করেছিল, তাতে ভ‚মির স্থায়িত্ব না থাকলেও আসাবিয়াত বা সামাজিক সংহতিকে তীব্র করেছিল, যা বেদুঈনদের উন্নত ও সমৃদ্ধ সভ্যতার পটভ‚মিকে নিশ্চিত করে।
তৃতীয়ত, আলিয়া আলির Islam between East and West-এর সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি তত্ত্ব হাজির হয়, যেগুলো আদতে সংজ্ঞার্থ না বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতির গতিপ্রকৃতি বোঝায়। যেমন - ক. সংস্কৃতি তার ধর্ম, নীতি ও দর্শন সহযোগে মানুষ ও মানুষের আদি উৎস পারমার্থিক জগতের পারস্পরিক সম্পর্ককে উচ্চকিত করে। বিপরীতে সভ্যতা হলো প্রাণিবিদ্যালগ্ন ও জীবনের অনবরত ধারাবাহিকতা; যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বস্তুগত আদান-প্রদান চলে। খ. সংস্কৃতি হলো বিরামহীনভাবে নিজেকে সৃষ্টি করা, সভ্যতা হলো পৃথিবীকে পরিবর্তন করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা। এখানেই মানুষ ও বস্তুর মাঝের বৈসাদৃশ্য স্পষ্ট হয়। গ. সভ্যতা পারমার্থিক নয়, বরং কলাকৌশলগত প্রগতির ধারাবাহিকতা, ঠিক যেমনটা ডারউইনীয় বিবর্তন মানবিক নয়, জীববিদ্যক প্রগতির ধারাবাহিকতা। বিপরীতে সংস্কৃতি হলো মানবিক স্বাধীনতারই নির্বাচন ও প্রকাশন।
(culture) এবং (civilization) নিয়ে আলিয়া আলি ইজেতবেগোভিচের গোটা আলাপের সারমর্ম হচ্ছে, ‘সংস্কৃতির বাহক মানুষ, সভ্যতার বাহক সমাজ’ এবং ‘সংস্কৃতির সম্পর্ক রুহানিয়াত ও পরকালের সাথে আর সভ্যতার সম্পর্ক ইহ-জাগতিকতার সাথে। তার মতে, ‘সভ্যতার মধ্যে এমন কোনো ধনাত্মক শক্তি নেই যা সভ্যতার সব অবিচলতা ও অসামঞ্জস্য মোকাবেলা করতে পারে।
সভ্যতা তাই সীমাবদ্ধতার পরিসরকে অতিক্রম করতে পারে না। সে যে অন্য সভ্যতার সাথে দ্ব›দ্ব করে আবার সংহতি ও আদান-প্রদানে সক্রিয় থাকে, এটি মূলত আপন প্রয়োজনেই। একটি সভ্যতা আবার নিজের এক মাত্রার সাথে অন্য মাত্রার দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়েও নিজেকে প্রসারিত করে। বিশ শতকের ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় পুঁজিবাদ ও উদার গণতন্ত্রের সাথে সমাজতন্ত্রের একটি দ্বন্দ্ব আমরা দেখেছি। এটি জগতকে উত্তপ্ত করেছিল। কিন্তু এ ছিল পশ্চিমা সভ্যতার এক প্রবণতার সাথে আরেক প্রবণতার টক্কর। কিংবা শিল্প-সাহিত্য ও সমাজভাবনায় উচ্চরোল তোলা আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার যে সঙ্ঘাত, সেখানে দ্বন্দ্বের নিনাদ আছে; কিন্তু গভীরতা কতটুকু?
আদতে গিডেন্সের ভাষায় উত্তরাধুনিকতাও এক কিসিমের আধুনিকতা, আধুনিকতার ভেতরের প্রগতিশীল আধুনিকতা, আধুনিকতার মোকাবেলা যেমন উত্তরাধুনিকতা দিয়ে সম্ভব নয়; তেমনি সভ্যতার অসুখ সভ্যতার ভেতরকার কোনো ওষুধ দিয়ে চিকিৎসাযোগ্য নয়, একে অনুসন্ধান করতে হবে অসুখী সভ্যতার বাইরে কোথাও। ১৯৭৯ সালে ইরান-বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে যেমনটি করতে চেয়েছিলেন মিশেল ফুকোর মতো কিছু পশ্চিমা তাত্তি¡ক। তারা এ বিপ্লবে দেখেন ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’ (political spirituality)। যা পশ্চিম রাষ্ট্রব্যবস্থায় গির্জাকে বর্জনের মধ্যে দিয়ে রুহানিয়াতের যে সঙ্কট তৈরি করেছিল, সেই অপূর্ণতার প্রতিষেধক হতে পারে।
চতুর্থত, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংজ্ঞায়নে যেহেতু প্রতিটি জাতির নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রভাব থাকে, ফলত মুসলিম জাতির নিজস্ব পরিসর থেকে পশ্চিমা সভ্যতার মোকাবেলা করতে হলে ইসলামের অন্তর্দৃষ্টিসমূহ এবং এর ধারক ‘তুরাস’ বা ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে এগোতে হবে। সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সাথে আমাদের তুরাসের ব্যুৎপত্তি এবং সংজ্ঞার্থে কী ধরনের সম্পর্ক, সেটা নির্মাণ করতে হবে আগে। মুসলিম ঐতিহ্যে গির্জার মতো নিছক সংস্কৃতি এবং গ্রিক ও রোমান সিলসিলার মতো প্রধানত সভ্যতাকেন্দ্রিক একমুখিনতা নেই। তুরাসের অগ্রযাত্রা সবসময়ই সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে বেড়ে ও গড়ে উঠেছে।
এ ক্ষেত্রে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার তুলনামূলক বিশ্লেষণ গুরুতর প্রয়োজনরূপে সামনে হাজির হয়। এ বিশ্লেষণে আমরা লক্ষ্য করি -
পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে গুরুতর সঙ্কট হচ্ছে, বস্তুবাদিতা। জগত ও মানুষের সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে তাদের সব আলাপের কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকে বস্তুবাদ। পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ জগতের প্রভু ও নেতা কিন্তু ইসলামী চিন্তায় মানুষ দুনিয়ায় আল্লাহর প্রতিভূ বা খলিফা হিসেবে বিবেচিত হয়। এ জন্য পশ্চিমা সভ্যতার ব্যক্তিসত্তা পরম স্বাধীনতায় বিশ্বাসী; কোনো শরিয়তের অধীনতা মানে না, হালালকে হারাম, হারামকে হালাল বানানোর পূর্ণ কর্তৃত্বের দাবি করে এবং সুদের মতো বর্বর নীতিকে তারা আইনগত স্বীকৃতি দিয়েছে। বিপরীতে ইসলামী বিশ্বাসের ব্যক্তিসত্তা শরিয়তের আজ্ঞাবহ। পশ্চিমা ধারণার গোড়াতেই এর পরিসর তৈরি হয়েছে। সেখানে বিশ্বের স্রষ্টা ও প্রভুকে অকর্মা বানিয়ে রাখার প্রস্তাব এসেছে গ্রিক দর্শনের ভেতর থেকে। তিনি কেবল বানিয়েছেন, আর তার কোনো কাজ নেই। স্রষ্টা সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের দাবি হলো-- স্রষ্টা আদিকারণ; প্রথম কারণও তিনি সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু জগতের পরবর্তী ঘটনা-দুর্ঘটনায় স্রষ্টার কোনো হাত নেই। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতা প্রাণরস গ্রহণ করেছে। বিপরীতে ইসলামী সভ্যতায় স্রষ্টা সর্বশক্তিমান; পৃথিবীর ছোট-বড় সব ঘটনা তাঁর কর্তৃত্বের অধীনে।
গ্রিক দর্শন ও পশ্চিমা সভ্যতার সংযোগ নির্মিত হওয়ার আগে, মধ্যবর্তী সময়ে সাময়িকভাবে ক্রিস্টিয়ানিটি এক ধরনের রুহানিয়াত বহন করলেও, বিজিত রাষ্ট্রে রুহানিয়াতের সম্প্রসারণ তারা ঘটাতে পারেনি। এখানে ঐতিহাসিক বাস্তবতা হচ্ছে, খ্রিষ্টবাদ ইউরোপে যখন প্রবেশ করেছে, সেখানকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি কর্তৃক অধিগ্রহণের শিকার হয়েছে। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বিপুলভাবে। আর মুসলিমরা যেসব অঞ্চল ও রাষ্ট্র বিজয় করেছেন, ইসলাম সেখানের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। আপন সভ্যতা-সংস্কৃতির মূল্যমানের দ্বারা গণমনকে নিজের দিকে আকর্ষণ করেছে।
পশ্চিমা দুনিয়ায় খ্রিষ্টবাদ জীবন ও জগতের কোনো সম্যক অন্তর্দৃষ্টি সঞ্চারিত করতে পারেনি। পশ্চিমা সভ্যতাকে সে রুহানি সমৃদ্ধি দিতে গিয়ে একদিকে জীবনবিমুখ বৈরাগ্যবাদের দিকে হাঁকাতে চাইল, অপরদিকে খ্রিষ্টীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠল দুশ্চরিত্র, স্বৈরাচারী ও আধ্যাত্মিক-বস্তুবাদী। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে জন্ম নিয়েছে নানা গুরুতর অসুখ, যার শিরোভাগে আছে সেক্যুলারিজম। ‘সিজারের (রাষ্ট্রের) অংশ সিজারকে দাও, স্রষ্টার হিস্যা স্রষ্টাকে দাও’ - খ্রিষ্টবাদের এই বহুল প্রচলিত বাক্য আদতে এরিস্টটলের প্রতিধ্বনি; এরিস্টটল শেখাতেন, জগতের সাথে স্রষ্টার কোনো সম্পর্ক নেই।
পশ্চিমের গভীর ও সদালগ্ন আরেক সঙ্কটের নাম ‘বর্ণবাদ’। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা নিজেদের গণতন্ত্রের প্রবর্তক বলে দাবি করতেন এবং নেতৃত্বস্থানীয় ও শাসকশ্রেণী ছাড়া অন্যদের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার অধিকার এড়িয়ে যেতেন, উপেক্ষা করতেন বা প্রত্যাখ্যান করতেন। রোমানরা এতটাই বর্ণবাদী ছিল যে, অ-রোমকদেরকে রোমান আইনের অধীনে শাসিত হওয়ার যোগ্য মনে করত না। রোমান সভ্যতা ন্যায়বিচারের জন্য গর্ব করে। কিন্তু তার ন্যায় ছিল একান্তই রোমানদের জন্য। অন্যদের অংশ সেখানে ছিল না। কিন্তু ইসলামের ন্যায়বিচার সবার জন্য। সব জাতি ও সভ্যতার জন্য। কারো প্রতি অবিচার এখানে হারাম। অন্য ধর্মাবলম্বীদের মতো নিশ্চিত করতে নানা ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হবে তাদেরই ধর্মীয় বিধানের আলোকে।
ইসলামী আইন ওহির সর্বজনীন ইনসাফ থেকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিজ নিজ আইনের অধীন করেছে নানা ক্ষেত্রে। কিন্তু রোমান আইন বর্ণবাদী কারণে অন্য বর্বর জাতিদের ‘মহান রোমান ন্যায়’ দ্বারা শাসিত হওয়ার যোগ্যই মনে করত না। অন্যদের না-মানুষ হিসেবে দেখা ও দেখানোর এ উত্তরাধিকার পশ্চিমা সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্রিয়াশীল।
আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতিতে; জ্ঞান-অনুশীলন, শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বর্ণবাদী প্রবণতা পশ্চিমা সভ্যতার অভিমুখ তৈরি করে দিয়েছে। জাতিগুলোকে সভ্য বানানোর নামে উপনিবেশায়ন, তাদের দেশ দখল, অব্যাহত গণনিধন ও লুটতাণ্ডব পরিচালনা করেছে এই বর্ণবাদী মন। জার্মানিতে হিটলারের জাতিবিভাজন, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনিদের ওপর অব্যাহত নির্যাতনে সক্রিয় আছে এই বর্ণবাদী মানসিকতা। নিজেদেরকে শাসক এবং অন্যান্য জাতিকে শাসিত হওয়ার যোগ্য হিসেবে ধরে নিয়েই তারা দুনিয়ার অন্যান্য জাতিকে দেখে, পর বানায়। তাদের তুচ্ছ, বর্বর, নীচ ও কমমানুষ হিসেবে চিত্রিত করে তাদের সাথে সে অনুযায়ী আচরণ করে পশ্চিমা রাজনীতি, আর্টিলারি, শিল্প-সাহিত্য, বিচারদৃষ্টি। এটি যেমন পুঁজিবাদী ব্লকে বিদ্যমান, তেমনি সমাজতান্ত্রিক শিবিরে। জাজিরাতুল আরবকে যখন পশ্চিমা দখলদাররা উপনিবেশ বানিয়ে নেয়, কার্ল মার্ক্স তখন আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ এর মাধ্যমে বর্বরদের অগ্রগতি হবে। পশ্চাৎপদতা দূর হবে। এভাবে বর্ণবাদ বিকশিত হয়েছে মার্কসীয় চিন্তায়ও।
লক্ষ করলে দেখব, ইসলাম এখানে দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে পশ্চিমা মানসিকতার বিপরীতে দাঁড়ায়। ফলে পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ যখন আমাদের মন, জ্ঞান, শ্রম ও চিন্তার উপর শাসন জারি রাখতে চায় ও প্রবল করতে চায়, ইসলাম সেখানে মুক্তির তাকবির ও বিকল্প জীবনব্যবস্থা হিসেবে উচ্চকিত।
ইসলামের সাথে তার পৃথকতা দ্বন্দ্বে এবং সমন্বয়েও লক্ষ্যণীয়। দ্বা›িদ্বকতা পশ্চিমা সভ্যতার নিরাময়হীন রোগ; এর প্রবল এক উদ্বোধক ‘ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ’। যেখানে জগতবিচারে রয়েছে মৌলিক নীতি, যা দুনিয়াকে চালাচ্ছে। উৎকৃষ্টকে টিকে থাকার জন্য নির্বাচন করা হয় ও অযোগ্যের জন্য বরাদ্দ থাকে পতন ও বিনাশ। অন্য দিকে, হেগেলের দ্ব›দ্বতত্তে¡ প্রতিটি জিনিসের মধ্যে সঙ্ঘাত ও বৈপরিত্য হাজির হয়েছে। এই পাটাতনে দাঁড়িয়ে কার্ল মার্ক্স নির্মাণ করছেন সমাজ ও ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, কৃষিসমাজ, দাস ব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র ও জমিদারপ্রথা হয়ে সভ্যতা আজ প্রবেশ করেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায়, মার্ক্সীয় বিশ্ববীক্ষার দাবি হচ্ছে - জগতের চিরায়ত দ্বন্দ্বের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা হিসেবে আগামী বিশ্ব হবে সাম্যবাদী। এসব প্রক্রিয়ায় একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে। তা হলো - নতুন পুরাতনকে বাতিল করছে। আর আপনি টিকে থাকবেন এর মানে অন্যকে উচ্ছেদ করবেন। অতএব, পশ্চিমা মন অন্য সবাইকে বঞ্চিত করে জগতের সবচেয়ে ভালো জিনিসটি ভোগ করার অন্তহীন আকাঙ্ক্ষায় বিচলিত। নিজের বেঁচে থাকা ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রয়োজনে অন্যের বিনাশে প্রস্তুত এবং তার পৃথিবীতে দুর্বলের বিপন্নতাই বিধান!
ওয়ায়েল হাল্লাক পশ্চিমের প্রগতির ধারণাকে বলেছেন, ‘Theology of progress’। এটি প্রগতির এক সরল রৈখিক ধারণায় বিশ্বাস করে। অতীতে যা ছিল, তা পশ্চাৎপদ। সুন্দর যা কিছু, তা সমুখে। কৃষিভিত্তিক জীবনের চেয়ে নগর ও শিল্পায়িত জীবন প্রগতিশীল। এভাবে সে একটা এথিক্সও তৈরি করে। প্রগতির এই ধারণা বিশ্বাস রাখে, এক অনাগত সুন্দর ভবিষ্যতের ওপর যা বর্তমানের চেয়েও উত্তম। বিপরীতে ইসলামে আছে ‘খাইরুল কুরুন’ এর ধারণা। এটাকে হাল্লাক বলছেন, ‘Theology of ethical reversion’; যা পশ্চিমা প্রগতির বিপরীতে তাকায় অতীতের দিকে। নবী ও সাহাবিদের প্রথম তিন প্রজন্ম হচ্ছেন খাইরুল কুরুন। ইসলামী সংস্কৃতি-সভ্যতায় ‘অতীত’ নৈতিকভাবে অনুসরণীয় এক শৃঙ্খলা। কিন্তু সেই শৃঙ্খলা আমাদের গতিকে শৃঙ্খলিত করে না। প্রত্যহ পরিবর্তন ও নিয়ত প্রগতিকে স্বীকার করে। অতীতের সাথে তার সংযোগ গতি ও অগ্রগতির প্রয়োজনে। যা প্রধানত আদর্শিক, আধ্যাত্মিক। এখানে মানব জীবনে সবলের টিকে থাকা, দুর্বলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে নয়। কারণ ইসলামের সভ্যতা-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে মানবসমাজ কোনো জঙ্গল নয়, যেখানে ছোট প্রাণী বড় প্রাণীর আহার! এখানে আমার বিকাশের জন্য অন্যের বিনাশ এবং আমার সুখের জন্য অন্যের অসুখ ডেকে আনার মানসিকতা নেই। পৃথিবী কোনো ভোগের বাজার নয় এবং মানুষ কেবল বস্তু নয়, যার আত্মার সক্রিয় চাহিদা নেই, সে কেবল আত্মা নয়, যার বস্তুগত বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা হবে। ফলে সুষম সমন্বয় এখানে ঘটে, যা সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের পথে পশ্চিমা সভ্যতা থেকে গভীরভাবে আলাদা, মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র!
লেখক : কবি, গবেষক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা